📚উত্তরসহবাংলা মেজর/মাইনর সাজেশন(Semester-II)📚
✍️প্রশ্নের মান-৫:
১. রামপ্রসাদ সেন এবং কমলাকান্ত ভট্টাচার্য এই দুই শাক্ত পদকর্তা কৃতিত্ব সম্পর্কে তুলনামূলক আলোচনা কর।
উঃ রামপ্রসাদই বাংলা ভাষায় প্রথম শাক্ত পদাবলী রচনা করেন। শাক্ত পদাবলীর প্রধান দুটি ধারা— ‘উমাসঙ্গীত’ এবং ‘শ্যামাসঙ্গীত’; রামপ্রসাদ দুটি ধারাতেই পদরচনার প্রবর্তক হলেও ঊমাসঙ্গীতে তাঁর রচনার পরিমাণ খুবই নগণ্য। তিনি মূলত সাধক ছিলেন বলেই সাধনসঙ্গীত রচনাতেই প্রধানত আত্মনিয়োগ করেছিলেন। পক্ষান্তরে, দ্বিজ কমলাকান্তও ছিলেন সাধক কবি। তিনি প্রকৃতপক্ষে রামপ্রসাদের যথার্থ উত্তরসূরী। শাক্তপদ-রচয়িতাদের মধ্যে রামপ্রসাদের পর সর্বাধিক শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত নামটি কমলাকান্তের পরিমাণগত ও গুণগতভাবে তাঁর রচিত পদগুলিই অনেক সময় সবচেয়ে বেশি আকর্ষণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। বিশেষত আগমনী বিজয়ার যে পদগুলি শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য, তাদের অধিকাংশই কমলাকান্তের রচনা। এই পর্যায়ে কমলাকান্তই সম্ভবত শ্রেষ্ঠ কবির মর্যাদা লাভ করতে পারেন। এই পর্যায়ে রামপ্রসাদের পদের সংখ্যা এত কম যে গুণগতভাবে সেগুলি উৎকৃষ্ট বিবেচিত হলেও অপরের সঙ্গে তাকে তুলনা করা সঙ্গত নয়। আগমনী-বিজয়ার যে সামান্য কয়টি পদ রামপ্রসাদ রচনা করেছেন, তাতে তার গভীর আন্তরিকতার পরিচয় পাওয়া গেলেও এতে কোনো চরিত্রের বিশেষ রূপ কিংবা কোনো ভাবের বিশেষ তাৎপর্য ফুটে ওঠার অবকাশ পায়নি। পক্ষান্তরে কমলাকান্ত আগমনী-বিজয়ার বিভিন্ন পর্যায়ের পদ রচনা করায় যেমন তার রচনার মধ্যে দিয়ে একটি কাহিনী গড়ে তোলা যায় তেমনি গিরিরাজ, মেনকা এবং উমার চরিত্র বৈশিষ্ট্যেরও পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর রচনায়। অতএব ‘আগমনী-বিজয়া’র পদ-রচনায় শুধু রামপ্রসাদ এবং কমলাকাত্তের মধ্যে একাত্তই তুলনা টানতে হয়, তবে বিজয়লক্ষ্মীর বরমাল্যটি যে কমলাকান্তের গলাতেই শোভা পাবে, এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
২. ময়মনসিংহ গীতিকা কবে কোথা থেকে প্রকাশ হয়? এর প্রধান বৈশিষ্ট্য কি ছিল?
উঃ ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রাচীন পালাগানের সংকলন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সেন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা থেকে স্থানীয় সংগ্রাহকদের সহায়তায় প্রচলিত এ পালাগানগুলো সংগ্রহ ও সম্পাদনা করে মৈমনসিংহ গীতিকা (১৯২৩) নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন। গ্রন্থটি বিষয়মাহাত্ম্য ও শিল্পগুণে শিক্ষিত মানুষেরও মন জয় করে।
মৈমনসিংহ গীতিকায় ১০টি গীতিকা স্থান পেয়েছে, যথা—মহুয়া, মলুয়া, চন্দ্রাবতী, কমলা, দেওয়ান ভাবনা, দস্যু কেনারামের পালা, রূপবতী, কঙ্ক ও লীলা, কাজলরেখা ও দেওয়ানা মদিনা। ভনিতা থেকে কিছু গীত রচয়িতার নাম জানা যায়, যেমন মহুয়া—দ্বিজ কানাই, চন্দ্রাবতী- নয়ানচাঁদ ঘোষ, কমলা- দ্বিজ ঈশান, দস্যু কেনারামের পালা- চন্দ্রাবতী, দেওয়ানা মদিনা- মনসুর বয়াতি। কঙ্ক ও লীলার রচয়িতা হিসেবে ৪ জনের নাম পাওয়া যায়- দামোদর দাস, রঘুসুত, শ্রীনাথ বিনোদ ও নয়ানচাঁদ ঘোষ। অবশিষ্ট গীতিকার রচয়িতার নাম জানা যায় না। গীতিকায় রচয়িতার নাম থাকলেও তাঁদের স্বতন্ত্র কবিত্বের চিহ্ন নেই; বরং বিষয়বস্ত্ত, শিল্পাঙ্গিক, ভাষাভঙ্গি ও পরিবেশনা রীতি অভিন্ন বলেই প্রতিভাত হয়। আখ্যানগুলি লোকসমাজ থেকেই গৃহীত হয়েছে। ধর্ম নয়, পার্থিব জীবনকথা গীতিকার প্রধান বৈশিষ্ট্য। মৈমনসিংহ গীতিকার দস্যু কেনারামের পালা ছাড়া বাকি ৯টি পালার মুখ্য বিষয় নরনারীর লৌকিক প্রেম। প্রেমের পরিণতি কোনোটির মিলনাত্মক, কোনোটির বিয়োগান্তক। নায়িকার নামানুসারে গীতিকাগুলির নামকরণ হয়েছে। গীতিকাগুলিতে পুরুষ চরিত্রের তুলনায় নারী চরিত্রের ভূমিকা উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত। প্রেমের প্রতিষ্ঠায় তারাই বেশি সংগ্রাম ও ত্যাগ স্বীকার করেছে। নারীদের একনিষ্ঠ প্রেম ও বলিষ্ঠ চরিত্র থেকে অনেকে মনে করেন, গীতিকাগুলিতে কোনো মাতৃতান্ত্রিক সমাজের প্রভাব থাকতে পারে। নারী-চরিত্রের মহিমা কীর্তন করে দীনেশচন্দ্র সেন গ্রন্থের ভূমিকায় বলেন, ‘এই গীতিকাগুলির নারী চরিত্রসমূহ প্রেমে দুর্জয় শক্তি, আত্মমর্যাদার অলঙ্ঘ পবিত্রতা ও অত্যাচারীর হীন পরাজয় জীবন্তভাবে দেখাইতেছে। নারীপ্রকৃতি মন্ত্র মুখস্থ করিয়া বড় হয় নাই—চিরকাল প্রেমে বড় হইয়াছে।’
৩. শিব সংকীর্তন কাব্যে শিব চরিত্রে পৌরাণিক ও লৌকিক কাহিনীর মিশ্রণ কতদূর সার্থক হয়েছে তা আলোচনা কর।
উঃ
৪. ধর্মমঙ্গল কাব্যের কাহিনী সংক্ষেপে বর্ণনা কর।
উঃ ★ধর্মমঙ্গলের কাহিনি:–
ধর্মমঙ্গল কাব্যের দুটি কাহিনি—হরিশ্চন্দ্র ও লাউসেনের কাহিনি।
১. হরিশ্চন্দ্রের কাহিনি:–
রাজা হরিশ্চন্দ্র ও তার রানি মদনা নিঃসন্তান হওয়ায় সমাজে লোকনিন্দার ভয়ে মনের দুঃখে ঘুরতে ঘুরতে বল্লুকা নদীর তীরে উপস্থিত হয়ে দেখেন সেখানে ধর্মঠাকুরের ভক্তেরা ঘটা করে দেবতার পূজা করছেন। রাজা ও রানি তাদের কাছে ধর্মঠাকুরের। মাহাত্ম্য শুনে ধর্মঠাকুরের পূজার্চনা করে শর্তসাপেক্ষে বর লাভ করেন। শর্ত হল এই তাদের পুত্রকে ধর্মঠাকুরের কাছে বলি দিতে হবে। যথাসময়ে মদনার পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। রাজা ও রানি পুত্রকে পেয়ে ধর্মঠাকুরের কাছে বলি দেওয়ার পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভুলে যান। ধর্মঠাকুর ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে একদিন হরিশ্চন্দ্রের কাছে উপস্থিত হন। সেদিন ছিল। একাদশীর পারণ; ছদ্মবেশী ব্রাহ্মণ রাজপুত্র লুইধরের মাংস আহার করতে চাইলে রাজা ও রানি পুত্রকে বধ করে তার মাংস রান্না করলেন। রাজা ও রানির এই আনুগত্য ও নিষ্ঠায় সন্তুষ্ট হয়ে ধর্মঠাকুর লুইধরকে জীবিত করে পুনরায় রাজা-রানির কাছে ফিরিয়ে দেন। এরপর রাজা ও রানির প্রচেষ্টায় ধর্মঠাকুরের পূজা মহাসমারোহে আয়োজিত হতে থাকে।
২. লাউসেনের কাহিনি:–
নায়ক লাউসেনের জন্ম থেকে স্বর্গ গমন পর্যন্ত কাহিনি অবলম্বনে এই কাব্য রচিত কাব্যের কাহিনি চব্বিশটি সর্গ বা বারটি পালায় বিভক্ত। মর্ত্যে পূজা প্রচারের জন্য দেবনর্তকী জাম্ববতীকে স্বর্গভ্রষ্ট করিয়ে মর্ত্যে পাঠানো হয়। তার নাম হয় রঞ্জাবতী। তার বড় বোন ছিলেন গৌড়রাজের পত্নী, ভাই মহামদ প্রধান অমাত্য। অন্যদিকে ঢেকুরগড়ের অধিপতি কর্ণসেন ছিলেন গৌড়েশ্বরের অধীনে এক সামন্ত রাজা। ঢেকুরগড়ের বিদ্রোহী রাজা ইছাই ঘোষকে দমন করতে গিয়ে তার ছয় পুত্র যুদ্ধে নিহত হলেন। এরপর গৌড়েশ্বর তাঁর শ্যালিকা রঞ্জাবতীর সঙ্গে কর্ণসেনের বিয়ে দেন। এই বিয়েতে মহামদের অমত ছিল। তাই সব রাগ গিয়ে পড়ল বোন ও ভগ্নিপতির উপর। নানাভাবে তাদের উপর অত্যাচার শুরু করলেন মহামদ। তারপর বহুদিন পর্যন্ত রঞ্জাবতী নিঃসন্তান ছিলেন। কিন্তু ধর্মঠাকুরের কৃপায় কর্ণসেন এক পুত্রসন্তান লাভ করেন এবং তার নাম হয় লাউসেন। লাউসেন ক্রমে মস্ত বীর হয়ে ওঠে। এই লাউসেন-এর উপরও রাগ গিয়ে পড়ে মহামদের।
শক্তি পরীক্ষার জন্য লাউসেন একবার গৌড়ে যান। সে সময়ে মাতুল মহামদ লাউসেনকে বন্দী করে। কিন্তু গৌড়েশ্বরের কাছে লাউসেন তার বাহুবলের পারদর্শিতা দেখিয়ে কারামুক্ত হন। এরপর ময়নাগড়ে ফেরার পথে কালু ডোম ও তার স্ত্রী লখাই-এর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ও কালু ডোম সেনাপতির পদ লাভ করেন।
এদিকে মহামদ লাউসেনের অনিষ্ট সাধনের উপায় খুঁজে বেড়াতে লাগলেন। মহামদের পরামর্শে গৌড়েশ্বর লাউসেনকে কামরূপ রাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠান। সেখানেও কামরূপ রাজাকে পরাভূত করেন লাউসেন এবং তার কন্যা কলিঙ্গাকে বিবাহ করে গৌড়ে সগৌরবে প্রত্যাবর্তন করেন।
এরপর ঢেকুররাজ ইছাই ঘোষকে দমন করার জন্য লাউসেনকে পাঠান হল। অজয় নদীর তীরে দুপক্ষে ভীষণ যুদ্ধ বেধে গেল। ধর্মের আশীর্বাদে লাউসেন বিজয়ী হলেন। এত দুরভিসন্ধি করেও মহামদ যখন লাউসেনকে বিপদে ফেলতে পারছেন না তখন তার বিরুদ্ধে এক ভীষণ চক্রান্ত করলেন মহামদ। গৌড়েশ্বর আদেশ দিলেন লাউসেনকে পশ্চিমদিকে সূর্যোদয় দেখাতে হবে, না পারলে মৃত্যুদণ্ড হবে। ধর্মের কৃপায় লাউসেন সেই অসম্ভবকেও সম্ভব করে দেখালেন। এদিকে এই অবকাশে মহামদ ময়নাগড় আক্রমণ করেন। তাঁকে প্রতিরোধ করতে প্রাণ দেন কালু ডোম, ডোমনী লখাই ও প্রথম রানি কলিঙ্গা। এরপর লাউসেন দেশে ফিরে এসে যখন দেখলেন রাজ্য বিধ্বস্ত, তখন তিনি ধর্মের স্তব করতে লাগলেন। ধর্মের অনুগ্রহে সকলে প্রাণ ফিরে পায়। ধর্মের কোপে মহামদের কুষ্ঠ হয়। লাউসেনের দয়ায় তার কুণ্ঠ সারে। সুখে-শান্তিতে দীর্ঘকাল রাজত্ব করার পর পুত্র চিত্রসেনের হাতে রাজ্য সমর্পণ করে সপরিবারে স্বর্গ গমন করেন লাউসেন।
৫. ধর্মমঙ্গল কাব্যকে রাঢ়ের জাতীয় মঙ্গলকাব্য বলা হয় কেন?
উঃ বিষয়বস্তুর প্রাচীনত্বে ও বিভিন্ন ধর্মমতের সমন্বয় প্রয়াসের প্রত্যক্ষ নিদর্শন রূপে ধর্মমঙ্গল কাব্যই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মধ্যযুগীয় দৈব নির্ভরতাবাদী মঙ্গলকাব্য ধারায় ধর্মমঙ্গলের স্থান কিছুটা ভিন্ন ধরনের। এই স্বাতন্ত্র্য্য মূলত ধর্মঠাকুরের স্বরূপে, ভৌগোলিক অবস্থানে এবং বিষয়বস্তুর বর্ণনা ভঙ্গিমায়। তাই এই কাব্য নিয়ে নানা দাবী উপস্থাপিত হয়েছে। এমনও দাবী করা হয়েছে যে ধর্মমঙ্গল রাঢ়ের জাতীয় কাব্য।
ধর্মমঙ্গলের কাহিনির পেছনে যে ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু রয়েছে তাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পাল বংশের সমাপ্তি পর্বকে এই কাহিনির পটভূমি হিসাবে মনে করা হয়। এই কাহিনির ইছাই ঘোষ, লাউসেন ঐতিহাসিক ব্যক্তি। এই কাব্যে যুদ্ধ-বিগ্রহজনিত উত্তেজনামূলক ঘটনা প্রাচুর্যময় বাংলার ঘটনাকেই সূচিত করে। ধর্মঠাকুরের উৎসব কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গের উৎসব। অন্যান্য মঙ্গলকাব্যে সাধারণ বাঙালির যে মেরুদণ্ডহীন নমনীয়তা দেবতার অভিপ্রায়ের কাছে সমর্পিত হয়েছে, তার বিপরীত রূপটিই এখানে প্রকাশিত। ধর্মমঙ্গলে রাঢ়ের রাজনৈতিক জীবনযাত্রা ও তার নিম্নশ্রেণির নর-নারীর মহিমান্বিত দেশাত্মবোধের যে উজ্জ্বল রসসমৃদ্ধ চিত্র আমরা পাই তাতে একে রাঢ়ের জাতীয় কাব্য রূপে অভিহিত করা যায়।
৬. জ্ঞানদাস ও গোবিন্দ দাসের তুলনামূলক আলোচনা কর।
উঃ ষোড়শ শতকে আবির্ভূত চৈত্যনোত্তর বৈষ্ণব পদাবলীর সার্থক দুই রূপকার হলেন জ্ঞানদাস ও গোবিন্দদাস। চৈতন্য পূর্বযুগের সার্থক দুই পদকার ছিলেন চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতি। একইভাবে বলা যায়, চৈত্যনোত্তর যুগের শ্রেষ্ঠ দুই বৈষ্ণব কবি হলেন জ্ঞানদাস ও গোবিন্দদাস। আবার চৈত্যনোত্তর যুগের শ্রেষ্ঠ দুই যুগল পদকর্তা প্রাক চৈতন্যযুগের শ্রেষ্ঠ দুই যুগল পদকর্তার শ্রেষ্ঠ উত্তরসুরী। তাই জ্ঞানদাসকে বলা হয় চণ্ডদীসের ভাবশিষ্য ও গোবিন্দদাসকে বলা হয় বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য ।
তুলনামূলক আলোচনা :
সাদৃশ্য :
এক।। উভয়েই বৈষ্ণবীয় তথ্য দর্শনের আদর্শে বৈষ্ণব পদ লিখেছেন। উভয়েই যত বড়ো কবি তত বড়ো বৈষ্ণব ভক্ত। তাই উভয়েই গৌরচন্দ্রিকা পর্যায়ের পদ রচনা করেছেন।
দুই।। রূপ দর্শন জাত মধুর স্বপ্নের চিত্র দুই কবির ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে। কবিতা হয়ে উঠেছে রোমান্টিক স্বপ্নে মাখা যা আধুনিক কবিদেরও প্রেরণা নিয়ে এসেছে।যেমন-
“চল চল কাঁচা অঙ্গের লাবনী
অবনী বহিয়া যায়।
ঈসত হাঁসির তরঙ্গ হিল্ললে
মদন মূর্ছা পায়।”
বৈসাদৃশ্য :
এক।। গোবিন্দদাস ব্রজবুলী ভাষায় পদ লিখে যত দূর স্বার্থক হতে পেরেছেন বাংলা ভাষায় পদ লিখে সেই সার্থকতা পান নি ।
অন্যদিকে, জ্ঞানদাস বাংলা ভাষায় পদ লিখে যতদূর সার্থক হতে পেরেছেন কৃত্রিম ব্রজবুলী ভাষায় পদ লিখে ততদূর সার্থক হতে পারেন নি।
দুই।। জ্ঞানদাস ভাব ও গম্ভীর—চণ্ডীদাসের মতে সহজ সরল ভাষায় পদ লিখেছেন।অন্যদিকে, গোবিন্দদাসের পদে বিদ্যাপতির মতো মণ্ডন কলার পারদর্শিতা লক্ষণীয়।
তিন।। গোবিন্দদাসের পদে এসেছে চিত্রধর্মের সাথে নাটকীয়তা।অন্যদিকে, জ্ঞানদাসের পরে আবেগময়তা ও রোমান্টিকতা, ছায়া ও কায়ার মতো জড়িয়ে থেকেছে।
চার।। গোবিন্দদাস যা দেখেন তাই ছবির মতো ফুটিয়ে তুলতে পারেন। গভীর চিন্তাদর্শন তার মধ্যে থাকে না-
“যাহা যাহা নিকোসয়ে তনু তনু মতি।
তাহা তাহা বিজুরি চমক ময় হতি।।”
অন্যদিকে, জ্ঞানদাসের পদে ছবি নয় চিন্তাদর্শন বড়ো হয়ে উঠেছে-
“রূপ লাগি আঁখি ঝুয়ে গুনে মন ভর।
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।।”
৭.চন্ডীদাস ও বিদ্যাপতি তুলনামূলক আলোচনা কর।
উত্তর : প্রাক্ চৈতন্যযুগের দুটি প্রতিভাধর বৈষ্ণব কবি হলেন চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতি। দুজনেই প্রায় সমকালে আবির্ভূত হয়েছিলেন তবে দু'জনের জীবন পরিবেশ ছিল স্বতন্ত্র। বিদ্যাপতি মিথিলার রাজসভার কবি আর চণ্ডীদাস গ্রামবাংলার বাশুলী মন্দিরের দরিদ্র পুজারী। এই বিদ্যাপতির কাব্যে আছে রাজসভার ঐশ্বর্য্য অন্যদিকে চণ্ডীদাসের কাব্যে আছে গ্রামীণ সুরের মূর্ছনা। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলাকে বিদ্যাপতি বর্ণনা করেছেন কৃত্রিম ব্রজবুলী ভাষায়। আর চণ্ডীদাস বর্ণনা করেছেন সহজ সরল বাংলা ভাষায় ।
বিদ্যাপতি ও চণ্ডদীসের তুলনামূলক আলোচনাটি আমরা এইভাবে করতে পারি—
এক।। বিদ্যাপতি বয়ঃসন্ধি মাথুর ভাব সম্মিলিত প্রার্থনা বিষয়ক পদ রচনাতে দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন।অন্যদিকে, চণ্ডীদাস পূর্বরাগ আক্ষেপ অনুরাগ নিবেদন পর্বের পদ রচনাতে অসাধারণ দক্ষতার নিদর্শন রেখেছেন।
দুই।। বিদ্যাপতির রাধার যখন যৌবন স্বপ্ন, দেহ লীলার চঞ্চলতা—
“খনে খনে নয়ন কোন অনুসরই।
খনে খনে বসন খুলি তনু ভরই।।”
অন্যদিকে, চণ্ডীদাসের রাধা তখন যোগীনির ধ্যানে ব্যস্ত-
“বিরতি আহারে
রাঙ্গা বাসপরে
যে মতো যোগিনী পাড়া। ”
তিন।। চণ্ডীদাসের রাধায় মিলনেও সুখ নেই। কৃষ্ণ প্রেমের জ্বালা সর্বদা তাকে বুকে করে নিয়ে বেড়াতে হয়। রাধা বলে-
“কি মোহিনী জান বঁধু কি মোহিনী জান
অবলার প্রাণ নিতে নাহিতমা হেন।।”
অন্যদিকে, বিদ্যাপতির রাধা প্রেমে সর্বদায় যেন নবীনা।
চার।। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন—
বিদ্যাপতির কবিতা স্বর্ণহার, চণ্ডীদাসের কবিতায় রুদ্রমালা, বিদ্যাপতির গান মুরজবিনা,সঙ্গিনী শৃকণ্ঠ গীতি, চণ্ডীদাসের গান সায়াহ্ন সমীরণের দীর্ঘ নিশ্বাস।
৮.বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চন্ডীদাস সমস্যা একটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা আলোচনা কর।
উত্তর : চণ্ডীদাস লোকপ্রিয় কবি তাই চণ্ডীদাসের ভণিতাতে অনেক ব্যক্তিই পদ রচনা করে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে চেয়েছিলেন, যার জন্যে বাংলা বৈষ্ণবপদে বিভিন্ন চণ্ডীদাসের ভগিতায় বহু পদ দেখতে পাওয়া যায় যেমন—বড়ু চণ্ডীদাস, চণ্ডীদাস,দ্বিজচণ্ডীদাস, তরুণীরমন চণ্ডীদাস, দীনহীন চণ্ডীদাস প্রভৃতি। এখন প্রশ্ন হল এই চণ্ডীদাস ভণিতাযুক্ত পদগুলি কি একই চণ্ডীদাস বা ভিন্ন চণ্ডীদাসের এই নিয়ে বাংলা সাহিত্যে যে গুরুতর বিতর্ক দেখা দিয়েছে তাই চণ্ডীদাস সমস্যা নামে অভিহিত।
চণ্ডীদাস সমস্যা তীব্র হয়ে ওঠে বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন আবিষ্কৃত হবার পরে।সকলের মনেই প্রশ্ন জাগে বড়ু চণ্ডীদাস ও চণ্ডীদাস কি একই ব্যক্তি? তাঁরা কি প্রাকচৈতন্য যুগের না চৈতন্য যুগের ? বড়ু চণ্ডীদাস ও পদাবলীর চণ্ডীদাস মূলত কোন সময়ে আবির্ভূত হন? এইসব সমস্যাকে কেন্দ্র করেই চণ্ডীদাস সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।
এখনো পর্যন্ত গবেষকরা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা থেকে জানা যায় যে বড়ু চণ্ডীদাস ও পদাবলীর চণ্ডীদাস ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি কারণ বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাহিনীমূলক কিন্তু পদাবলীর চণ্ডীদাসের পদ কাহিনীমূলক নয় গীতিকবিতা ধরনের কবিতা। বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে আদিরসের প্রাধান্য কিন্তু পদাবলীর চণ্ডীদাসে দেহ ভাবনাহীন প্রেমের চামেলির লাবণ্য বিলাস প্রকাশিত হয়েছে। বড়ু চণ্ডীদাস এবং পদাবলীর চণ্ডীদাস যদি একই ব্যক্তি হতেন তবে এই আদর্শগত প্রভেদ থাকত না। সুতরাং সিদ্ধান্ত করা যায় বড়ু চণ্ডীদাস ও পদাবলীর চণ্ডীদাস পৃথক পৃথক ব্যক্তি।
কেউ কেউ মনে করেন বড়ু চণ্ডীদাস প্রাক চৈতন্য পর্বের কবি আর পদাবলীর চণ্ডীদাস চৈতন্য সম-সাময়িক কবি। এই দুজনের কাল-নির্ণয় সমস্যার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন পণ্ডিত ব্যক্তির আলোচনা থেকে বলা যায় লিপিকারদের বিচারে বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন চৈতন্য পূর্ববর্তী এবং এর ভাষাও তাই আদি মধ্যযুগের।পদাবলীর চণ্ডীদাসের পদ চৈতন্যদেব আস্বাদন করতেন তা চৈতন্যজীবনী গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে তাছাড়া গৌড়ীয় বৈষ্ণবদর্শন, প্রেমদর্শন পদাবলীর চণ্ডীদাসের পদে প্রকাশিত হয়েছে। তাই পদাবলীর চণ্ডীদাস চৈতন্য সমসাময়িক। সুতরাং বড়ু চণ্ডীদাস ও পদাবলীর চণ্ডীদাস পৃথক ব্যক্তি। পদাবলী রচয়িতারা ভিন্ন ভিন্ন ভণিতায় পদ রচনা করেছেন তা চণ্ডীদাস সমস্যা সৃষ্টি করেছে, পদাবলীর চণ্ডীদাসের পদগুলি উৎকৃষ্ট কিন্তু দীন চণ্ডীদাসের পদগুলি উৎকৃষ্ট নয়। এই থেকেও মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে এই চণ্ডীদাসেরা কি একই ব্যক্তি? এ প্রশ্নের সমাধান আজও পর্যন্ত হয়নি।
৯.জ্ঞানদাসকে চন্ডীদাসের ভাবছিস বলা হয় যুক্তিসহ বুঝিয়ে দাও।
✍️ প্রশ্নের মান-১০:
১. শাক্ত পদাবলীর কবি কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের কবি কৃতিত্ব আলোচনা কর।
উঃ উত্তর : শাক্ত পদাবলীর কবি কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের কবিকৃতিত্ব : অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে বেশ কয়েকজন শাক্ত পদকার পদ রচনা করে শাক্ত গীতি সাহিত্য ও শাক্ত সাধনাকে জনপ্রিয় করেছিলেন ততে সন্দেহ নেই। এর মধ্যে একনিষ্ঠ ভক্ত এবং পদকার হিসেবে কমলাকান্তের নাম সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণযোগ্য।
বাংলা শাক্ত পদসাহিত্যে যিনি কবি ও সাধক রামপ্রসাদের তুল্য গৌরব লাভ করেছিলেন, তিনি হলেন এই কমলাকান্ত ভট্টাচার্য (বন্দ্যোপাধ্যায়)। রামপ্রসাদের মতোই তাঁর জীবনকে কেন্দ্র করে নানা অলৌকিক গল্প প্রচলিত হয়েছিল। সাধন মার্গেও তিনি রামপ্রসাদের মতো সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। অবশ্য কবিরঞ্জনের অধিকতর জনপ্রিয়তার ফলে কমলাকান্তের খ্যাতি কিছু সংকুচিত হয়েছিল। যদিও তাঁর অনেক শাক্ত পদ কাব্যগুণে রামপ্রসাদ অপেক্ষা কোন দিক দিয়ে ন্যূন নয়। বর্ধমান রাজবংশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল বলে তাঁর তিরোধানের পর বর্ধমানের রাজের উদ্যোগে জীবনীসহ তাঁর সমগ্র পদাবলী মুদ্রিত হয়েছিল। ১৯২০ সালে কমলাকান্তের জীবনীকার অতুলচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এর লেখায় কবির জন্মস্থান, জীবনকথা ও সাধন স্থান সম্বন্ধে যে তথ্য পাওয়া যায়, তাতেই সহজেই অনুমেয়, ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়-তৃতীয় দশকে পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন। আবার জীবিতকালে মহাসাধক বলে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
কবি যে প্রথম জীবনে বৈষ্ণব ধর্মের অনুরক্ত ছিলেন তাঁর সাধকরঞ্জন গ্রন্থটি পাঠ করলে তা সহজেই অনুমান করা যায়। কবি এই বৈষ্ণব ভাবের রসে অনেকগুলি বৈষ্ণব পদ রচনা করলেও অধিকাংশ বৈষ্ণব পদই কবিত্ব বর্জিত, শুধু গৌরচন্দ্রিকার পদে কিঞ্চিৎ প্রতিভার পরিচয় মেলে। যাইহোক, কমলাকান্তের ভণিতায় প্রায় তিনশত শাক্তপদ পাওয়া যায়, তার মধ্যে আগমনী ও বিজয়ার গান অতি উৎকৃষ্ট, তাতে মাতৃহৃদয়ের বেদনা আশা আকাঙ্ক্ষা কবি খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছেন। সাধক রামপ্রসাদ শাক্ত পদ রচনায় খ্যাতির শীর্ষস্থানে অবস্থান করলেও কমলাকান্তের মতো আগমনী বিজয়ার পদ রচনায় সফল হননি।
প্রতিটি বাঙালি বৎসরে একবার দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে নানা আনন্দে মেতে ওঠেন। তাঁদের ধারণা, বৎসরে একবার ঘরের কন্যা উমা পিত্রালয়ে আসেন, মাতা মেনকা শোক তাপ জর্জর চিত্তে কন্যা উমাকে কাছে পেয়ে চারদিনের জন্যে আনন্দের সাগরে নিমগ্ন হয়ে পড়েন। চারিদিকে হাসি আর খুশীর লহরী, পাড়া পড়শীরা ছুটে আসে কন্যা উমাকে দেখতে, বিয়ে হওয়ার পর উমা কেমন আছে, তা জানতে। তবে এ শুধু উমাকে কেন্দ্র করে একটি মাত্র কল্পিত চিত্র হয়েই থেমে থাকেনি। বাঙালির গার্হস্থ্য জীবনে বাবা মায়েরা যেসব কন্যাদের পাত্রস্থ করেছিলেন এই দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে শ্বশুর বাড়ি থেকে সেইসব কন্যাদের পিত্রালয়ে আনতে উন্মুখ হয়ে ওঠেন। সব মিলিয়ে দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে বাঙালির প্রতি ঘরে ঘরে এই পূজার কয়দিন সুখের চিত্র বিরাজ করতে থাকে। তবে স্মরণ রাখতে হবে বৎসরান্তে ঘরে কন্যা উমা যে একবার পিত্রালয়ে আসে তার জন্য সারা বৎসর ধরে মাতা মেনকা কন্যার জন্য কম অনুতাপ সহ্য করেননি। মাতার এই তাপ জর্জর হৃদয়ের অভিব্যক্তির সন্ধান পদকার কমলাকান্ত খুব নিপুণ ও সুচারুভাবে তাঁর লেখনীর মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন। আর এখানেই কমলাকান্তের শ্রেষ্ঠত্ব।
তাই বলা যায়, বাংলা শাক্ত সাহিত্যে বহু সাধক, ভক্ত ও কবির আবির্ভাব হয়েছে,তাঁদের রচিত শ্যামাসঙ্গীতের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। কিন্তু কমলাকান্ত এই বিপুল আয়তন পদসাহিত্যের মধ্যেও আপন স্বাতন্ত্র্য্য রক্ষা করেছেন। রামপ্রসাদের কবিত্ব ও সাধকত্ব এক সূত্রে মিলে গিয়েছে, তাই তাঁর বাণী মূর্তি অনেক সময় নিরাভরণ চলতি গ্রাম জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। কিন্তু কমলাকান্তের পদে সচেতন রচনা শক্তির মার্জিত বাকরীতি অধিকতর প্রাধান্য পেয়েছে। রামপ্রসাদের গান সুরের আশ্রয় না পেলে যেন দাঁড়াতে পারে না, কিন্তু কমলাকান্তের গানের অনেক স্থানে বিশুদ্ধ লিরিক রূপটি রক্ষিত হয়েছে—তাঁর পদ গান না করলেও চলে, শুধু পাঠে বা আবৃত্তিতে এর রস ধরা পড়ে।
তাই সমালোচক ড. অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায় বলতে হয় 'ভবিষ্যতে বাঙালির মনোভঙ্গীর কোন উৎকট পরিবর্তন যদি না হয় তাহলে কমলাকান্ত যে স্বমহিমায় চিরদিন প্রতিষ্ঠিত থাকবেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।’
২. চন্ডীমঙ্গলের কবি হিসেবে মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কৃতিত্ব নিরূপণ কর।
৩.চর্যাপদের বর্ণিত তৎকালীন সমাজ জীবন ও সাহিত্যমূল্য আলোচনা কর।
উত্তর : সাহিত্য সমাজের দর্পণ। কবিরা সমাজবদ্ধ জীব, তাই তাদের জগৎ বা অজ্ঞাতসারে সমাজ তাদের সাহিত্যে ছায়া ফেলবেই। চর্যাকবিরা আধ্যাত্মবোধ প্রকাশে অত্যন্ত সচেতনভাবে তাদের দৃষ্ট সমাজের অসংখ্য তথ্য ব্যবহার করেছেন। বৃহত্তর বঙ্গের পটভূমিকায় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বাঙালির সমাজজীবন, গৃহজীবন ও পারিবারিক জীবনের বাস্তব চিত্রে চর্যাপদ পূর্ণ। সেকালের মানুষের জীবন-জীবিকা, খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান, আমোদ-প্রমোদ, প্রেম-ভালোবাসা, রীতি-নীতি, আচার-ব্যবহার, চাল-চলন, পোশাক-পরিচ্ছদ, কথাবার্তা কী নেই চর্যাগীতিতে? সেই দিক দিয়ে চর্যাগীতি রত্নগর্ভা অজন্তা। সেকালের দরিদ্র, অবহেলিত, পরিত্যক্ত, ডোম, ব্যাধ, শবর প্রভৃতি জাতির একটি পরিপূর্ণ জীবনচিত্রে চর্যাগীতি আকর্ষণীয়। চর্যাগীতিতে প্রতিফলিত সমাজচিত্রের উপাদানগুলি নিম্নে আলোচিত হলো—
৷৷ এক ৷৷ ভৌগোলিক পরিবেশ :
চর্যাগীতি মূলত বাংলাদেশের বৌদ্ধ সাধকদের সাধন সঙ্গীত। তাই তাদের রচনায় উপমান ব্যবহারে বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিবেশ প্রকৃতির প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এই ভৌগোলিক প্রকৃতির মধ্যে আবার প্রাধান্য অনুসারে নাব্য ভূ-প্রকৃতি সর্বাগ্রে গণ্য। নদীমাতৃক-সমুদ্র, নদী, খাল, বিলে বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেক বেশি উর্বরা। পরমার্থ সাধনার ক্ষেত্রে নদী ও সমুদ্রের রূপক অবশ্য ভারতীয় ভক্তি সাহিত্যে বহুদিন থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু নদী, খাল, নৌকা চালনা ও সাঁকো নির্মাণের রূপক চর্যাকারীরা যত ব্যাপকরূপে ব্যবহার করেছেন তার তুলনা অন্য কোথাও নেই। এছাড়া চর্যাপদের বিভিন্ন পদে সাঁকো, নৌকা প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার নদীমাতৃক বাংলাদেশের কথা এবং নাব্য ভূ-প্রকৃতির কথা মনে করিয়ে দেয়।
৷৷ দুই ৷৷ সমাজসংস্থান :
চর্যাপদগুলি যে সময় রচিত হয়েছিল সেসময় বাংলাদেশে সেন রাজবংশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত। সেন বংশের পূর্বেকার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পালবংশীয় রাজারা ধর্ম ও সামাজিক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কিছুটা উদারনৈতিক ছিলেন। নিজেরা বৌদ্ধ হলেও ব্রাহ্মণ্য ধর্ম সম্পর্কে তাদের কোন অসহিষ্ণুতার প্রমাণ ইতিহাসে নেই। কিন্তু ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী সেন রাজগণ পরধর্ম সম্পর্কে বেশ অসহিষ্ণু ছিলেন। তাদের আমলে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রভাব ও ব্রাহ্মণ্য বর্ণাশ্রম প্রথা অনুযায়ী সামাজিক স্তর বিভাগের রীতি বিশেষ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। এই বর্ণানুযায়ী সমাজব্যবস্থার বেদাশ্রিত জনগোষ্ঠী ছিল অভিজাত এবং বেদধর্ম এবং বেদাচার বহির্ভূত জনগোষ্ঠী ছিল অন্ত্যজ ও অস্পৃশ্য। অভিজাত সমাজ ও অনভিজাত সমাজ পারস্পরিক জুগুপ্সা ও বিরূপতা পোষণ করত। চর্যাকারীগণ ছিলেন তান্ত্রিক বৌদ্ধ—এই কারণে চর্যাগীতির রচয়িতারা ডোম্বি, কামলি, শবর প্রভৃতি অন্ত্যজ শ্রেণির ব্যক্তি এবং চর্যাগীতির পাত্রপাত্রীগণ ডোম, চণ্ডাল, কুন্তি, শবর, ব্যাধ,জেলে প্রভৃতি অস্পৃশ্য শ্রেণিভুক্ত। সমাজের অভিজাত উচ্চ বর্ণের মানুষ যে নিম্নবর্ণের মানুষ সম্পর্কে একধরনের বিরূপতা পোষণ করতেন তারই ইঙ্গিত পাওয়া যায় কাহ্নপাদের একটি চর্যাগীতিতে-
“নগর বাহিরি রে ডোম্বি তোহোরি কুড়িআ।
ছোই ছোই জাসি বাম্হণ নাড়িআ।।”
।। তিন ৷৷ বাসস্থান :
সেকালের উচ্চবর্ণের লোকেরা গ্রামীণ সমতলভূমিতে বাস করত। কিন্তু ডোম,শবর, ব্যাধ, চণ্ডালেরা গ্রাম সীমান্তে পাহাড়ের বুকে বা উঁচু টিলার ওপর ছোট ছোট কুঁড়েতে বাস করত। চর্যায় আছে—
ক. “টালত মোর ঘর নাহি, পড়বেষী।”
খ. “উঁচা উঁচা পাবত তহিঁ বসই সবরী বালী।”
গ. “নগর বাহিরি রে ডোম্বি তোহরি কুড়িআ।”
।। চার ।। জীবিকা :
চর্যাপদের পদকারগণ সমাজজীবনের নানাদিক থেকে উপেক্ষিত মানুষগুলির নানা জীবিকা বা বৃত্তির কথা বলেছেন।যেমন—(ক) মাঝি-নৌকা চালানো, (খ) শবর বা ব্যাধ-শিকার করা,(গ) ডোম—চাঙাড়ি তৈরি করা, (ঘ) তাঁতি—তাঁত বোনানো, (ঙ) ধুনারি-তুলা ধুনা, (চ) শুঁড়ি—মদ চোয়ানো, (ছ) কাঠুরিয়া—গাছ কাটা বা ফাড়া এছাড়াও জলদস্যুর কথা, ব্রাহ্মণের কথা, চৌর্য বৃত্তির কথা, ধীবরদের কথাও আছে।
।। পাঁচ ।। বেশভূষা :
চর্যাপদে যাদের কথা তুলে ধরা হয়েছে তাদের বেশভূষার পরিচয় সবিস্তারে উল্লেখিত হয়নি। তবে শবর কন্যারা মাথায় ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জার মালা, কানে কুন্তল বা কানেট, পায়ে ঘণ্টা নেয়ুর বা নুপুর পরিধান করত। সোনা ও রপার প্রচলন ছিল অত্যন্ত উঁচু সমাজে। এছাড়াও তখনকার যোগীরা হাড়ের মালা পড়ত।
৷৷ ছয় ।। আসবাবপত্র :
চর্যাপদ শ্রমজীবিদের চিত্রে পূর্ণ। তাই তাদের ব্যবহৃত আসবাবপত্র খুব সাধারণ ছিল। যেমন—ভাতের হাঁড়ি, দুধ দুইবার পিটা, মদ রাখবার ঘড়া, নানাকার্যে ব্যবহৃত ঘড়লি বা গাড়ু, বসবার জন্য ব্যবহৃত পিড়ি প্রভৃতি। এছাড়া অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে কুঠার ও টাঙ্গি, রান্না করবার খুন্তি, ঘরদোর রক্ষা করবার জন্য কোঞ্চাভাল (তালাচাবি), জলসেচের সেগুতি ও নদী পারাপারের জন্য নৌকার ব্যবহার ছিল।
৷৷ সাত ৷৷ খাদ্যদ্রব্য ও ফলমূল :
চর্যাপদে প্রধান খাদ্যরূপে ভাতের কথা আছে। এছাড়াও শিকার থেকে পাওয়া মাংসের কথা, গোরুর দুধের কথা চর্যাপদ থেকে পাওয়া যায়। ফলের মধ্যে তেঁতুল ও কম্বুচিনার কথা চর্যাপদে আছে। তবে কম্বুচিনা কি ফল ছিল তা জানা যায় না। তবে এ ফল পাকলে শবর-শবরীরা আনন্দে মেতে উঠত একথা আমরা চর্যাপদ থেকে জানতে পারি।
।। আট ।। পশুপাখি ও জীবজন্তু :
গোরু গৃহে পালিত হত। মাংসের জন্য হরিণ শিকার করা হত। এছাড়াও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে ইঁদুর, সাপ, খরগোশ, হাতি, শিয়াল ও সিংহের কথা উল্লেখ আছে। পাখির মধ্যে ময়ূর ও কাকের কথা চর্যাপদ থেকে জানতে পারি।
।। নয় ।। আমোদ-প্রমোদ ও উৎসব অনুষ্ঠান :
চর্যাপদের মানুষগুলি দরিদ্র ছিল। কিন্তু তাদের দারিদ্র্যপীড়িত জীবনে উৎসব অনুষ্ঠান লেগেই থাকত। অবসর বিনোদনের অন্যতম উপায় ছিল, নয়বল (দাবাখেলা)।তাদের সমাজে তৎকালীন সময়েও নৃত্যগীতেরও বেশ চল ছিল। নাচে-গানে কোন কোন ডোম রমণী পটু ছিল। সেকালে বুদ্ধ নাটক অনুষ্ঠিত হত। সতেরো নং চর্যায় আছে—
“নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী
বুদ্ধ নাটক বিসমা হোই”
এরকম নাট্যানুষ্ঠানে স্ত্রী লোকেরা নর্তকীর ও পুরুষ লোকেরা গায়কের ভূমিকা পালন করত। এই নাট্যানুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে হেরুকবিনা, পটহ, মাদল, ডমরু, ঢোল, কাশি, দুন্দুভি, ডোঙ্গরী প্রভৃতির ব্যবহার ছিল। নাট্যানুষ্ঠানের পরে সবাই মদ্যপান করত কিংবা কপ্পুর দেওয়া পান কম্বুচিনা খেত।
।। দশ ।। সমাজিক সম্পর্ক :
সংস্কার বিশ্বাস প্রথা, বিবাহরীতি : স্বামী, স্ত্রী, শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ, শ্যালিকা নিয়ে পরিবার পূর্ণ থাকত। বিয়েতে যৌতুক নেওয়া হত। শাখা প্রথা প্রচলিত ছিল। দিনের বেলায় বউ ভয়ে বেরোতে পারত না। রাত্রিবেলায় সেই বউ উচ্চবর্ণের পুরুষদের সঙ্গে মিলিত হতে যেত। যাওয়ার সময় তারা শ্বশুর-শাশুড়িকে বাইরে থেকে তালাবন্ধ করে রাখত। মানুষ মারা গেলে সৎকার করা হত।
আলোচনার সমাপ্তিতে এসে বলতে পারি ধর্মের আঁধার হিসাবে চর্যাপদ লেখা হলেও তা আজ থেকে হাজার বছর আগেকার বাস্তব সমাজের নানা তথ্যে পূর্ণ। যা সেকালের সামাজিক ইতিহাস রচনায় উল্লেখযোগ্য দলিল।
৪. শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য অবলম্বনে তৎকালীন সমাজ চিত্রের পরিচয় দাও।
উত্তর : সাহিত্য সমাজের দর্পণ। সাহিত্যিক চান বা না চান, যেহেতু তিনি সমাজিক মানুষ, তাই তাঁর সাহিত্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সামাজিক চিন্তা চৈতন্যের প্রকাশ ঘটবেই। আর যে সাহিত্য আখ্যানধর্মী যা গল্প রসের যোগানদার, সে রকম রচনায় সমাজ না এসে পারে না। বড়ুচণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্যে তেমনিভাবে আদি মধ্যযুগের সমাজ চিত্রিত।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে সমাজ জীবনের যেসব চিত্র পাই, সেগুলি হোল-
রাষ্ট্রব্যবস্থা ঃ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে প্রধানত গোপল্লীর সমাজই চিত্রিত। কোথাও গ্রাম্য সমাজ ছাড়া জমিদার তন্ত্রের পরিচয় নেই। তবে দেশে একজন রাজা ছিল এবং তার কাছে অন্যায় অভিযোগ জানানো যেত। আর রাজাও যথাযথ ব্যবস্থা নিতেন তা রাধাব নানা উক্তিতেই বোঝা যায়। কৃষ্ণ যখন রাধাকে বলাৎকারে উদ্যত হয়। তখন রাধা রাজাকংসের ভয় দেখায় এই বলে,-
‘শুনিলেঁ কংস মরিআঁ জাইবি আপন করম দোষে।” সেকালে রাজাদের নিযুক্ত বিভিন্ন শুল্ক আদায়কারী রাজপুরুষ থাকতো। সেকালে বিনিময়ের মাধ্যম ছিল ‘কড়ি’।
বৃত্তি বা জীবিকাঃ ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন' কাব্যে সেকালে মানুষের নানা বৃত্তি বা জীবিকার নামমাত্র পরিচয় আছে। সেকালে বৃত্তি অনুসারেই জাতি গড়ে উঠেছিল। যেমন-গোপ, তৈলী, নাপিত, কুমোর, বৈদ্য, বেদে, মাঝি, বেনে, স্বর্ণকার, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় শূদ্র ইত্যাদি। গোপ জাতিদের কাজ গোপালন ও দুধ, দই, ঘোল, ঘৃ বিক্রি করা। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যটাই এই গোপ জাতিকে নিয়ে লেখা। পড়লেই বোঝা যায় পুরুষেরা গো পালন করতো। গোষ্ঠে ও বনে গরু চরাতো (যেমনটা কৃষ্ণ ও আয়ান করতো)। মেয়েরা দুধ,দুই হাটে বিক্রি করতে যেতো (যেমনটা রাধা ও গোপিনীরা করেছে।)
বেশভূষা ও পোষাক পরিচ্ছদ : শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন' কাব্যে প্রধান ভাবে দরিদ্র গোপপল্লীর কথা পাই। তবে কোনো কোনো সচ্ছল গোপ পরিবারের কথাও আছে।মেয়েরা অলংকার পরত। তাই দেখি গোপ বধূ রাধা সোনার চুপড়ি ও রুপার খড়ী পরেছে। গলায় গজমতি বা সাতেব্ররী হার পরেছে, কানে রত্ন কুন্ডল পরেছে। হাতেরত্ন জড়িত বলয় কিম্বা কঙ্কণ কিম্বা কেউর অথবা চুড়ি-কিছু না কিছু একটা পরেছে।সেকালের মেয়েরা পায়ে নূপুর বা মল পরতো, পায়ের আঙ্গুলে পাসলী বা কটিতে কিঙ্কিণী পরতো। মালা তৈরি হত মালতী, গুলাল, চাঁপা প্রভৃতি ফুল দিয়ে। বিবাহিত মেয়েরা সিঁদুর ও লোহা পরতো। কপালে কুসুম চন্দন দিতো, চোখে কাজল দিতো।কাব্যে রাধার বসন বা শাড়ীর উল্লেখ আছে সেই শাড়ী রেশম বা পাটের তৈরী। কৃষ্ণ নানা রকম অলংকার পরেছে। কৃষ্ণ ষোল হাত ‘পাটলে'র বস্ত্র পরতো। কোনো কোনো পুরুষ লম্বা চুল রাখতো।
খাদ্যদ্রব্য : ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্যে খাদ্য দ্রব্যের বিশেষ উল্লেখ নেই। প্রায় সর্বত্রই দুধ, দই, ঘোল এই তিনটি জিনিসেরই উল্লেখ আছে। বংশীখণ্ডে রাধার এলোমেলো রন্ধনের মধ্যেও অনেকগুলি খাদ্য দ্রব্যের নাম মেলে। যেমন চাল চড়িয়ে ভাত,নিমঝোল, অম্বল, শাক, পরলা (পরল) ভাজা প্রভৃতি। এছাড়া আনন্দ বিনোদনের সময় লোকে গুয়া (সুপারি) ও পান খেতো,কর্পূর ব্যবহার করতো। এছাড়া আছে লেবু, শাকর(চিনি) -এর উল্লেখ।
আসবাব পত্র : ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্যে আসবাবপত্রের তেমন উল্লেখ নেই। তবে কাব্যে উল্লেখ আছে পালঙ্কের কথা। উল্লেখ আছে তেল বহনের কেড়ুয়া, লাগর বা ভিক্ষাপাত্র প্রভৃতি। তাছাড়া পাই ভাতনাড়ার কাঠি, দুধ নাড়ার কাঠি, ঘটি, ভাণ্ড, চুপড়ী,শিকিয়া (শিকে) বেন্ডুয়া (বিড়ে) ন্যাতা প্রভৃতির নাম। কৃষ্ণের কিছু অস্ত্রশস্ত্রের নাম আছে, যেমন— কৃপান, ত্রিশূল, কামান, বান, শর,ধনু। এছাড়া লাঠি (লগুড়) র উল্লেখ আছে।
সামাজিক সংস্কার-বিশ্বাস : ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' মধ্য যুগের কাব্য । তাই মধ্যযুগীয় নানা সংস্কার বিশ্বাসে কাব্যটি পূর্ণ। বিবাহ বা প্রণয় ঘটিত ব্যাপারে লোকে কর্পূর বা তাম্বুল পাঠাত। নানা কুসংস্কার গোটা মধ্যযুগজুড়েই ছিল। হাঁচি, টিকটিকি, কাকের ডাক, শূন্য কলসী, ডাল বা বাম (শয়ালী) তেলি বা ভিখারী দর্শন, শকুন বা যোগী দর্শন সেগুলি সবই ছিল অমঙ্গল সূচক। সেযুগের মানুষের জৈব নির্ভরতা ধরা পড়েছে রাধার এই উক্তিতে,
“ললাট লিখিত খণ্ডন না জাএ।
না ছাড় নান্দের গোত্র।।”
পারিবারিক ও সামাজিক শাসন এবং সামাজিক জীবনের আদর্শঃ ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ গ্রামীন সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা। শাশুড়ী ছিল বাড়ির প্রধান। তার দাপটে বাড়ির বৌ ঘরের বাইরে যেতে পারতো না। রাধা বলেছে, “আষার শাশুড়ী বজয়ি বড় খরতর সব মন রাখে মোরে ঘরের ভিতর।”
কিন্তু এই শাশুড়ী বা পরিবারের কেউ সমাজবিধি লঙ্ঘন করলে তাকে এক ঘরে করে রাখা হোত। তার ঘরে অন্ন জল যেতো না।
আমোদ প্রমোদ খেলাধূলা : ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে সেকালের খেলাধূলা বা আমোদ প্রমোদের কিছু বিবরণ পাই। যেমন, কৃষ্ণ গেণ্ডু খেলতো। গেণ্ডু কাঠ বা কাপড়ের টুকরো দিয়ে তৈরি বল। এছাড়া ‘চাঁচড়ী’ ও ‘ মেড়ী' নামক দুটি খেলার উল্লেখ আছে। সেকালে লোকে কর্পূরবাসিত তাম্বুল খেতো। খরতাল বা বাঁশি বাজানোর কথা আছে।
এই ভাবে বড়ুচণ্ডীদাস তাঁর ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্যে সমাজ জীবনের খণ্ড খণ্ড চিত্র উপস্থাপন করেছেন, যা থেকে কবির সমকালের দেশ কাল ও সমাজের বাস্তব চিত্র খুঁজে পাই। তাই সামাজিক ইতিহাস রচনায় শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের' গুরুত্ব অপরিসীম। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' মধ্যযুগীয় বাংলাদেশের একটি সামাজিক দলিল।
পশুপাখি : শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নান পশুপাখির নাম আছে। যেমন—গরু, শাকর,হরিণ, বক, শিয়াল, ময়ূর, কাক, তাম্বাচুর, ছাগল, সাপ, শকুন ইত্যাদি।
বাল্যবিবাহ রীতি : তৎকালীন বাংলাদেশে অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচনার সময় যে বাল্যবিবাহ রীতি বর্তমান ছিল তার প্রমাণ আমরা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কাব্যর মধ্যে রাধার বাল্যবিবাহের ঘটনার মধ্য থেকে পেয়ে থাকি ।
সামাজিক সংস্কার ও বিশ্বাস : শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য গ্রন্থে আমরা মধ্যযুগীয় নানা সামাজিক সংস্কার ও বিশ্বাসের কথা পাই। যেমন-
(ক) কাউকে প্রেম নিবেদন করতে হলে প্রথম প্রেমের উপহার হিসাবে তাম্বুল পাঠানো হত।
(খ) সমকালীন লোক জীবনের লোক বিশ্বাস ছিল—সুতীর্থের তপসা বা স্নান করলে প্রেমের ক্ষেত্রে নারীর আকাঙ্খা চরিতার্থ হয়। এই বিশ্বাসে বসিভূত হয়ে রাধিকাকে রাধাবিরহ অংশে সুতীর্থে স্নাত হতে দেখি।
(গ) তন্ত্র-মন্ত্রে তৎকালীন লোকের বিশ্বাস ছিল—পূণ্যকর্মে লোকে স্বর্গে যায়, নানা সুখ ভোগ করে। পাপ করলে নরকে যায় ও বিস্ময়ে ফল ভোগ করে।
(ঘ) স্ত্রী হত্যাকে সেকালে মহাপাপ বলে মনে করা হত। শতাধিক ব্রাহ্মণ আর অগণিত গরু মারলে যে পাপ হয় স্ত্রী বধ তার থেকে আরও অধিক বড়ো পাপ বলে মনে করা হত।
(ঙ) হাঁচি, টিকটিকি, কাকের ডাক, শূন্য কলসি, তেলি বা ভিখারি দর্শন এগুলি অমঙ্গল অনাচারসূচক বলে মনে করা হত। এছাড়াও চতুর্থীর রাতে জলের মধ্যে চাঁদ দেখা, জলপূর্ণ কলসিতে হাত ঢোকানো, গুরুর আসনে বসা, মাটিতে জল দিয়ে অক্ষর লেখা ও ভাঙা কুলোয় বাতাস খাওয়া-খুবই অশুভ বলে মান্য করা হত।
আলোচনার সমাপ্তিতে এসে বলতে পারি এইসব খন্ড জীবন চিত্রের মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে সমকালীন সমাজজীবনের যেমন পরিচয় পাওয়া যায়, তেমনি বড়ু চণ্ডীদাসের সমাজ চেতনার স্বরূপটিও আমাদের সামনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। তাই সামাজিক ইতিহাস রচনায় শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের গুরুত্ব অপরিসীম। গ্রন্থটি মধ্যযুগীয় বাংলাদেশের একটি সামাজিক দলিল।
৫.ভাগবতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কে তার রচিত কাব্যের নাম কি? অনুবাদ সাহিত্যে তার বিশেষত্ব লেখ।
উত্তর : মধ্যযুগে রামায়ণ ও মহাভারতের অনুবাদের পাশাপাশি শ্ৰীমদ্ভাগবত পুরাণেরও অনুবাদ হয়েছিল। তবে এই ধারার শ্রেষ্ঠ কবি হলেন মালাধার বসু। তাঁর রচিত কাব্যটির নাম 'শ্রীকৃষ্ণবিজয়'। আমরা জানি ‘ভাগবত' বৈষ্ণব সমাজ ও সম্প্রদায়ের উপনিষদ অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। মালাধর বসু সেই ভাগবতের দশম ও একাদশ স্কন্ধ,সরল বাংলায় অনুবাদ করে এদেশে বৈষ্ণবমতের সূচনা করেন।
মূলরচনা ঃ গবেষকদের মতে, অষ্টম শতাব্দীর কাছাকাছি সময় ‘ভাগবত' রচিত হয়েছিল। ‘ভাগবত' গ্রন্থটি বারোটি খন্ডে সম্পূর্ণ। এতে ৩৩২টি অধ্যায় ও ১৮,০০০ শ্লোক বর্তমান। এতে শুধু দশম থেকে দ্বাদশ স্কন্ধে কৃষ্ণের বৃন্দাবন ও পরবর্তী লীলা বর্ণিত। বাকি ৯টি স্কন্ধে কৃষ্ণলীলা বর্হিভূত গল্প, আখ্যান ও তত্ত্বকথা স্থান পেয়েছে।
জীবনী : মালাধরের ব্যক্তি পরিচয় সম্বন্ধে খুব অল্প তথ্য পাওয়া যায়। যা পাওয়া যায় তা থেকে জানা যায় বর্ধমান জেলার জামালপুর থানার অন্তর্গত অধুনা মেমারি রেলস্টেশনের কাছে প্রসিদ্ধ কুলীন গ্রামে কুলীন (বিখ্যাত) কায়স্থ বংশে মালাধরের জন্ম হয়। তিনি তাঁর গ্রন্থে নিজের সম্বন্ধে কিছুই বলেনি। সামান্য তথ্য থেকে যেটুকু উদ্ধার করা যায় তা হল—পিতার নাম ভগীরথ, মাতার নাম ইন্দুমতী, ছেলের নাম সত্যরাজ খাঁ, তাঁর পৌত্র রামানন্দ বসু--চৈতন্যের ভক্ত ও পার্ষদ ছিলেন। মালাধর বসুর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন রাজা বুকনুদ্দিন বরবক শাহ। গৌড়েশ্বর বুকনুদ্দিন বরবক শাহই তাকে গুণরাজ খাঁ খেতাব দিয়েছিলেন। কবি লিখেছেন-
“গৌড়েশ্বর দিলা নাম গুণরাজ খান।”
রচনাকাল : চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের কয়েক বছর আগে তিনি শ্রীকৃষ্ণবিজয়' বা ‘শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল' কাব্যটি রচনা করেন। তাঁর কাব্যটির রচনাকাল সম্বন্ধে কাব্যমধ্যে দুটি ছত্রের উল্লেখ আছে-
“তেরশ পঁচানব্বই শকে গ্রন্থ আরম্ভন।
চতুর্দশ দুই শকে হইল সমাপন। ।”
অর্থাৎ ১৩৯৫ থেকে ১৪০২ শকাব্দের (১৪৭৩-১৪৮০ খ্রিস্টাব্দ) মধ্যে মালাধরবসু এই কাব্য রচনা করে। তবে একটি মাত্র পুঁথিতে এই শ্লোকটির উল্লেখ ছিল। সুতরাং প্রামাণিকতা সন্দেহাতীত। তবে মালাধর বসু যে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পূর্বে কাব্যটি রচনা করেছিলেন এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ।
কাব্য পরিচয় : মালাধর বসুর কাব্যের নাম 'শ্রীকৃষ্ণবিজয়' হলেও কোনো কোনো পুঁথিতে ‘গোবিন্দবিজয়’ বা ‘গোবিন্দমঙ্গল' নামের উল্লেখ আছে। তিনি অনুবাদের ক্ষেত্রে ভাগবতের দশম স্কন্ধ পুরোপুরি অনুবাদ করেছেন এবং একাদশ স্কন্ধে বর্ণিত ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাহিনীর কিছু অংশ তিনি গ্রহণ করেছেন। এছাড়া তিনি ‘ভাগবত” বহির্ভূত বিষ্ণুপুরাণ ও হরিবংশের কাহিনী অনুসরণ করেছেন। এছাড়াও লোকসমাজে প্রচলিত রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়লীলা গ্রন্থমধ্যে স্থান পেয়েছে।মালাধর বসু তাঁর কাব্যকে তিনটি ধারায় বিন্যস্ত করেছেন। যথা—(১) বৃন্দাবন লীলা, (২) মথুরালীলা, (৩) দ্বারকালীলা।
(১) বৃন্দাবন লীলা : ভূ-ভার হরণের জন্য বৈকুণ্ঠের বিষ্ণুর কৃষ্ণরূপে আবির্ভাব থেকে মথুরা যাত্রায় এর সমাপ্তি।
(২) মথুরালীলা : কংস নিধন থেকে দ্বারকায় দূর্গ নির্মাণের উদ্যোগ পর্যন্ত এর বর্ণিত বিষয়।
(৩) দ্বারকালীলা ঃ দ্বারকাপুরী নির্মাণ থেকে কৃষ্ণের তনুত্যাগ প হিনী বর্ণিত।
মালাধর বসুর অনুবাদের বিশেষত্ব :
(ক) তিনি মূল ‘ভাগবতের' হুবহু অনুবাদ করেননি, ভাবানুবাদ বা মর্মানুবাদ করেছেন।
(খ) কৃষ্ণের মাধুর্য লীলার কথা বললেও কৃষ্ণের ঐশ্বর্য রূপ চিত্রায়ণে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।
(গ) ‘ভাগবতের’ বিষয়কে তিনি পয়ার ত্রিপদী ছন্দে সাধারণের হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছেন।
(ঘ) তাঁর কাব্যে কবিত্বময় বর্ণনা কিংবা শিল্প চাতুর্যের প্রকাশ সেই অর্থে নেই। কিন্তু 'সহজ, সরল, নিরলঙ্কৃত ভাষায় কৃষ্ণের ঐশী শক্তির বর্ণনাই ছিল তাঁর মুখ্য পরিকল্পনা।
(ঙ) তাঁর কাব্যে বাঙালীর জীবন ও প্রকৃতির পরিচয় থাকায় কাব্যটি বাঙালীর প্রিয়।বাঙালীর রীতি-নীতি, পারিবারিক-সামাজিক, আচার-অনুষ্ঠান দৈনন্দিন জীবনে বাঙালীর খাদ্য সামগ্রী সবই তাঁর কাব্যে সুন্দরভাবে চিত্রিত।
(চ) কাব্য সমাপ্তিতে কবি যুগ ধর্ম ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন—
“ম্লেচ্ছ জাতি রাজ হব অধৰ্ম্ম পালিব।
জব্ ধন দেখিব তার সব হরিলব।।”
তৎকালীন সমাজে পাঠান শাসনকালে সামাজিক বিশৃঙ্খলা উক্তির মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
রামায়ণ, মহাভারতের তুলনায় ভাগবত অনুবাদ জনপ্রিয় না হওয়ার কারণ ঃ
(১) মূল রামায়ণ বা ভাগবত ছিল উচ্চশ্রেণীর কাব্য। শিল্প গুণে এগুলি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রচনার সমকক্ষতা দাবি করতে পারে। রামায়ণ ও মহাভারত-এর অনুবাদে অনুবাদের গুণ সামান্য প্রতিফলিত হলেও পাঠক শ্রোতাকে সহজে বশীভূত করার মতো কাব্যোৎকর্ষতা সহজেই বর্তেছে। তুলনায় ভাগবত পুরাণ অনেকটাই প্রচারধর্মী কাব্য।দুটি কাব্যের নৈকট্যের দাবি করা যায় না।
(২) রামায়ণ মহাভারতের আবেদন ছিল সর্বজনীন। কোনো সম্প্রদায় বিশেষে ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি। ভাগবত সেই দিক থেকে বিশেষ করে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের গ্রন্থ।
(৩) রামায়ণ অত্যন্ত সহজ সরলভাবে পাঁচালির ঢঙে লেখা। মহাভারত অনেকটা সেইরকম কিন্তু ভাগবত ততটা সহজ সরল বা প্রাণোজ্জ্বল নয়।
(৪) ভাগবত মূলত বীররসাত্মক কাব্য। বীররসাত্মক কাব্যে সেকালে বাঙালীর বিশেষ রূচি ছিল না। মহাভারতে যুদ্ধ বর্ণনার বিবরণ থাকলেও জীবনের বিচিত্র লীলা সে রসে সমৃদ্ধ। অন্যদিকে ভাগবতে শুষ্ক যুদ্ধ বর্ণনার বাহুল্য থাকায় তা জনপ্রিয় না হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ।
৬.রামায়ণের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কে তার আত্মপরিচয় দিয়ে তার কবি প্রতিভা ও জনপ্রিয়তার কারণ সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর : “কৃত্তিবাস কুকীর্তিবাস কবি, এ বঙ্গের অলংকার।”—মাইকেল মধুসূদন দত্ত
কৃত্তিবাস সম্পর্কে মাইকেল মধুসূদন দত্তের এই স্তুতি যথার্থ। তিনি সত্যিই এ বঙ্গের অলংকার। তিনি অনুবাদ সাহিত্যের আদি কবি। সেইজন্যে তিনি বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের পথিকৃত। তাঁর অনুবাদ আমাদের বাঙালী জীবনের ঘরোয়া মর্মস্পর্শী মর্মানুবাদ। তাই তাঁর শ্রীরাম পাঁচালী' আজও বাঙালীর ঘরে ঘরে সমাদৃত হয়।কৃত্তিবাসের রামায়ণ বাঙালী জনসাধারণের নিকট মহান ধর্মগ্রন্থ তথা জাতীয় মহাকাব্য।কথিত আছে, ‘বৈষ্ণব পদাবলী' বাঙালীর মর্মচেতনাকে ভাব স্বর্গের তূরীয় লোকে নিয়ে গেছে। ‘মঙ্গলকাব্য’ তাকে কঠিন মৃত্তিক স্তরে টেনে এনেছে। আর কৃত্তিবাসের 'শ্রীরাম পাঁচালী' তাঁর গৃহজীবনের পরিচিত আদর্শকে মহত্তর মূল্য দিয়েছে।
কৃত্তিবাসের আত্ম পরিচয়/কৃত্তিবাস সমস্যা : কৃত্তিবাস বাংলা সাহিত্যের অতি জটিল সমস্যা। তাঁর রচনাকাল এবং গ্রন্থ বিষয় কোনো সঠিক হদিশ পাওয়া যায় নি। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে কৃত্তিবাসকে নিয়ে যত গবেষণা হয়েছে তার অধিকাংশই তাঁর আত্ম-পরিচয় নিয়ে। নগেন্দ্রনাথ বসু তাঁর 'বঙ্গজাতির ইতিহাস' ও দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর 'বঙ্গ ভাষা ও সাহিত্য' গ্রন্থে কৃত্তিবাসের যে জন্মতত্ত্বগুলি আলোচনা করেছেন, তা হল-(১) কৃত্তিবাসের পূর্বপুরুষ নরসিংহ ওঝা বেদানু রাজার সভাসদ ছিলেন।
(২) মাঘ মাসের শ্রী পঞ্চমী তিথিতে তাঁর জন্ম।
(৩) বিদ্যার্জনের পর গৌড়েশ্বরের সভায় সম্মান লাভ করেন।
(৪) পিতা-মাতা ও গুরুর আদেশে শ্রীরাম পাচালি রচনা করেন।
(৫) তাঁর পিতার নাম বনমালী, মাতার নাম মালিনী।
জ্যোতিষ বিচার : কবি নিজেই বলেছেন—
"আদিত্যবার শ্রী পঞ্চমী পুণ্য (পূর্ণ) মাঘ মাস ।
তথি মধ্যে জন্ম লইলাম কৃত্তিবাস।”
অর্থাৎ কোনো এক মাঘ মাসের শ্রীপঞ্চমী তিথিতে কবির রবিবারে জন্ম। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির জ্যোতিষগণনা অনুসারে ইংরেজী ১৩৩৭, ১৩৯৮, ১৪৪২ প্রভৃতি অনেকগুলি বছরে সম্ভাব্য তালিকায় স্থান পায়।
কুলজী গ্রন্থের সাক্ষ্য : কুলজী গ্রন্থে কুলীনদের বংশতালিকা থেকে দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য বিভিন্ন কুলজী গ্রন্থের সত্যাদি বিশ্লেষণ করে বলেছেন চতুদর্শ শতাব্দীর তৃতীয় পাদের শেষ প্রান্তে কৃত্তিবাসের জন্ম। এর সাথে জ্যোতিষগণনা মিলিয়ে মাঘ মাস,রবিবার এবং শ্রী পঞ্চমী তিথির সাযুজ্য দেখতে পান। ১৩৭২ এবং ১৩৭৫ খ্রিস্টাব্দে। ফলে প্রমাণ হয় যে এগুলি অকৃত্রিম।
বেদানুজ রাজার কাল ধরে : কৃত্তিবাসের আত্ম-বিবরণীতে পাই—“পূর্বেতে আছিল বেদানুজ মহারাজ। তার পাত্র আছিল নরসিংহ ওঝা।।”
দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন যে এই রাজা ত্রয়োদশ শতকের শেষদিকে বর্তমান ছিলেন। কিন্তু কোনো পুঁথি সমর্থিত নয়।
গৌড়েশ্বর প্রসঙ্গ : কৃত্তিবাস আত্ম-বিবরণীতে গৌড় নৃপতিকে সম্মান দেখিয়ে বলেছেন-
“পঞ্চ গৌড় চাপিয়া গৌড়েশ্বর রাজা।
গৌড়েশ্বর পূজা কইলে গুণের হয় পূজা।।”
এই বিবরণ থেকে মনে হয় এই রাজা হিন্দুরাজা। চন্দন, মালা, পট্টবস্ত্রের উপহার ও হিদু রীতি আমাদের গৌড়ের একমাত্র হিন্দু রাজা গণেশের কথাই এ প্রসঙ্গে মনে আসে। ১৪১৮ সাল পর্যন্ত তিনি গৌড়াধিপতি ছিলেন। কৃত্তিবাসের পক্ষে তাঁর সভায় উপস্থিত হওয়া অসম্ভব নয়। জ্যোতিষ হিসাবে কুলজী গ্রন্থের বিচারের সঙ্গে তাতে অসঙ্গতি ঘটে না।
যাইহোক, বহু বিতর্কিত বিষয়টি বিশ্লেষণ করে আমাদের একটি সিন্ধান্তে আসতেই হয়। পরীক্ষাগত অনুমানের উপর যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি বলেন, ১৩৯৮-১৩৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই মাঘ রবিবার শ্রীপঞ্চমী তিথিতে কবির জন্ম। একথা অধিকাংশ গবেষক সমর্থন করেছেন। তবে নিখুঁত সমাধানের চেষ্টা এখনও চলছে।
কৃত্তিবাসের মৌলিকতা ও মূলানুগত্যের পরিচয় : কৃত্তিবাসী রামায়ণ মূল বাল্মীকি রামায়ণের অনুসরণ নয়। বাল্মীকি রামায়ণের সঙ্গে কৃত্তিবাসের রামায়ণ পাঁচালিতে বর্ণিত কাহিনী ও চরিত্রের পার্থক্য যথেষ্ট। মূল কাহিনীতে তিনি পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করে নতুন রূপে পরিবেশন করেছেন। শুধুমাত্র 'বাল্মীকি রামায়ণ' নয়, জৈমিনি ভারত’, ‘অদ্ভুত রামায়ণ', 'দেবীভাগবত', 'মার্কেণ্ডিয় পুরাণ' 'পদ্মাপুরাণ' প্রভৃতি বিখ্যাত মহাকাব্য, পুরাণ ও তত্ত্বগ্রন্থ সমূহ থেকে তিনি উপাদান গ্রহণ করেছেন। কৃত্তিবাস সে সমস্ত কাহিনী পরিত্যাগ করেছেন তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
(ক) কার্তিকের জন্ম
(খ) বশিষ্ট-বিশ্বামিত্র বিরোধ
(গ) বিশ্বামিত্র কথা
(ঘ) অম্বরীশ যজ্ঞ
(ঙ) রামচন্দ্র কর্তৃক আদিত্য হৃদয় স্তব পাঠ
আবার কৃত্তিবাস নিম্নলিখিত কাহিনীগুলি বাল্মীকি রামায়ণ থেকে গ্রহণ করেন নি।সেজন্য ধরে নেওয়া যেতে পারে এই কাহিনীগুলি তার মৌলিক কল্পনা প্রসূত।
কাহিনীগুলি হল—
(১) সৌদাস-দিলীপ-রঘুর কাহিনী।
(২) দশরথের রাজ্যে শনির দৃষ্টি।
(৩) গণেশের জন্ম।
(৪) সম্বরাসুর বধ।
(৫) কৈকেয়ীর বরলাভ।
(৬) গুহকের সঙ্গে মিতালী।
(৭) হনুমান কর্তৃক সূর্যকে কক্ষতলে ধারণ।
(৮) বীরবাহুর যুদ্ধ।
(৯) তরণীসেন—মহীরাবণ - অহিরাবণ কাহিনী।
(১০) রাবণ বধের জন্য রামচন্দ্র কর্তৃক দেবী চন্ডীকার অকালবোধন এবং নীলপদ্মের কাহিনী।
(১১) গণকের ছদ্মবেশে হনুমান কর্তৃক মন্দোদরীর কাছ থেকে রাবণের মৃত্যুবাণ হরণ।
(১২) মুমূর্ষু রাবণের কাছে রামচন্দ্রের রাজনীতি শিক্ষা।
(১৩) দেবর বধূদের অনুরোধে সীতা কর্তৃক খড়ির দ্বারা রাবণের মূর্তি অঙ্কন, তা দেখে রামের মনে সীতার সম্বন্ধে সংশয় সৃষ্টি, যার ফলে সীতা নির্বাসন।
(১৪) লব-কুশের যুদ্ধ ইত্যাদি। যে ঘটনা বাল্মীকি রামায়ণ ছাড়া অন্য সূত্র থেকে নিয়েছেন সেগুলি হল-
আদিকাণ্ড :
(ক) হরিশচন্দ্রের উপাখ্যান – দেবী ভাগবত, মার্কেণ্ডেয় পুরাণ থেকে নিয়েছেন।
(খ) ভগীরথের জন্মবৃত্তান্ত – যোগ বশিষ্ঠ রামায়ণ ও পদ্মাপুরাণ থেকে নেওয়া।
(গ) কান্ডার মুনির উপাখ্যান - স্কন্দ পুরাণের কাশীখণ্ড থেকে নেওয়া।
সুন্দরা কাণ্ড : সেতু বন্ধনের সময় রামের শিব প্রতিষ্ঠার বিবরণ-কুর্ম পুরাণ থেকে সংগৃহীত।
লঙ্কা কাণ্ড :
(ক) চণ্ডিকার অকালবোধনের কাহিনী – কৃত্তিবাস দেবী ভাগবত, বৃহধর্মপুরাণ ও কালিকাপুরাণ থেকে নিয়েছেন।
(খ) গন্ধমাদন পর্বত থেকে বিশল্যকরণী আনার সময়ে হনুমানকে কালনেমির বাধাদানের বৃত্তান্ত অধ্যাত্ম রামায়ণ অনুসরণে লেখা।
উগাকাণ্ড :
লব-কুশের হাতে ভরত, শত্রুঘ্ন ও লক্ষণ পরাজিত ও নিহত হলে তারা যে বাল্মীকি প্রসাদে পূনর্জীবিত হন, এই কাহিনীটি কৃত্তিবাস জৈমিনি ভারত থেকে নিয়েছেন।
অর্থাৎ সুক্ষভাবে বিচার করলে দেখা যায় যে, কৃত্তিবাস বাল্মীকির অনেক কাহিনী ইচ্ছামত পরিবর্তন করে নিয়েছেন। কোথাও বা অন্যান্য পুরাণ থেকে সাহায্য গ্রহণ করেছেন। যেমন—আদি কাজে দস্যু রত্নাকর 'মরা মরা' বলতে বলতে 'রাম নাম' উচ্চারণ করে পাপ মুক্ত হয়েছিলেন। তা বাল্মীকি রামায়ণে নেই। অধ্যাত্ম রামায়ণে',"অযোধ্যা কান্ডে এই কাহিনী পাওয়া যায়। আবার গঙ্গা আনায়ন প্রসঙ্গে কৃত্তিবাস যে কান্ডারমুনির গল্প সন্নিবিশিষ্ট করেছেন তা স্কন্দপুরাণের অন্তর্গত। কাশীখণ্ড থেকে গৃহীত। এ সমস্ত উল্লেখ থেকে দেখা যায়, যে, কৃত্তিবাস কোনো কোনো কাহিনী সম্পূর্ণ কল্পনার দ্বারা সৃষ্টি করেছিলেন। আবার কিছু কিছু কাহিনী পুরাণাদি থেকে সংগৃহীত করেছিলেন। আবার তাঁর অনেক উক্তি সংস্কৃত উদ্ভট কবিতা বা শাস্ত্র পুরাণাদি থেকে সংগৃহীত।
৭.মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কে? তার কবি প্রতিভার পরিচয় দাও।
উত্তর : “মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
হে কাশী, কবি শীশদলে তুমি পুণ্যবান।”
কাশীরাম দাস সম্পর্কে মধুসূদন দত্তের এই উক্তি সার্থক। কেননা, কাশীরাম দাস তাঁর ‘ভারত পাঁচালী' গ্রন্থের মাধ্যমে বাঙালী জাতিকে তাঁর হৃদয়ের সামগ্রী দ্বারা পূণ্যফল বিতরণ করেছিলেন। সমগ্র বাঙালী জাতির হৃদয়, সামাজিক আদর্শ, নীতি ও কর্তব্যকে কৃত্তিবাস ছাড়া আর কোনো কবি এমনভাবে ব্যক্ত করতে পারেন নি। সংস্কৃতের বেড়াজালে আবদ্ধ ভারতকথাকে যিনি সার্থকভাবে বাংলাভাষার খাতে প্রবাহিত করেছিলেন, রাজদরবারের ব্যবহৃত কাব্যকথাকে বঙ্গজনের গৃহাঙ্গণে পৌঁছেছিলেন,জনগণের তৃষ্ণাতুর কণ্ঠ যিনি অমৃতের দ্বারা তৃপ্ত করে দিয়েছিলেন তিনি হলেন বাংলা ভাষায় মহাভারত রচয়িতাদের মধ্যে সর্বাধিক লোককান্ত কবি কাশীরাম দাস।
ব্যক্তি পরিচয় : কাশীরাম দাসের পৈত্রিক পদবী ‘দেব’। ধর্ম বিশ্বাসে বৈষ্ণব ভাবাপন্ন হওয়ায় তিনি দেবের স্থলে বিনয়বশত দাস ব্যবহার করেছেন। কবি নিজের দেওয়া তথ্য এবং অন্যান্য তথ্যাদি থেকে তাঁর ব্যক্তি পরিচয় জানা যায়। তাঁর জন্ম বর্ধমান জেলার ইন্দ্রানী পরগনার সিঙ্গি (সিদ্ধি) গ্রামে কায়স্থ বংশে। তাঁর পিতার নাম কমলাকান্ত। কবিরা তিন ভাই কৃষ্ণদাস, কাশীরাম, গদাধর। কবি তাঁর গুরু অভিরাম মুখার্জীর আশীর্বাদে মহাভারত অনুবাদ করেন। শোনা যায় মেদিনীপুর জেলার আত্রাসগড়ের (আলীগড়) জমিদার বাড়িতে শিক্ষকতা করবার সময় বহু কথক ও পণ্ডিতের মুখে মহাভারত আখ্যান শুনে তাঁর অনুবাদ কর্মের বাসনা জাগে।
কাব্য রচনাকাল : প্রাপ্ত বিভিন্ন পুঁথি অনুযায়ী কাশীরাম দাসের কাব্যের রচনাকাল যথাক্রমে ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দ (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় রক্ষিত পুঁথি) ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দ (সাহিত্য পরিষদে রক্ষিত পুঁথি), ১৬০৪ ও ১৬০২ খ্রিস্টাব্দ (যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির নির্দেশিত) ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দ (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত পুঁথির দ্বিতীয় পত্র)।যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি নির্দেশিত পুঁথিটির একটি শ্লোকে আছে-“চন্দ্রবান পক্ষ ঋতু শক সুনিশ্চয়।
বিরাট হৈল সাঙ্গ কাশীদাস কয়।।”
—এই শ্লোক অনুসারে (১৫২৬ + ৭৮) বা ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দের বিরাট পর্ব সাঙ্গ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। কাশীরাম দাসের মহাভারত রচনার শুরুর ইতিহাস যেমন অজ্ঞাত তেমনি সমাপ্তির ইতিহাসও রহস্যাছন্ন কোনো কোনো পুঁথিতে পাওয়া এমনই শ্লোক-
“আদি সভা বন বিরাটের কতদূর।
ইহা লিখি কাশীদাস গেলা স্বর্গপুর।।”
-এর থেকে অনুমিত হয় যে কাশীরাম দাস আদি সভা বন ও বিরাটের পর্বের কিয়দংশ রচনা করে পরলোকগত হন। এছাড়া প্রাপ্ত অন্যান্য তথ্যের সূত্রমধ্যে হয় কবির ভ্রাতুষ্পুত্র নন্দরাম, জ্যেষ্ঠ পুত্র ঘনশ্যাম ও জামাতা নানা প্রসঙ্গ যোগ করে এই অষ্টাদশ পর্বের মহাভারত সম্পূর্ণ করেন। অর্থাৎ আদি সভা বন ও বিরাট কাশীরাম দাস রচনা করেছিলেন। বিভিন্ন সমালোচকের বলা তথ্যাদি অনুসারে আমরা এই সত্যে উপনীত হতে পারি যে, কাশীদাসীর মহাভারত রচিত হতে শুরু করে ষোড়শ শতাব্দীর শেষদিকে এবং এটি সমাপ্ত হয় সপ্তদশ শতাব্দীর সূচনায়।
মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কাশীরাম দাসের কবি কৃতিত্ব বিচার : শিল্পাদর্শের বিচারে কাশীরাম দাস মধ্যযুগীয় অনুবাদ সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট কবি বলে উচিত মর্যাদা পাবেন। কারণস্বরূপ কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করা যায়—(১) মূল মহাভারতীয় রস ও ধ্বনি ঝংকার যতটা অনুবাদ কাব্যে রক্ষা করা সম্ভব কাশীরাম তাঁর কিছু মাত্র ত্রুটি রাখেননি। ক্লাসিক মহাকাব্য বিশেষত্ব Epic of Art বা পৌরাণিক যুগের মহাকাব্যের রচনায় যেরূপ ঝংকার মুখর শব্দ শৃঙ্খলার প্রয়োজন কাশীরামের কাব্যে সেই জাতীয় অলঙ্কৃত কাব্যকলার অনুসরণ দেখা যায়। কৃষ্ণের বিশ্বরূপ প্রদর্শনের বর্ণনায় তিনি যে ঘনানিগন্ধ বাক-রীতি ব্যবহার করেছেন তা প্রশংসার যোগ্য।
(২) কাশীরাম দাস পণ্ডিত কবি ছিলেন তাই তিনি ব্যাসদেবের মূল সংস্কৃত মহাভারতের বেশ কিছু অংশ গ্রহণ ও বর্জন করে নিজের মতো সাজিয়েছেন। সংস্কৃত মহাভারত ছাড়াও নানা পুরাণ ও উপপুরাণ থেকে কাব্য কাহিনীর উপাদান সংগ্রহ করেছেন। যেমন—শ্রীবৎস চিন্তার উপাখ্যান, পারিজাত হরণ, সত্যভামা তুলাব্রত,রাজসূয় যজ্ঞে বিভীষণের আগমন প্রভৃতি ঘটনা ব্যাসদেবের মহাভারতে নেই। এছাড়াও কাশীরাম দাস নতুন কিছু উপাদান যোগ করেছেন যেমন—বনপর্বের শ্রীক্ষেত্র মাহাত্ম্য,শান্তিপর্বে একাদশী মহাত্ম্য ও হরিমন্দির মার্জনের ফল প্রভৃতি মূল মহাভারতে নেই।
(৩) কাশীরাম দাস অনুবাদের ক্ষেত্রে ভাবানুবাদের রীতিকে গ্রহণ করেছেন।ব্যাসভারত ও জৈমিণি ভারতের কাহিনীর প্রভাবে কাশীরামের নামে প্রচলিত মহাভারতের কাহিনী পর্যায় বিন্যস্ত হয়েছে। কাশীরাম কোথাও আক্ষরিক অনুবাদ করেননি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৌলিক গল্প সন্নিবেশিত করেছেন। যদিও মূল মহাভারতের কাহিনীরস ক্ষুন্ন হয়নি।
(৪) কৃত্তিবাস ও কাশীরাম দাস উভয়ে পাঁচালি রীতি অনুসরণ করলেও কাশীরামের রচনার মধ্যে ভাষা ভুঙ্গিমায় ক্লাসিক তৎসম শব্দের গ্রন্থনৈপুণ্য সপ্রশংস উল্লেখের দাবি রাখে। যেমন—অর্জুনের 'রূপ-বর্ণনা—
“অনুপম তনু শ্যাম নীলোৎপল আভা।
মুখরুচি কত শুচি করিয়াছে শোভা।।
ভুজযুগে নিন্দে নাগ আজানুলম্বিত।
করিকর যুগবর জানু সুবলিত।।”
—কৃষ্ণের বিশ্বরূপ বর্ণনায়ও তিনি তৎসম শব্দ বহুল যে ঘন পিরনগন্ধ বাক্-রীতি ব্যবহার করেছেন তা প্রশংসনীয়।
(৫) কাশীরামের মহাভারতের চরিত্রগুলি বাঙালীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, জীবন চর্যায় ধ্যান ধারণায় মিশে গেছে। তাই ভীষ্ম ও অর্জুন মূল মহাভারতের মতো ক্ষাত্র তেজে দীপ্ত নয়। দ্রৌপদী অনেকটাই কোমলমতি বাঙালী বধূ। সভাপর্বে দ্রৌপদী ও হিড়িম্বার যে কলহ বর্ণিত হয়েছে, তা সপ্তদশ শতাব্দীর বাঙালী সমাজের দুই সতীনের কলহ।
(৬) শিল্প সৃষ্টিতে কাশীরাম দাস অনন্য। মহাভারত অনুবাদকারীদের মধ্যে অদ্বিতীয় ৷দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় কবি কাশীরাম দাস যেভাবে অনুপম ভাষায় অনুপ্রাসেরঝংকারে অন্যান্য অলংকারের সাহায্যে অর্জুনের রূপ বর্ণনা করেছেন তা অনবদ্য—
“দেব দ্বিজ মনসিজ জিনিয়া মুরতি।
পদ্মপত্র যুগ্মনেত্র পরশয়ে শ্রুতি।।”
(৭) মহাভারত প্রধানত বীররসের মহাকাব্য। কিন্তু কবি শুধু বীররসকেই তাঁর কাব্যে পরিস্ফুট করেননি হাস্যরস ও ভক্তিরসে আপ্লুত করেছেন। চৈতন্য প্রভাবিত প্রেমভক্তির প্রভাবে ভক্তিরসের আদর্শ তাঁর কাব্যে প্রতিফলিত হয়েছে। দাস্য ভাবের প্রকাশও তাঁর কাব্যে আছে। সভাপর্বে কৃষ্ণ প্রণতিতে তারি প্রশস্তি বাক্য উচ্চারিত হয়েছে—
“যদি দিবে দেহ এই কৈল নিবেদন।
অনুব্রত বন্দি যেন তোমার চরণ।।”
(৮) তৎকালীন বাঙালির সামাজিক পারিপার্শ্বিক আদর্শকে কবি তুলে ধরেছেন নিপুণতার সঙ্গে। গল্পরস পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি সাধারণ মানুষের জীবনাদর্শকেও তুলে ধরেছেন। অতিথির সেবা, জীবে দয়া, পরোপকার, স্বার্থত্যাগের মহিমা প্রভৃতি তুলে ধরে বাঙালীকে মনুষ্যত্ববোধে উন্নীত করেছেন।
আলোচনার পরিশেষে এসে বলতে পারি, কাশীরাম দাসের ভারত পাঁচালিতে মূল মহাভারতের মহাকাব্যিক গাম্ভীর্য ও চারিত্রিক সমুন্নতি লক্ষ্য করা যায় না সত্য। কিন্তু এই গ্রন্থটি বাঙালি জাতি ও বাংলা সাহিত্যকে যেভাবে প্রেরণা দিচ্ছে তা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। সেদিক দিয়ে এ কাব্যকে বাঙালির জাতীয় কাব্যরূপে চিহ্নিত করতে হয়।প্রসঙ্গতই মনে পড়ে যায় দীনেশচন্দ্র সেনের বলা কথাটি—
“বঙ্গদেশ। এই মহাভারত সমুদ্র হইতে এখনও 'শ্রীকৃষ্ণচরিত, ‘বৈবাতক’, ‘কুরুক্ষেত্র’ ‘চিত্রাঙ্গদা’ প্রভৃতি অসংখ্য বুদবুদ উত্থিত হইয়া প্রাচীন ভাবের অফুরন্ত আবেগ জ্ঞাপন করিতেছে। এই কাব্য লইয়া হিন্দুস্থানের ভাবী অধ্যায়ে আর কত কবি ও বীর চিত্রকর যশস্বী হইবেন কে বলিতে পারে?'
৮.সমাজ ও সাহিত্য জীবনের চৈতন্যদেবের প্রভাব আলোচনা কর।
৯.কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থটি সম্পর্কে যা জানো।
উত্তর : সম্ভবত ১৬১২-১৬১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কৃষ্ণদাস কবিরাজ ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত” কাব্য রচনা সমাপন করেছিলেন। চৈতন্যজীবনী রচনার সূত্র হিসাবে সহায়ক ছিলেন বাসুদেব সার্বভৌম, কৃষ্ণমিশ্র প্রমুখ—যারা চৈতন্যদেবের নীলাচলে অবস্থান প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এছাড়াও পূর্ববর্তী কবিদের রচিত চৈতন্য জীবনী গ্রন্থগুলি সূত্র হিসাবে কাজ করেছিল। অন্যদিকে গৌড়ী ও বৈষ্ণব ধর্মের তত্ত্বাবলি সহজ ভাষায় প্রকাশ করার প্রেরণাও ছিল কার্যকর।
কাব্যগঠন : ‘চৈতন্যচরিতামৃত' গ্রন্থটি তিনটি খণ্ডে বিভক্ত-
(১) আদি লীলা
(২) মধ্য লীলা
(৩) অন্ত্য লীলা
(১) আদি লীলা ঃ আদি লীলায় বৈষ্ণবীয় দর্শন চৈতন্যবতারের প্রয়োজনীয়তা,অদ্বৈত, নিত্যানন্দের সঙ্গে চৈতন্য পরিচয়, বাল্যলীলা, বিদ্যাশিক্ষা, বিবাহ, পিতার মৃত্যুর পর পিণ্ড দানার্থে গয়া গমন পর্যন্ত কাহিনীধারা বিস্তৃত। এই পর্বে তিনি তার পূর্ববর্তী চৈতন্য জীবনীকাব্য রচয়িতা বৃন্দাবন দাসের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। ১৭টি অধ্যায়ে এই পর্বটি বিন্যস্ত।
(২) মধ্য লীলা : মধ্য, লীলা পর্বটি ২৫টি পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত। এখানে সন্ন্যাস গ্রহণের পর থেকে মহাপ্রভুর নীলাচলে অবস্থান পর্যন্ত ৬ বৎসরের জীবন লীলা বিবৃত হয়েছে। এই পর্বে বিভিন্ন দার্শনিক তত্ত্ব ও বৈষ্ণবীয় তত্ত্বকথা বিবৃত হয়েছে।
(৩) অন্ত্য লীলা ঃ অন্ত্যলীলা পর্বে ২০টি অধ্যায়ে চৈতন্য জীবনের ১২ বছরের দিব্যোন্মাদ অবস্থার অপরূপ চিত্র বিবৃত।
কাব্যবিচার :
(ক) একই সঙ্গে চৈতন্য জীবনী এবং ধর্মতত্ত্ব প্রকাশ করার দুঃসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছে গ্রন্থ মধ্যে।
(খ) এই গ্রন্থের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা শুধু ভাব নয় তত্ত্বেরও বাহক হয়ে উঠল।
(গ) এটি চৈতন্যদেবের পূর্ণাঙ্গ ও প্রামাণ্য জীবনী কাব্য ।
(ঘ) কাব্যটির মধ্যে কৃষ্ণদাস কবিরাজের অগাধ পাণ্ডিত্য, ভক্তির শাস্ত্রে নিষ্ঠা ও দার্শনিকতা প্রকাশিত হয়েছে।
(ঙ) এটি শুধু জীবনীকাব্য নয়; বরং এটি সত্ত জীবনী বা Hagiography |
(চ) এই জীবনীকাব্যে পাণ্ডিত্য নত হয়েছে ভক্তির কাছে, জ্ঞান নত হয়েছে বিনয় এবং বিশ্বাসের কাছে। সেই কারণে বৈষ্ণব ধর্মের দূরূহ রাধাতত্ত্ব, কৃষ্ণতত্ত্ব, সাধ্য সাধনতত্ত্ব, সখিতত্ত্ব, অচিন্ত্যভেদাভেদতত্ত্ব, পঞ্চতত্ত্ব, প্রেমবিলাসবিবর্ততত্ত্ব, রাগানুগা ভক্তিতত্ত্ব সমস্তই প্রাঞ্জল হয়ে উঠেছে-
রাধিকা হয়েন কৃষ্ণের প্রণয় বিহার
স্বরূপ শক্তি হ্লাদিনী নাম যাহার
জনপ্রিয়তার কারণ :
কৃষ্ণদাস কবিরাজের 'শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত' গ্রন্থটির জনপ্রিয়তার কারণগুলি হল-
(ক) চৈতন্য জীবনীকাব্যগুলির মধ্যে এটি সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা।
(খ) গ্রন্থ মধ্যে ঐতিহাসিক ঘটনার পাশাপাশি মনোজগতেরও প্রকাশ ঘটেছে।
(গ) কাব্য মধ্যে অবতারত্ব আরোপের চেষ্টা হয়নি। চৈতন্যদেব বড়ো মাপের মানুষ ছিলেন দেবতা ছিলেন না এটাই প্রমাণ করেছেন কৃষ্ণদাস।
(খ) কবি প্রথমে চৈতন্যভাগবত রচয়িতা বৃন্দাবন দাসের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন-
কৃষ্ণলীলা ভাগবতে কহে বেদব্যাস।
চৈতন্যলীলার ব্যাস বৃন্দাবন দাস ।।
(ঙ) কৃষ্ণদাস তাঁর কাব্যে যথার্থ ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ ও ভক্ত কবির আত্মনিবেদিত মনোভাব নিয়ে চৈতন্যদেবকে এমন ভাবে উপস্থাপন করেছেন যা এককথায় অতুলনীয়।
(চ) তত্ত্ব ও তথ্যের সমাবেশ ব্যতীত কবিত্ব শক্তিও তাঁর গ্রন্থটিকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছে। প্রকাশ রীতিতে সারল্য আছে, উপমা, অনুপ্রাস, অলংকার প্রয়োগের দক্ষতা পরিলক্ষিত হয়। যেমন-আপনা আপনা চাহে করিতে আলিঙ্গন।
(ছ) বৈষ্ণবীয় তত্ত্বদর্শনকে তিনি যেভাবে কাব্যরসাশ্রিত করে তুলেছেন তা অনুপম ৷
বৈষ্ণবীয় দর্শনের জটিল তত্ত্ব কৃষ্ণদাসের লেখনীর স্পর্শে সরল হয়ে উঠেছে। যেমন—কাম ও প্রেমের পার্থক্য বিচারে তিনি লিখেছেন—
আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা তারে বলি কাম।
কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা ধরে প্রেম নাম।।
(জ) চৈতন্য জীবনের তত্ত্ব দর্শন ও কবিত্বের দর্শন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে, তাই ড. সুকুমার সেন বলেছেন—চৈতন্যচরিত হিসাবে কি ঐতিহাসিক তত্ত্ব, কী দার্শনিক তত্ত্ব বিচার সবদিক দিয়েই চৈতন্যচরিতামৃত।
১০.বিদ্যাপতি কে ছিলেন? তার কবি প্রতিভার পরিচয় দিয়ে বাংলা সাহিত্যে তার অন্তর্ভূক্তির কারণ লেখো।
উত্তর : মিথিলা রাজবংশের কবি হয়েও বাঙালীর অন্তর্লোকে যিনি সুখ প্রতিষ্ঠিত এবং মহাপ্রভু চৈতন্য থেকে শুরু করে রসিক বাঙালী সমাজ যে কবিকে অন্তরের আত্মীয় রূপে বরণ করেছেন তিনি মৈথিল কোকিল' এবং ‘অভিনব জয়দেব' বিদ্যাপতি।পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন -
“যে গানে তাঁহার খ্যাতি, যে গানে তাঁহার প্রতিপত্তি, যে গানে তিনি জগৎ মুগ্ধ করিযা রাখিয়াছেন, তিনি যদি তাঁহার একটি গানও না লিখিতেন, কেবল পণ্ডিতের মতো স্মৃতি পুরাণ তীর্থ ও গেজেটিয়া প্রভৃতির সংস্কৃত গ্রন্থ লিখিয়া খান্ত থাকিতেন তা হইলেও বলিতে হইত তাঁর প্রতিভা উজ্জ্বল ও সর্বোতোমুখী।”.
কবি পরিচয় : কবির আবির্ভাব ও তিরোভাবের সঠিক কাল নির্ণয় সম্ভব হয়নি।মনে করা হয়ে থাকে ১৩৮০ খ্রিস্টাব্দ বা তার অনতিপূর্ব সময় উত্তর বিহারের দ্বারভাঙ্গা জেলার মধুবনী মহকুমার অন্তর্গত বিসফি গ্রামে প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণ বংশে বিদ্যাপতি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম গণপতি ঠাকুর। কুল পদবী ঠকুর বা ঠাকুর। পঞ্চদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বা আনুমানিক ১৪৬০ খ্রিস্টাব্দে কবির তিরোভাব হয়। বিদ্যাপতির পত্নীর নাম জানা যায়নি। কিন্তু জানা গেছে তাঁর কন্যা দুলহা এবং কবি খ্যাতি সম্পূর্ণা পুত্রবধূ চন্দ্রকলা। প্রথম পক্ষের পুত্র হরপতী ও নরপতী এবং দ্বিতীয় পক্ষের পুত্র বাচুস্পতী।মিথিলার রামেশ্বর বংশভূত কীর্তি সিংহ, নরসিংহ, ভৈরব সিংহ এবং দ্রোণবারের রাজা পুরাদিত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় কবি বিদ্যাপতি তাঁর সুদীর্ঘ জীবনে লাভ করেছিলেন।এদের পৃষ্ঠপোষকতা কবি মৈথিলি সংস্কৃত অবহউঠ ভাষায় গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।
রচিত গ্রন্থ সমূহ : বিদ্যাপতি শুধু কবি নন, স্মৃতি সংহিতা ও নানা শাস্ত্রে অধ্যায়ন করে পৌরাণিক ও স্মৃতি গ্রন্থাদি রচনা করে পাণ্ডিত্য খ্যাতি লাভ করেছিলেন।বিদ্যাপতীর লেখা গ্রন্থ সম্ভার বিস্ময় জাগায়, বিষয় বৈচিত্র্য, বিভিন্ন ভাষায় রচনা এবং আঙ্গিক প্রকরণের একাধিক রূপ রীতি চোখে পড়ে।এবারে আমরা বিদ্যাপতির রচিত গ্রন্থগুলি সম্পর্কে নিম্নে অতি সংক্ষিপ্তকারে আলোচনায় অগ্রসর হব-
।। এক ।। ভূ-পরিক্রমা ঃ রাজা দেবি সিংহের পৃষ্ঠপোষকতায় তীর্থকাহিনীর আদলে মিথিলা থেকে নৈমি যারণী পর্যন্ত হিন্দু তীর্থগুলির ভৌগোলিক বিবরণ ভূ-পরিক্রমা(১৪০০ খ্রিস্টাব্দ)। হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির চেতনা জাগরণের উদ্দেশ্যেই সংস্কৃত ভাষায় কবি এই গ্রন্থটি রচনা করেছেন, কেননা মিথিলা তখন মুসলমান সুলতান আসলাম কর্তৃক বিজিত।
।। দুই ।। কীর্তিলতা ঃ গেওনেশর বা গণেশ বা জ্ঞানেশের দুই পুত্র বীরসিংহ ও কীর্তিসিংহ জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিমের সাহায্যে আসলামকে যুদ্ধে নিয়ত করে শত্রুর হাত থেকে ত্রিহৃত পুনরুদ্ধার করেন। কীর্তি সিংহের এই বীরত্ব বর্ণনা কীর্তিলতা(১৪০২-১৪০৪) গ্রন্থটির প্রধান আকর্ষণ। তুর্কি রাজ আসলমের প্রতি কবির বিরাগ এবং ওই যুগের নাগরিক সমাজের একটি গ্রহণযোগ্য ছবি কবি তুলে ধরেছেন।
।। তিন ।। কীতিপতাকা ও রাজা শিবসিংহের অসাধারণ কীর্তি, মুসলমান নৃপতিকে পরাজিত করে সম্ভবত এই নরপতি গৌড়ের সুলতান এবং তাঁর শৃঙ্খলার রসবহুললীলা-এই কীর্তিপতাকা (১৪১০) কাব্যে প্রকাশিত হয়েছে।
।। চার ।। পুরুষপরীক্ষা : রাজা শিবসিংহের রাজত্বকালে রচিত হয় পুরুষপরীক্ষা(১৪১৪ খ্রিস্টাব্দ) গ্রন্থটি। এ গ্রন্থে বহু ঐতিহাসিক ও অনৈতিহাসিক গল্প রয়েছে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ছাত্রদের শিক্ষাদেবার উদ্দেশে এই গ্রন্থটি অনুবাদ করেন ওই কলেজেরই শিক্ষক হরপ্রসাদ রায়। শুধু ফোর্ট উইলিয়াম কলেজেই নয় পরবর্তী কালে বহু কলেজে এমনকি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবার পর সেখানেও উনবিংশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত গ্রন্থটি পাঠ্য তালিকায় স্থান পেয়েছে।
।। পাঁচ ।। লিখনাবলী : শিবসিংহের মৃত্যুতে আশ্রয়চ্যুত হয়ে দ্রোনবারের রাজা পুরাদিত্যের আশ্রয়ে থাকার সময় লিখনাবলী (১৪১৮) গ্রন্থটি রচিত হয়। এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য সংস্কৃত ভাষায় গ্রন্থটি লেখা, সংস্কৃত পত্র লিখন পদ্ধতি শিক্ষা দেবার জন্য গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল।
১৪৪০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪৬০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিদ্যাপতির লিখিত গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
।। এক ।। বিভাগসার ঃ দর্পনারায়ণ নরসিংহের নির্দেশে সম্পত্তিবন্টন উত্তরাধিকার তত্ত্ব সমাজের কাছে তুলে ধরার জন্য বিভাগসার গ্রন্থটি রচিত হয়।
।। দুই ৷৷ দান বাক্যাবলী : দর্প নারায়ণের পত্নী ধীরামতী দেবীর নির্দেশে রচিত দান বাক্যাবলী গ্রন্থটিতে জলাশয় খনন, ধর্মশালা নির্মাণ ও ভিক্ষুকদের অন্নদানের মাধ্যমে কাম্য ও পুণ্যলাভের কথা বর্ণিত হয়েছে।
৷৷ তিন ৷৷ বর্ষনির্ণয় ঃ এই গ্রন্থে বারো মাসের করণীয় নানা কর্মের বিবরণ রয়েছে।কবি বিদ্যাপতির অসাধারণ পাণ্ডিত্যের প্রমাণ বহন করেছে তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থগুলি। রাজা পদ্মসিংহ ও তাঁর পত্নী বিশ্বাস দেবীর নির্দেশে তিনি রচনা করেন 'শৈবসর্বস্বসার', 'গঙ্গাবাক্যাবলী' ১৩৩০ থেকে ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এ গ্রন্থটি রচিত।
১৪৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রূপনারায়ণ ভৈরব সিংহের নির্দেশে রচনা করে দূর্গা ভক্তিতরঙ্গী। জয়কান্ত মিশ্র তাঁর 'Hisotry of Maithili Literature' গ্রন্থে জানিয়েছেন বিদ্যাপতি গোরক্ষোপাখ্যান নামে একটি নাটক রচনা করেছিলেন।বিদ্যাপতির বহুমুখীর পরিচয় তাঁর নানা ধরনের গ্রন্থে আছে কিন্তু তিনি যদি কেবল স্মৃতি, পুরাণ, তীর্থ, গেজেটিয়ার জাতীয় সংস্কৃত গ্রন্থ রচনা করতেন তাহলেও তাঁর প্রতিভার ব্যপ্তি স্বীকার করতে হলেও বাংলা সাহিত্যে তাঁর আলোচনা করার প্রয়োজন হত না। আসলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর অন্তর্ভুক্তির মূলে রয়েছে তার রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক পদাবলী।
১১. অন্নদামঙ্গল কাব্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে ভারতচন্দ্রের কবি প্রতিভা বিচার কর।
উত্তর : রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র সমগ্র বাংলা সাহিত্যে প্রথম শ্রেণির সাহিত্যসাধক।অষ্টাদশ শতাব্দির তথা মধ্যযুগের শেষপর্বের কবি ভারতচন্দ্র। বাংলা মঙ্গলকাব্যের ঐশ্বর্য যুগের সর্বশেষ চিহ্নিত কবি ভারতচন্দ্র। তিনি কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি ছিলেন। তাঁর জন্ম ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে। মাত্র ৪৮ বছর বয়সে অর্থাৎ ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জীবনাবসান হয়। জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা তিনি লাভ করেছিলেন।কৃষ্ণচন্দ্রের আশ্রয় পাবার আগে তাঁকে নানারূপ দুর্ভাগ্যের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।কবি সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি ভাষায় পাণ্ডিত্য লাভ করেছিলেন। ব্যাকরণ, অলংকার শাস্ত্র, পুরাণ ও তন্ত্রে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। ব্যক্তিগত জীবনাভিজ্ঞতা, অধ্যায়নের বিস্তার, কাব্যজ্ঞান তাঁর কাব্যের মধ্যে নানা ভঙ্গিতে প্রতিফলিত হয়েছিল।
কাব্যসম্ভার : কবির শ্রেষ্ঠ কাব্য অন্নদামঙ্গল (১৭৫২ খ্রিঃ)। এছাড়াও সত্যদাবারণের পাঁচালি (১৭৩৮), রসমঞ্জরি (১৭৪১) এবং কিছু খণ্ড কবিতাও তিনি রচনা করেছেন।কবি রচিত 'বিদ্যাসুন্দর' কাব্যটি প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। তবে কবির শ্রেষ্ঠত্ব মূলত 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যকে কেন্দ্র করে। এই কাব্যের জন্যই ভারতখ্যাত হয়েছেন।
কাব্য পরিচয় : অন্নদামঙ্গল কাব্যটি স্বতন্ত্র তিনটি খণ্ডে বিভক্ত--(ক) অন্নদামঙ্গল, (খ) কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর, (গ) অন্নপূর্ণামঙ্গল বা মানসিংহ।সমগ্র কাব্যে মোট ছ'টি উপাখ্যান আছে। যথা-(ক) শিব পার্বতী উপাখ্যান, (খ) ব্যাস বৃত্তান্ত, (গ) হরিহরের উপাখ্যান, (ঘ)ভবানন্দের উপাখ্যান, (ঙ) মানসিংহের পালা, (চ) বিদ্যাসুন্দরের কাহিনী।অন্নদামঙ্গলের প্রথম খণ্ডে মঙ্গলকাব্যের রীতিতে কাবোৎপত্তির কারণ, আত্মচরিত,সমকালীন দেশের অবস্থান বর্ণন, কবির প্রতিপালক কৃষ্ণচন্দ্রের সভাচিত্র। দেবখণ্ডের বর্ণনায় সরাসরি মুকুলের প্রভাব আছে। পুরাণ থেকেও নানা প্রসঙ্গ সংকলিত।
১২.মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে দৌলত কাজী ও সৈয়দ আলাওয়ালের ভূমিকা আলোচনা কর।
উঃ দৌলত কাজী: আরাকান রাজসভার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি দৌলত কাজীর কাব্যের নাম ‘লোর চন্দ্রানী’ বা ‘সতী ময়না’। দৌলত কাজীর এই কাব্য গতানুগতিক কাব্যধারার ক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম এই কারণে যে, কাব্যখানি দেবদেবীর মহিমাজ্ঞাপক কাব্য নয়, তা মর্ত্য মানব মানবীর ঘরোয়া জীবনালেখ্য ও প্রেমকথার লোককাব্য ।
কবি পরিচিতি : চট্টগ্রামের বাউজান থানার অন্তর্গত সুলতানপুর গ্রামে দৌলত কাজীর জন্ম। অল্প বয়সেই বিদ্যার্জন করে তিনি আরাকান রাজ থিরি-সু-ধৰ্ম্মা অর্থাৎ শ্রীসুধর্মার রাজসভায় স্থান পান। সেখানে আরাকান রাজ সুধর্মার সমর বিভাগের মন্ত্রী আসরাফ খানের উৎসাহে দৌলত কাজী ১৬৩১-১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সতী ময়না কাব্যের দুই তৃতীয়াংশ রচনা করতে পেরেছিলেন। মৃত্যুর কারণে তিনি এই কাব্য সম্পূর্ণ রচনা করে যেতে পারেননি।
কাব্য উৎস : হিন্দি ভাষার কবি মিয়া সাধনের মৈনা-কো-সৎ (গোহাড়ি ভাষায় রচিত) অবলম্বনে দৌলত কাজী তাঁর সতী ময়না কাব্যটি রচনা করেছিলেন। তবে এই কাব্য রচনায় আরও নানা গ্রন্থের প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন সাহিত্য ইতিহাসগণেরা।
কাব্য কাহিনী ঃ গোহারি দেশের রাজা মোহরার সুন্দরী কন্যা চন্দ্রানীর সঙ্গে এক বামনের বিয়ে হয়--এই বিয়ে সুখকর হয়নি। কারণ বামন ছিল নপুংসক ফলে চন্দ্রানীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠে। অন্যদিকে রাজা লোরক এবং সতী ময়নার জীবন বড়োই সুখ ও আনন্দের মধ্যে অতিবাহিত হচ্ছিল। এমন সময় একদিন মৃগয়া করতে গিয়ে এক যোগীবরের কাছে অপূর্ব সুন্দরী রমনী চন্দ্রানীর প্রতিকৃতি দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে লাভ করার জন্য লোরক গোহাড়ি দেশে যাত্রা করেন। সেখানে চন্দ্রানীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ-এর পর দুজন দুজনকে দেখে মুগ্ধ হন এবং লোরকের সঙ্গে চন্দ্ৰানী পলায়ন করে। এমন সময় বামন গৃহে ছিল না। তিনি ফিরে এসে পত্নীর পলায়ন সংবাদ শুনে লোরকের পশ্চাদধাবণ করেন। পথিমধ্যে লোরক ও বামনের ভীষণ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বামন প্রাণ হারান। তারপর রাজা মোহরার অনুরোধে লোরক গোহাড়ি দেশের রাজা হয়ে বসেন। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর লোরক তার প্রথমা পত্নী সাব্বি ময়নাকে ভুলে গেলেন। ময়না এদিকে পতি বিরহে দুঃখে কাল কাটাতে লাগলেন। ইতিমধ্যে ছাতন নামে এক লম্পট রাজকুমার ময়নাকে পাওয়ার জন্য রওনা নামে এক কূটনীতিককে কুপ্রস্তাব দিয়ে ময়নার কাছে পাঠিয়ে দেন। রওনা তাকে নানা প্রলোভনের মাধ্যমে ছাতনের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য অনেক চেষ্টা করল। কিন্তু প্রতিবারই সতী ময়না তাঁর প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর রওনা বারোমাসের যৌবন সুখের বর্ণনা দেন। এই পর্যন্ত দৌলত কাজীর লেখা। কাব্যের বাকি অংশটি সমাপ্ত করেন সৈয়দ আলাওল।
অভিনবত্ব :(১) দৌলত কাজীর সতী ময়না কাব্যের মধ্যে দিয়ে দেবদেবীর কাহিনীর পরিবর্তে মানব মানবীর কাহিনী বাংলা সাহিত্যে স্থান লাভ করে অর্থাৎ মানব মানবীর রোম্যান্টিক প্রণয়গাথা প্রবেশের প্রধান পুরোহিত এই দৌলত কাজী।
(২) মুসলমান বিদ্বজ্জন আরবি ফারসী চর্চার ক্ষেত্র থেকে সরে এসে এই প্রথম তাঁরা বাংলা ভাষার সৃষ্টি ক্ষেত্রে প্রবেশ করল।
(৩) বাংলা সাহিত্য শুধু আর হিন্দুর সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের সাহিত্য থাকল না—সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয় পাদ থেকে হিন্দু মুসলমান বাঙালীর সাংস্কৃতি সংযোগের সাহিত্য হয়ে উঠল। এখানেই দৌলত কাজীর কাব্যের অভিনবত্ব।
(৪) দৌলত কাজীই প্রথম শক্তিশালী বাঙালী মুসলমান কবি। লোর চন্দ্রানী বাংলা সাহিত্যের প্রথম ধর্মসংস্কারমুক্ত মানবীয় প্রণয়কাব্য ।
(৫) দৌলত কাজীর রচনায় সুফি ও হিন্দুর আধ্যাত্ম সাধনার স্বাভাবিক সম্মেলন সহজ হয় উঠে।
(৬) দৌলত কাজীই রূপকথাকে পরিণত মনের উপযোগী রোম্যান্টিক কাহিনীতে পরিণত করেছেন। সেজন্যে দৌলত কাজী বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ মর্ত্যজীবনরসের কবি ।
(৭) চিত্রকল্প, উপমা ও অন্যান্য অলংকার প্রয়োগেও দৌলত কাজী হিন্দু মনোভাব দেখিয়েছেন।
সৈয়দ আলাওল :
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের খ্যাতনামা কবি হলেন সৈয়দ আলাওল। তাঁর কাব্য সম্প্রদায় বিশেষের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কাছে সমাদৃত হয়েছে। মধ্যযুগের মুসলমান কবিদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তিনি বিচিত্র বিষয়ের সম্ভারে কাব্য রচনা করে তাঁর প্রতিভার ব্যাপকতার পরিচয় দিয়েছেন।
ব্যক্তি পরিচয় : অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত ফতেয়াবাদ বা ফরিদপুরের অন্তর্গত জালালপুরে আনুমানিক সপ্তদশ শতকের প্রথম দশকে কবি জন্মগ্রহণ করেন।আলাওয়েলের পিতা জালালপুরের অধিপতি মজলিশ কুতুবের অমাত্য ছিলেন। ১৫৭৬ খ্রিঃ থেকে ১৬১১ খ্রিঃ পর্যন্ত মজলিশ কুতুব ক্ষমতাসীন ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর কবি রোসাঙ্এ এসে রাজঅশ্বারোহী সৈন্যদলে নিযুক্ত হন। এরপর মাগন ঠাকুরের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। এরপর তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি একের পর এক কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন।
কাব্যগ্রন্থসমূহ : আলোচনার দৃষ্টিতে—
কবি আলাওল রচিত কাব্যগ্রন্থগুলিকে নিয়ে নিম্নে সংক্ষিপ্তকারে আলোচনা করা হল -
(ক) পদ্মাবতী : আলাওলের শ্রেষ্ঠ কীর্তি পদ্মাবতী। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সমাজেই এই কাব্য সমাদৃত। সুফী মতাবলম্বী ভক্ত কবি মালিক মুহম্মদ জায়সির ‘পদুমাবৎ’ কাব্য অবলম্বনে আলাওল এই কাব্যটি রচনা করেন। সিংহল রাজকন্যা ও মেবারের রাণী পদ্মাবতী বা পদ্মিনীকে নিয়ে কাব্যটি রচিত। আলাউদ্দিন খলজি রত্নসেনের রাণী পদ্মাবতীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে শক্তিবলে ছিনিয়ে নেবার জন্য চিতোর আক্রমণ করেন। এই দস্যুর কবল থেকে ধর্মরক্ষার জন্য পদ্মিনী জহরব্রতে আত্মত্যাগ করেন—এই হল এই কাব্যের কাহিনী। জায়সীর পদুমাবৎ কাব্যে ইতিহাসের চেয়ে কল্পনার প্রাধান্য বেশী কিন্তু আলাওল ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে মানুষের প্রেম ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের কাহিনী সম্বলিত কাব্য রচনা করেছেন। অর্থাৎ পদ্মাবতী ইতিহাসাশ্রিত রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য।
(খ) সতী ময়নাবতীর শেষাংশ :
দৌলত কাজীর মৃত্যুর পর তাঁর অসমাপ্ত কাব্য সতী ময়নাবতী সম্পূর্ণ করবার দায়ভার আলাওল নিয়েছিলেন। আলাওলের লেখা সতী ময়নাবতীর শেষাংশের কাহিনীটা এরকম—কুটনী রওনার ঘৃণ্য প্রস্তাব আর সহ্য করতে না পেরে ময়না তাকে মেরে ধরে মুখে চুনকালি লাগিয়ে দূর করে দিলেন। এরপর ময়না এক ব্রাহ্মণকে দূত করে স্বামীর কাছে পাঠান। লোরকও ময়নার কথা স্মরণ করে অধীর হয়ে পড়েন। তখন চন্দ্রানীর গর্ভজাত পুত্রের উপর রাজ্যভার সমর্পণ করে লোরক চন্দ্রানীকে নিয়ে ফিরে যান। দুই রাণী স্বামীর সেবা করে সুখে দিন কাটাতে লাগল । বৃদ্ধ বয়সে লোরকের মৃত্যু হলে তারা সহমৃতা হয়ে পরলোক যাত্রা করেন।
(গ) সয়ফুল-মুলুক-বদি-উজ্জমাল :
এটি রোম্যান্টিক প্রেমের আখ্যান। মিশরের বাদশাহ ছিপুয়ানের পুত্র শয়ফুল-মুলুক এই কাহিনীর নায়ক। অমাত্য পুত্র সৈয়দ ছিল তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু। রোস্তানের অন্তর্গত এক পরীর রাজ্যের অপূর্ব সুন্দরী কন্যা ছিল নায়িকা। নায়িকার চিত্রদর্শন, বাদশাহের বদি উজ্জমালের অনুসন্ধান প্রয়াস, অতঃপর নায়িকার স্বপ্নযোগে দেখা দেওয়া, সইফুলের বন্ধু সৈয়দকে নিয়ে রোস্তানের পথে যাত্রা। সেই যাত্রাপথে নানা অবাস্তব ঘটনার সম্মুখীন হওয়া অবশেষে বদি উজ্জমালের সঙ্গে সইফুলের মিলন এবং সৈয়দের সঙ্গে বদি উজ্জমালের সখি মল্লিকার বিবাহ পর্যন্ত্য এর কাহিনী বিস্তৃত। এই কাব্যটি মুসলমান সমাজে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। মানুষের সঙ্গে পরীকন্যার প্রেম, দেহ ও দেহাতীত, মৰ্ত্য ও অমর্ত্যের এই ভাববন্ধনটি কবির মস্তিষ্কপ্রসূত।
(ঘ) হপ্ত (সপ্ত) পয়কর : গ্রন্থটি ইরানি কবি সমরকন্দের কাহিনী অবলম্বনে রচিত। কাহিনীটি এরকম—আরব ও আজমের অধিপতি লোমানের পুত্র বাহরামেয়র বিবিধ কেরামত যুক্ত সাতবনের সাতটি ‘টোঙ্গী’ (উচ্চভবন) নির্মান করেন। বাহরাম নৃত্য ও মৃগয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। একদিন বাহরাম মৃগয়া গিয়েছেন ঠিক সেই সময় করার মৃত্যুর সংবাদ তার কাছে পৌঁছায় সেই সুযোগে উজির রাজ্য জয় করেন। এরপর বাহরাম সম্পূর্ণ নিজ কৃতিত্বে সেই হৃত রাজ্য উদ্ধার করেন। এরপর বাহরাম সাতটি রাজ্য জয় করে উক্ত রাজ্যের রাজকন্যাদের বিবাহ করেন। রাণীরা বাহরামকে প্রতি রাত্রে একটি করে গল্প বলতেন। সাত পত্নী নিয়ে বাহরাম বেশ মজায় দিন কাটাতে লাগলেন। এই কাব্য কবির স্বাধীন অনুবাদ ।
(ঙ) তোহফা ঃ মাগন ঠাকুরের নির্দেশে আলাওল ৪৫টি অধ্যায়ে বিভক্ত মুসলমান জাতির স্মৃতি সংহিতা ধরনের গ্রন্থ তোহফা রচনা করেন। এই গ্রন্থে হিন্দুয়ানী ঘেষা কিছু নির্দেশও মেলে। সুফি সাধক আলাওল যোগ, তন্ত্র, জোতিষ প্রভৃতি হিন্দু শাস্ত্রাধি নিয়ে গভীর পড়াশোনা করেছিলেন। তার কিছু পরিচয় তোহফা গ্রন্থে পাওয়া যায় তবে এই গ্রন্থকে ঠিক কাজ বলা যায় না।
১৩.বাউল সাধক লালন ফকিরের পরিচয় দিয়ে বাংলা সাহিত্যে বাউল গানের গুরুত্ব আলোচনা কর।
উঃ বাংলার বাউল সঙ্গীত রচয়িতা হিসাবে আমি লালন ফকিরকে সর্বশ্রেষ্ঠ আসনের অধিকারী মনে করি। তিনি ছাড়াও পাঞ্চ শাহ ও মদন বাউলের নাম সুবিখ্যাত।
বাউল লালন ফকিরের সংক্ষিপ্ত জীবনী : লালন ফকিরের জীবনী সম্পর্কে প্রামাণিক তথ্য বিশেষ কিছু জানা যায়নি। অনুমান করা হয় ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি গ্রামের নিকট ভাঁড়রা গ্রামে তাঁর জন্ম। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন হিন্দু কায়স্থ বংশীয় সন্তান। তাঁর পিতামাতার নাম অজ্ঞাত। কথিত আছে বিবাহের পর তীর্থযাত্রায় বেরিয়ে পথিমধ্যে ভয়ঙ্কর বসন্তরোগে আক্রান্ত হলে সঙ্গীসাথীগণ তাঁকে ছেড়ে পালিয়ে যায়। এ অবস্থায় সিরাজ সাঁই নামক জনৈক মুসলিম মুমূর্ষু লালনকে সেবা শুশ্রূষা করেন। সিরাজ এবং তাঁর স্ত্রীর যত্নে লালনের প্রাণ রক্ষা পায়। কিন্তু নিজদেশে প্রত্যাবর্তন করলে তৎকালীন হিন্দু সমাজ তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে। পরন্তু তাঁর উপর নানাপ্রকার অত্যাচার নির্যাতন চলে মুসলমানের গৃহে আশ্রয় গ্রহণ করার জন্য।তখন বাধ্য হয়ে লালন সিরাজের নিকট ফিরে আসেন। তাঁর কাছে ফকিরী ধর্মে দীক্ষাগ্রহণ করেন। একজন মুসলিম রমণীকে বিবাহ করে তিনি সেঁউড়িয়া গ্রামে আশ্রম স্থাপন করে বাউল পন্থায় সাধন ভজনে ব্রতী হন এবং আর্ত-পীড়িতের জীবনের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেন। লালন কোনো বিশেষ সাম্প্রদায়িক ধর্ম মানতেন না। মানুষের ধর্মই (The Religion of Man) ছিল তাঁর ধর্ম। সকল ধর্মের লোকই তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করত।প্রতি বছর তিনি একটি প্রীতি উৎসব করতেন। এতে তাঁর নকল শিষ্য যোগদান করত।আনুমানিক ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে সুদীর্ঘজীবন (১১৬ বছর) কাটিয়ে তিনি লোকান্তরিত হন।
রচনার সংক্ষিপ্ত পরিচয় : লালন ফকিরের স্বহস্ত লিখিত কোন গানের পুঁথি পাওয়া যায় নি। তাঁর আশ্রমের শিষ্যগণ গুরুর মুখ নিঃসৃত গান খাতায় টুকে রাখতেন। রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে থাকাকালীন লালনের রচিত বাউল গানের পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হন। তিনি গানগুলির কিছু কিছু তাঁর এক কর্মচারীর দ্বারা নকল করিয়ে নেন। পরে ডঃ মতিলালদাস ও ডঃ উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য লালনের গান নকল করেন। এ পর্যন্ত লালনের সাড়ে চারশোর বেশি পদ মুদ্রিত হয়েছে। এই সূত্রেই লালন ফকির শিক্ষিত সমাজে প্রচার লাভ করেন।
লালন ফকির সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত একদল শিষ্য নিয়ে বাউল গীতি চর্চা শুরু করেন। আসলে তিনি জাতিভেদহীন এক উদার মানবধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মের লোকই তাঁর সঙ্গে এই গান প্রচার করত। তাঁর রচিত সঙ্গীতে যেমন ছিল হিন্দু মনোভাব দ্যোতক শব্দের ব্যবহার, তেমনি ছিল সুফী ধর্মানুমোদিত দ্বৈভাষিক শব্দ।কোথাও তিনি বিশুদ্ধ বৈষ্ণব ভাবের বশে রাধাকৃষ্ণের কথা লিখেছেন, কোথাও বা গৌরাঙ্গ বিষয়ক গান রচনায় আত্মনিয়োগ করেছেন।লালন রচিত বাউল সঙ্গীতগুলি ভাব ও ভাষার দিক থেকে অপূর্ব কাব্যরস মন্ডিত।এগুলি যেমন গীতিময়তায় পূর্ণ, তেমনি আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনাগর্ভ। লালনের একটি পরিচিত গানের পংক্তি বাঙালীর মুখে মুখে ফেরে :
“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আইসে যায়,
(আমি) ধরতে পারলে মনো বেড়ি দিতেম পাখির পায়।
চিরকালটা পুষলেম পাখি
বুঝলেম না তার ফাঁকি-জুকি
দুধকলা দিই খায়রে পাখি তবু ভোলে না তায়।”
সীমা-অসীম, জীবাত্মা-পরমাত্মার সম্পর্কও তিনি অতি সূক্ষ্ম ইঙ্গিতের সাহায্যে ব্যক্ত করেছেন। মূলতঃ আধ্যাত্মিক তত্ত্বকথা হলেও তাঁর সঙ্গীত উপভোগ্য কাব্যশ্রী লাভ করেছে। সর্বোপরি, আধুনিক মনের সঙ্গে তাঁর সংগীত-নিহিত ধ্যান-ধারণার নিকট আত্মীয়তা লক্ষনীয়। সে জন্য তিনি বিশ্বকবিকেও প্রভাবিত করেছিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতে বাউল গানের প্রভাব সুবিদিত। তাই লালন ফকিরের বাউল গান বাঙালি মানুষের চিরন্তন সম্পদ। বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার ছেঁউড়িয়া গ্রামে এবং বীরভূমের জয়দেবের কেঁদুলিতে বাৎসরিক বাউল উৎসবে তাই সর্বশ্রেণীর মানুষের সম্মিলন ঘটে।
১৪. বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে কবি গোবিন্দ দাসের কবি কৃতিত্ব বিচার করো।
উত্তর : অলংকার ব্যবহারে, মন্দল কলা নৈপুণ্যে, অপূর্ব ছন্দালঙ্কারে এবং শব্দব্যবহারে সুমিত কুশলতায় গোবিন্দদাস বিদ্যাপতির সার্থক উত্তরসূরী। গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনে সুপরিপক্ক জ্ঞান এবং গভীর ভক্তির মার্জিত দ্যুতিতে তাঁর পদাবলীর মধ্যে একধরনের সুসংবদ্ধ ক্লাসিক সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে।
কৰি পরিচয় : সম্ভবত ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান জেলার শ্রীখন্ড গ্রামে মাতামহ 'সঙ্গীত দামোদর' গ্রন্থ প্রণেতা দামোদর গৃহে গোবিন্দদাস কবিরাজের জন্ম হয়। তাঁর পিতার নাম চিরঞ্জীব, মাতা সুনন্দা। বৃন্দাবনের সৃজিত গোস্বামী তাঁকে কবিরাজ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। সম্ভবত ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে কবিরাজ গোবিন্দদাস দেহত্যাগ করেন।
ব্রজবুলীতে কৃতিত্ব : চৈতন্যপরবর্তী যুগের একজন শ্রেষ্ঠ ও শক্তিমান কবি হলেন গোবিন্দদাস। কোনো সমালোচক তাঁকে চৈতন্যোত্তর যুগের শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব পদকর্তা বলেছেন। গোবিন্দদাসের ভণিতায় ৭০০-এর বেশি পদ পাওয়া গেছে। পদগুলির ভাষা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্রজবুলি। কৃত্রিম সাহিত্যিক ভাষাকে গোবিন্দদাস নির্দিষ্টরূপ বা কাঠামো দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। বিদ্যাপতির কবিতার অনুসরণ করে ও ব্রজবুলি ভাষায় কবিতা রচনার কারণে গোবিন্দদাস দ্বিতীয় বিদ্যাপতি রূপে প্রশংসিত হয়েছিলেন।
আঙ্গিক রচনায় পারদর্শীতা : কবিতার আঙ্গিক কথা বহিরঙ্গের দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় গোবিন্দদাস ভাষা, বয়নে এবং ছন্দ অলংকারের ব্যবহারে অপ্রতিদ্বন্দ্বী।ভাষার স্থাপত্যশিল্পে গোবিন্দদাসের দক্ষতা অতুলনীয়।
রূপ দক্ষতা : গোবিন্দদাস ছিলেন সৌন্দর্যরসিক-রূপদক্ষ কবি। যে ধরনের পদ বিলাস বিক্রম সৃষ্টির অনুকূল, কবি সাধারণত ঐ ধরনের পদ রচনায় বিশেষ আগ্রহ এবং অধিকারবোধের পরিচয় দিয়েছেন। এ বিষয়ে শঙ্করী প্রসাদ বসুর অভিমত-
“সংযোগ বুদ্ধির ফলে গোবিন্দদাসের কাব্যে যে বিশেষ বস্তুটির আবির্ভাব ঘটেছে, তাকে কাব্যে স্থাপত্যবিদ্যা বলা চলে। আর অধিকাংশ পদ যেন কুঁদে তৈরি।”
সঙ্গীতপ্রাণতা : ভাষা, ছন্দ, অলংকারের বাইরে গোবিন্দদাসের রচনার আরেকটি বড় গুণ সঙ্গীতময়তা। এখানে তিনি বিদ্যাপতির শিষ্য নন। তিনি বৈষ্ণব কবিতার আদিপুরুষ। জয়দেব গোস্বামীর কাছ থেকে সুরের মন্ত্রের দিক্ষা নিয়েছেন।
নাটকীয়তা ও চিত্রময়তা : গোবিন্দদাসের রচনার আরো একটি বিশেষ গুণ—নাটকীয়তা ও চিত্রধর্মীতা। এদের যুগপৎ উপস্থিতি তাঁর পদগুলির কাব্য সৌন্দর্যের প্ৰকাশ।
গৌড়চন্দ্রিকা পদরচনায় শ্রেষ্ঠত্ব : গৌড়চন্দ্রিকা পদে গোবিন্দদাসের কৃতিত্ব অপর সকল কবির প্রচেষ্টাকে ম্লান করে দিয়েছে।
অভিসারের শ্রেষ্ঠ কবি গোবিন্দদাস : গোবিন্দদাসের কবি প্রতিভার অসাধারণত্বের পরিচয় মেলে তাঁর অভিসার পর্যায়ের পদে। রাধার অভিসার প্রস্তুতির পদ রচনায় এবং অভিসারিকা রাধার অভিসার বর্ণনায় অর্থাৎ এই দুই ধরণের অভিসার বিষয়ক পদেই গোবিন্দদাস কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন।
বিদ্যাপতিকে অনুসরণ করে ব্রজবুলি ভাষায় বৈষ্ণব পদরচনায় আত্মনিয়োগ করলেও তিনি আপন কৃতিত্বে বাংলা সাহিত্যের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে নিজের নামটি লিখে যেতে পেরেছিলেন। বিদ্যাপতির সঙ্গে তাঁর পদের সাদৃশ্য থাকলেও গোবিন্দদাসের স্বাতন্ত্র ও অনন্যতা তুলনারহিত। ভক্তিভাবের নিষ্ঠা, ঐকান্তিক এবং কাব্যিক মহনের উৎকর্ষতা তাঁকে কালজয়ী কবিত্বের স্বর্ণমুকুট পরিয়ে দিয়েছে।
...................