🌹একাদশ শ্রেণির বাংলা প্রশ্নোত্তর(সেমিস্টার-২):ছুটি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর🌹

📚একাদশ শ্রেণির বাংলা প্রশ্নোত্তর(সেমিস্টার-২):ছুটি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর📚

 

 

 

 

 

 

✍️প্রশ্নের মান-৫:

১.“গুঁড়ি এক পাক ঘুরিতে-না-ঘুরিতেই মাখন তাহার গাম্ভীর্য, গৌরব এবং তত্ত্বজ্ঞান-সমেত ভূমিসাৎ হইয়া গেল।”- ঘটনাটি উল্লেখ করো এবং ফটিকের ওপরে এর কী প্রভাব পড়েছিল লেখো।

উঃ ঘটনাটি উল্লেখ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "ছুটি" গল্পে ফটিক এবং তার বন্ধুদের নেতৃত্বে একদল বালক নদীর ধারে একটি শালের গুঁড়ি গড়িয়ে দেওয়ার খেলায় মেতে ওঠে। কিন্তু ফটিকের ছোট ভাই, মাখনলাল, এই খেলায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়, কারণ সে গুঁড়ির ওপরে বসে এবং কিছুতেই নামতে চায় না। ফটিক এবং তার বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নেয় যে মাখনলালকে গুঁড়িসহ গড়িয়ে দেবে। মাখনলাল মনে করে এতে তার গৌরব বাড়বে, কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। গুঁড়ি এক পাক ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে মাখনলাল মাটিতে পড়ে যায়। গল্পের এই অংশেই মাখনের গাম্ভীর্য ও গৌরবের পতনের উল্লেখ রয়েছে।

ফটিকের ওপর প্রভাব: মাখনলাল মাটিতে পড়ে গেলে সে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি চলে যায়, ফলে ফটিকদের খেলা বন্ধ হয়ে যায়। ফটিক কাশের গোড়া চিবিয়ে নৌকার গলুইয়ে বসে থাকে। কিছুক্ষণ পরে তার বন্ধু বাঘা এসে জানায়, তার মা তাকে ডাকছেন। ফটিক যেতে না চাইলে বাঘা তাকে আড়কোলা করে নিয়ে যায়। ফটিক বাড়িতে পৌঁছালে তার মা জানতে চান, সে মাখনকে মেরেছে কি না। ফটিক অস্বীকার করলেও তার মা তার কথা বিশ্বাস করেন না। মাখন অভিযোগ করে যে ফটিক তাকে মেরেছে, যা ফটিক মিথ্যা বলে মনে করে এবং সেই ক্ষোভে মাখনকে চড় মারে। ফটিকের মা এই ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে ফটিককে কয়েকবার চড় মারেন। রাগে ফটিক তার মাকে ঠেলে দেয়। সেই মুহূর্তে ফটিকের মামা এসে ঘটনাটির আপাত সমাপ্তি ঘটান। এই ঘটনাগুলো ফটিকের জীবনে এক ধরনের মানসিক চাপ সৃষ্টি করে, যা তার অস্থিরতা এবং বেপরোয়া আচরণের ফলশ্রুতি।

২.“মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।”-কে, কাকে উদ্দেশ করে কথাটি বলেছে? ছুটির জন্য বক্তার এই আকুলতার কারণ কী ছিল? শেষপর্যন্ত বক্তা তার কাঙ্ক্ষিত ছুটি কীভাবে পেয়েছিল?

উঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "ছুটি" গল্পে ফটিক তার মা-কে উদ্দেশ করে বলেছিল: "মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।" 

ফটিকের মামা, বিশ্বম্ভরবাবু, তাকে কলকাতায় পড়াশোনা করানোর জন্য নিয়ে আসেন। তবে শহরের নতুন পরিবেশে সে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি। মামার বাড়িতে মামির অবহেলা, শহুরে পরিবেশের একঘেয়েমি, এবং স্কুলের মাস্টারমশাইয়ের শাসন তাকে একরকম হতাশায় নিমজ্জিত করে তোলে। তার সহপাঠীরা এবং মামাতো ভাইয়েরাও তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। ফলে ফটিক একাকীত্ব ও অবজ্ঞার মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হয়। এসব কারণে সে তার নিজের গ্রামে এবং মা-র কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য আকুল হয়ে ওঠে। ফটিকের মামা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, কার্তিক মাসে পুজোর ছুটির সময় তাকে বাড়ি পাঠাবেন। সেই ছুটির জন্যই ফটিক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। 

অবশেষে, ফটিক যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন তার ছুটির আকাঙ্ক্ষা আরও বেড়ে যায়। অসুস্থ অবস্থায় সে নিজে বাড়ি থেকে পালিয়ে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করে, তবে মামার মাধ্যমে পুলিশ তাকে ফিরিয়ে আনে। ফটিক তার চাওয়া ছুটি কখনোই জীবদ্দশায় পায়নি, কিন্তু মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সে চিরদিনের জন্য ছুটি পেয়েছে। মৃত্যুর সময় তার মা-র উপস্থিতিতেই সে বলে, "মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।" এই ছুটি ছিল এক অনন্ত বিশ্রামের প্রতীক, যা তার জীবনের কষ্টের অবসান ঘটায়।

৩.ফটিক চরিত্রের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।

উঃ কথামুখ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের *ছুটি* গল্পে ফটিক গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। তার চারপাশেই কাহিনির বিকাশ, বিস্তার এবং উপসংহার ঘটে। এই বিন্যাসের মাধ্যমে ফটিকের চরিত্রের কিছু বিশেষ প্রবণতা বা ঝোঁক স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

শিশুসুলভ চপলতা: গল্পের শুরুতে ফটিককে বালকদের নেতা হিসেবে দেখা যায়। শালের গুঁড়ি গড়িয়ে খেলা কিংবা ছোটোভাই মাখনকে গুঁড়িসহ গড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা—সবটাই ফটিকের মস্তিষ্কপ্রসূত। বাকিরা শুধু তার নির্দেশ পালন করে। তার মা ফটিকের দুরন্তপনাকে ‘অবাধ্য উচ্ছৃঙ্খলতা’ হিসেবে বর্ণনা করেন।

শিকড়ের প্রতি টান: ফটিক প্রথমে মামার সঙ্গে কলকাতায় যাওয়ার ব্যাপারে খুব উৎসাহী ছিল। তবে শহরের বদ্ধজীবনে অতি দ্রুত তার সেই উৎসাহ নিঃশেষ হয়ে যায়। গ্রামে খোলা মাঠে ঘুড়ি ওড়ানো, নদীর ধারে বন্ধুদের নিয়ে আনন্দে মেতে ওঠা, ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটার সেই দিনগুলো তাকে কেবলই স্মৃতিকাতর করে তোলে। সে গ্রামকে ভুলতে পারে না, যার কারণে তার শিকড়ের প্রতি টান স্পষ্ট হয়।

বিবেকবোধ: যদিও স্কুলে ফটিককে ‘নির্বোধ ও অমনোযোগী’ হিসেবে দেখা হয়, তবু তার মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধের অভাব নেই। মামি যখন বই হারানোর জন্য তাকে তিরস্কার করেন, তখন ফটিক পরের পয়সা নষ্ট করছে, এই ভেবে ভীষণ লজ্জা অনুভব করে। তার বিবেকবোধের কারণেই সে নিজেকে ‘অনাবশ্যক জ্বালাতন’ হিসেবে মনে করে এবং অসুস্থ অবস্থায় কাউকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।

মা-এর প্রতি টান: ফটিক কলকাতায় যাওয়ার সময় মনের আনন্দে গেলেও, মায়ের সঙ্গে বিচ্ছেদ তাকে ক্রমশ কাতর করে তোলে। তার অজানা কষ্ট তাকে আঘাত দেয়, এবং অসুস্থ হয়ে পড়ার পর মায়ের সেবা ছাড়া আর কিছুই তার কাছে অর্থবহ মনে হয় না। মায়ের কাছে ফেরার আকাঙ্ক্ষায় সে বাড়ি থেকে পালানোর চেষ্টা করে।

শেষকথা: শহরের বদ্ধজীবনে একাকিত্বের মাঝে ফটিক ছুটির অপেক্ষায় ছিল। কাহিনির শেষে, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ফটিক সেই চিরকালীন ছুটির দেশে পৌঁছায়, যেখানে সব কষ্টের অবসান ঘটে।

৪.‘ছুটি’ গল্পে মামাবাড়িতে গিয়ে ফটিকের যে দুরবস্থা হয়েছিল তা নিজের ভাষায় লেখো।

উঃ ‘ছুটি’ গল্পে মামাবাড়িতে গিয়ে ফটিকের দুরবস্থার বিবরণ কিছুটা এরকম:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পে ফটিক যখন মামা বিশ্বম্ভরবাবুর সাথে কলকাতায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়, তখন সে অত্যন্ত উৎফুল্ল ছিল। মামাকে প্রশ্ন করে সে কবে যেতে পারবে এবং রাতের পর রাত বিনিদ্র কাটায়। কিন্তু যখন সে মামাবাড়িতে পৌঁছায়, তখন তার অভ্যর্থনা প্রত্যাশা মতো হয়নি। মামির মনোভাব ছিল একেবারেই বিপরীত; তিনি ফটিককে ‘বিপদের সম্ভাবনা’ হিসেবে দেখতেন, কারণ তিনি নিজের তিনটি ছেলেকে নিয়ে অনেক ব্যস্ত ছিলেন।

ফটিক সেখানে এসে বুঝতে পারে, মামি তাকে স্নেহহীন চোখে দেখে এবং তাকে কাজ করতে বললে সে মনের আনন্দে অতিরিক্ত কাজ করে, যা মামির জন্য আরও অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। মামি যখন তাকে পড়াশোনার দিকে মনোযোগী হতে বলেন, তখন ফটিকের কাছে তা ছিল ‘নিষ্ঠুর অবিচার’। স্কুলে ফটিক ‘নির্বোধ ও অমনোযোগী’ হিসেবে পরিচিত ছিল এবং মাস্টারমশাইয়ের মারধোর ও অপমান তাকে মানসিকভাবে ভেঙে দেয়। মামাতো ভাইয়েরা পর্যন্ত তার সাথে সম্পর্ক রাখতে লজ্জা অনুভব করত।

একদিন বই হারিয়ে ফেলায় মামির বিরক্তি আরও বেড়ে যায়। তিনি বলেন, “আমি তোমাকে মাসের মধ্যে পাঁচবার করে বই কিনে দিতে পারি না।” ফটিকের মনে হয়, মামি তার অসুস্থতা ও অনাদরকে ‘অনর্থক উপদ্রব’ ও ‘অনাবশ্যক জ্বালাতন’ মনে করবেন। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয়, মামার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।

কিন্তু পুলিশের সাহায্যে ফিরিয়ে আনার পর তার দুরবস্থা আরও বেড়ে যায়। অসুস্থ অবস্থায় মামি তাকে ‘পরের ছেলেকে’ বাড়ি পাঠাতে বলেন। এইভাবে, ফটিক মামার বাড়িতে অপমান এবং অবজ্ঞার মধ্যে দিন কাটাতে থাকে। শেষ পর্যন্ত, সে মুক্তি পায় মৃত্যুর মধ্য দিয়ে, যা তার কষ্টের অবসান ঘটায়।

৫.“এই অকাল তত্ত্বজ্ঞানী মানব সকল প্রকার ক্রীড়ার অসাড়তা সম্বন্ধে নীরবে চিন্তা করিতে লাগিল।”-কার কথা বলা হয়েছে? কোন্ প্রসঙ্গে মন্তব্যটি করা হয়েছে? এই মন্তব্যের কারণ কী?

উঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পে ফটিকের ছোট ভাই মাখনলালের কথা বলা হয়েছে।

গল্পের একটি অংশে, বালকদল নদীর ধারে একটি বড় শালকাঠের গুঁড়ি গড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। অন্যরা আনন্দিত ও উৎসাহী, কিন্তু মাখনলাল সম্পূর্ণ উদাসীন। তার মুখের গাম্ভীর্য এবং মনোভঙ্গি এ সময়ে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়।

যখন অন্য শিশুরা খেলার দিকে মনোযোগ দেয়, মাখনলাল গুঁড়ির ওপর বসে থাকে এবং কারো চাপাতেও সাড়া দেয় না। এই আচরণ তাকে ‘অকাল তত্ত্বজ্ঞানী’ হিসেবে চিহ্নিত করে, যিনি খেলাধুলার অসারতা নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন। তার এই অবস্থান মূলত জীবনের উদ্দেশ্য ও আনন্দের প্রকৃতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

মাখনলালের চরিত্রের মাধ্যমে লেখক পাঠকদেরকে মনে করিয়ে দেন যে, সব কিছু আনন্দের নয় এবং মাঝে মাঝে চিন্তা-ভাবনার গুরুত্বও অনস্বীকার্য। এই দৃষ্টিভঙ্গি গল্পের গভীরতা ও ভাবনাকে আরও বৃদ্ধি করে।

৬. নদীর ধারে বালকদলের খেলার দৃশ্যটি নিজের ভাষায় বর্ণনা করো।

উঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পে নদীর ধারে বালকদলের দুটি খেলার দৃশ্য অত্যন্ত প্রতীকী। প্রথম দৃশ্যে, ফটিক একটি প্রকাণ্ড শালকাঠের গুঁড়ি নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। সে বুঝিয়ে দেয় যে, যদি তারা এই গুঁড়িটি গড়িয়ে নেয়, তখন কাঠের মালিকের জন্য এটি অসুবিধার কারণ হবে। তার এই চতুর পরিকল্পনা অন্য সদস্যরা সম্পূর্ণ সমর্থন করে এবং তারা সকলে মিলে কাজে লিপ্ত হয়। কিন্তু ফটিকের ছোট ভাই মাখনলাল হঠাৎ করে গম্ভীর হয়ে গুঁড়ির ওপর উঠে বসে। তার এই আচরণ দলের আনন্দে বাধা দেয়। কিছু বালক এসে তাকে ঠেলতে চেষ্টা করে, কিন্তু মাখন স্থির থাকে এবং কোনোভাবেই তার অবস্থান পরিবর্তন করে না। ফটিক এসে তার ভাইকে তিরস্কার করে, কিন্তু মাখনলাল অপরিবর্তিত থাকে, যেন সে স্থায়ীভাবে সেখানে বসে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

দ্বিতীয় দৃশ্যে, ফটিক মাখনের স্থির মনোভাব দেখে নতুন একটি পরিকল্পনা তৈরী করে। সে প্রস্তাব দেয় যে, মাখনকে গুঁড়ির সঙ্গে গড়িয়ে দিতে হবে, যা তার গৌরবের বিষয় হবে। কিন্তু মাখন বিপদের সম্ভাবনা চিন্তা না করে উল্লাসের সঙ্গে রাজি হয়। খেলার শুরুতেই তার গম্ভীর অবস্থান বিপর্যয়ে পরিণত হয়; সে মাটিতে পড়ে যায়। অন্যান্য বালকেরা প্রথমে আনন্দিত হলেও ফটিক মাখনের বিপর্যয়ে হতাশ হয়ে পড়ে। মাখন দাদার ওপর রাগ প্রকাশ করে এবং কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির দিকে চলে যায়, ফলে বালকদের খেলা ভেঙে যায়।

এই দুই দৃশ্যের মাধ্যমে লেখক শিশুদের মনের জটিলতা, খেলার আনন্দ এবং তার বিপরীত ফলাফলকে চিত্রিত করেছেন। মাখনলালের গম্ভীরতা এবং তার পরিণতি গল্পের গভীরতা বাড়ায়, যা পাঠকদের জন্য চিন্তার জায়গা তৈরি করে।

৭. “এমন সময়ে সেই কাঁচাপাকা বাবুটি ঘরে ঢুকিয়া বলিলেন…”-‘কাঁচাপাকা বাবুটি’ কে ছিলেন? ‘সেই’ শব্দটি দিয়ে কী বোঝানো হয়েছে? তিনি কখন ঘরে ঢুকেছিলেন?

উঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পে ‘কাঁচাপাকা বাবুটি’ বা বিশ্বম্ভরবাবুর চরিত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি যখন নৌকা থেকে নামেন, তখন ফটিক একটি নৌকার গলুইয়ের ওপর বসে কাশের গোড়া চিবাচ্ছিল। বিশ্বম্ভরবাবু ফটিকের কাছ থেকে ‘চক্রবর্তীদের বাড়ি’র ঠিকানা জানতে চান, কিন্তু ফটিকের অদ্ভুত নির্দেশনায় কেউ বুঝতে পারে না। তার এই অভিজ্ঞতা লেখকের মাধ্যমে ফটিকের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে।

পরে, মাখনলাল যখন গুঁড়িসহ গড়িয়ে পড়ে বাড়িতে ফিরে আসে এবং কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে অভিযোগ করে যে ফটিক তাকে মেরেছে, তখন ঘটনা নতুন মোড় নেয়। ফটিকের মা, মাখনের প্রতি স্নেহশীলা হয়ে উঠেন এবং ফটিককে ডেকে নিয়ে আসার জন্য বাঘা বান্দিকে পাঠান। ফটিক মারার কথা অস্বীকার করে, কিন্তু মাখন তার অভিযোগে অনড় থাকে। এই অবস্থায় ফটিক ক্রোধে মাখনকে সত্যিই একটি চড় মারার জন্য উঠে পড়ে।

ফটিকের মা ফটিককে পালটা চড় মারলে তার ক্রোধ আরও বেড়ে যায় এবং সে তার মাকে ঠেলে দেয়। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বম্ভরবাবুর আগমন ঘটে, যা পুরো ঘটনায় একটি নতুন রসিকতা এবং উত্তেজনা যোগ করে। বিশ্বম্ভরবাবুর উপস্থিতি গল্পের গতিপথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনে দেয়, যা ফটিকের এবং তার পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের জটিলতাকে আরও বৃদ্ধি করে।

এভাবে, বিশ্বম্ভরবাবুর চরিত্র এবং তার কার্যকলাপ গল্পের আবহ তৈরি করে এবং পরিবারের সম্পর্কের নানান দিককে তুলে ধরে।

৮.“বিধবা এ প্রস্তাবে সহজেই সম্মত হইলেন।”-কে, কী প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং কখন? সেই প্রস্তাবে বাড়ির সকলের প্রতিক্রিয়া কী ছিল?

উঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পে ফটিকের মামা বিশ্বম্ভরবাবু, দীর্ঘদিন পর দেশে ফিরে তাঁর বোনের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। কয়েকদিন থাকার পর বিদায়ের আগে তিনি তার বোনের কাছে ছেলেদের পড়াশোনা এবং আচরণ সম্পর্কে জানতে চান। ফটিকের মা ফটিকের অবাধ্যতা, উচ্ছৃঙ্খলতা এবং পড়াশোনায় অনীহা নিয়ে অভিযোগ করেন, অন্যদিকে মাখনলালের শান্ত স্বভাব এবং পড়াশোনায় আগ্রহের প্রশংসা করেন।

এই কথা শুনে বিশ্বম্ভরবাবু ফটিককে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে নিজের কাছে রেখে লেখাপড়া শেখানোর প্রস্তাব দেন। ফটিকের মা এতে সহজেই সম্মতি দেন, কারণ ফটিকের বিরুদ্ধে তার অভিযোগ ছিল দীর্ঘ এবং তিনি সবসময় আশঙ্কা করতেন যে ফটিক কখনও মাখনলালকে কোনো বিপদে ফেলবে। অন্যদিকে, ফটিক এই প্রস্তাবে অত্যন্ত খুশি হয়। মামার সঙ্গে যাওয়ার জন্য সে এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়ে যে তার ঘুমও হয় না।

যাওয়ার আগে ফটিক তার সমস্ত খেলার সরঞ্জাম, যেমন ছিপ, ঘুড়ি, লাটাই—সবকিছুর অধিকার মাখনকে দিয়ে যায়। ফটিকের মা এই প্রস্তাবে সম্মতি দিলেও, ফটিকের অতিরিক্ত উত্তেজনা তাকে কিছুটা বিরক্ত করে।

৯. “… পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই।”-কাকে ‘বালাই’ বলা হয়েছে? লেখককে অনুসরণ করে এই মনোভাবটি বিশ্লেষণ করো।

উঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পে, ফটিককে বালাই বলা হয়েছে।

ফটিকের মামা বিশ্বম্ভরবাবু যখন তাকে কলকাতায় নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন, তখন তার স্ত্রী ফটিকের উপস্থিতি সহজভাবে মেনে নিতে পারেন না। তার নিজের তিন সন্তানের দেখাশোনার মধ্যে আরেকজন কিশোরের দায়িত্ব নেওয়াকে তিনি বিরক্তির চোখে দেখেন। বিশ্বম্ভরবাবুর স্ত্রী মনে করেন, ফটিকের বয়সজনিত অবস্থাটা বাড়ির পরিবেশের সঙ্গে ঠিক মানানসই নয়।

এই পরিস্থিতিতে লেখক অনুভব করেন যে তেরো-চোদ্দো বছরের ছেলেরা একপ্রকার সমস্যার সৃষ্টি করে। এ বয়সের ছেলেদের তেমন কোনো শোভা থাকে না, আবার তারা কাজেও বিশেষভাবে সহায়ক হয় না। তাদের আচরণে স্নেহ বা আনন্দের জন্ম হয় না, বরং বিরক্তি সৃষ্টি করে। লেখক এ বয়সের ছেলেদের প্রসঙ্গে বলেন, তারা আধো-আধো কথা বললে ন্যাকামি মনে হয়, আর পাকা কথা বললে তা জ্যাঠামির মতো শোনায়। তাদের আচরণকে প্রগলভতার শামিল ধরা হয়।

কৈশোরের এই সময়টায় শৈশবের সৌন্দর্য এবং কণ্ঠের মাধুর্য হারিয়ে যায়, যা পরিবারকে আরও বিব্রত করে তোলে। শিশুকাল এবং যৌবনের ভুলগুলো সহজে মাফ করা গেলেও, কৈশোরের এই অদ্ভুত রূপান্তরের ত্রুটিগুলোকে সকলেই অসহ্য বলে মনে করে। 

 

১০.“সুতরাং তাহার চেহারা এবং ভাবখানা অনেকটা প্রভুহীন পথের কুকুরের মতো হইয়া যায়।”-কার সম্পর্কে এ কথা বলা হয়েছে? তার সম্পর্কে এই মন্তব্যের কারণ আলোচনা করো।

উঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পের তেরো-চোদ্দো বছরের ছেলে ফটিক সম্পর্কে এ কথা বলা হয়েছে।

ফটিক, এমন একটি অবস্থায় রয়েছে, যেখানে তাকে পৃথিবীর সবাই "বালাই" বলে মনে করে। যখন ফটিক তার মামা বিশ্বম্ভরবাবুর সঙ্গে তার বাড়িতে যায়, তখন তার মামীর মনোভাব তাকে মেনে নিতে পারেনি। মামীর কাছে ফটিকের উপস্থিতি একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল, কারণ তিনি নিজস্ব নিয়মে তার তিন ছেলেকে নিয়ে সংসার চালাচ্ছিলেন। ফটিকের বয়স ও তার আচরণ মামীর কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। এই বয়সে ছেলেরা আচরণে ও কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন আনায় তাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশে তারা সহজে মিশতে পারে না।

ফটিকের মতো কৈশোর-যৌবনের সন্ধিক্ষণে থাকা একটি ছেলে নিজেও অনুভব করে যে, সে যেন পৃথিবীর কোনো কিছুর সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারছে না। তার নিজের অস্তিত্বের জন্য সে সবসময় লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী থাকে। এমনকি সে স্নেহের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে, যেটি সে ছোটবেলায় পেয়েছিল। তবে, তার প্রতি কেউ স্নেহ প্রকাশ করতে সাহস পায় না, কারণ সেটিকে প্রশ্রয় হিসেবে ধরা হতে পারে। এই কারণে তার অবস্থান এমন হয়ে দাঁড়ায়, যেন সে প্রভুহীন পথের কুকুরের মতো।