🌹একাদশ শ্রেণির বাংলা(সেমিস্টার-২):শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাস:অধ্যায়-২: উনবিংশ শতাব্দীর সামাজিক, ধর্মীয় ও শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন: প্রশ্নোত্তর(প্রশ্নের মান-২,৩,৫)🌹

📚একাদশ শ্রেণির বাংলা(সেমিস্টার-২):শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাস:অধ্যায়-২: উনবিংশ শতাব্দীর সামাজিক, ধর্মীয় ও শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন: প্রশ্নোত্তর(প্রশ্নের মান-২,৩,৫)📚

 

✍️প্রশ্নের মান-২:

 ১. ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ কারা প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর উদ্দেশ্য কী ছিল?

উত্তর: ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্মধর্মের প্রচার এবং শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের অন্ধকার দূর করা ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনকে জোরদার করা।

২. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় নবজাগরণের কী প্রভাব দেখা যায়?

উত্তর: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে নবজাগরণের জাতীয়তাবাদী চেতনা তুলে ধরেন। তাঁর উপন্যাস **আনন্দমঠ**-এ "বন্দে মাতরম" গানটি বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে।

৩. নবজাগরণের প্রভাব বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতিতে কিভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল?

উত্তর: নবজাগরণের প্রভাবে বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতিতে পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্যশিল্পের মেলবন্ধন ঘটে। সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, নাটক প্রভৃতিতে নতুন চিন্তাধারার সূচনা হয়, যা পরে রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে বিশ্বমঞ্চে ছড়িয়ে পড়ে।

৪. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান কী ছিল?

উত্তর: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক। তাঁর অবদান ছিল বিধবা বিবাহ আইন প্রবর্তন (১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দ), নারীশিক্ষার প্রসার, এবং বাংলা গদ্যের উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন।

৫. বাংলার নবজাগরণের অন্যতম নারীশিক্ষা আন্দোলনের নেত্রী কে ছিলেন?

উত্তর: বাংলার নবজাগরণের অন্যতম নারীশিক্ষা আন্দোলনের নেত্রী ছিলেন পণ্ডিত রমাবাই। তিনি নারীশিক্ষার উন্নয়ন এবং নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

৬. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শান্তিনিকেতন কবে প্রতিষ্ঠিত হয়?

উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে। পরবর্তীতে এটি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত হয়।

৭. বাংলা ভাষায় প্রথম সাহিত্য পত্রিকা কোনটি? কবে এটি প্রকাশিত হয়?

উত্তর: বাংলা ভাষায় প্রথম সাহিত্য পত্রিকা ছিল **দিগদর্শন**, যা ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এটি জনসাধারণের মাঝে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব বিস্তার ও সাহিত্যচর্চার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৮. উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের বৈপ্লবিক ঘটনা কী কী?

উত্তর: উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের দুটি উল্লেখযোগ্য বৈপ্লবিক ঘটনা হলো:
   ১) ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা।
   ২) সাহিত্যের বাহন হিসেবে বাংলা গদ্যের আত্মপ্রকাশ।

৯. মধ্যযুগে ব্রাহ্মধর্ম আন্দোলনের দুজন নেতার নাম লেখো। তাঁরা কীভাবে ধর্মের অন্ধত্ব ও গোঁড়ামি থেকে মুক্তি ঘটিয়েছিলেন?

উত্তর: ব্রাহ্মধর্ম আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য দুজন নেতা ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কেশবচন্দ্র সেন।  
তাঁরা ঔপনিষদিক ও বৈদান্তিক ধর্মের পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে ধর্মীয় অন্ধত্ব ও গোঁড়ামি থেকে মুক্তি দেন।

১০. ‘পার্থেনন’ পত্রিকা কারা প্রকাশ করেছিলেন? এই পত্রিকায় তাঁরা কী ঘোষণা করেছিলেন?

উত্তর: ‘পার্থেনন’ পত্রিকা হিন্দু কলেজের ছাত্ররা প্রকাশ করেছিলেন।  
এই পত্রিকায় তাঁরা ঘোষণা করেন যে, জন্মসূত্রে হিন্দু হলেও শিক্ষায় ও আচরণে তারা ইউরোপীয় চিন্তাধারার অনুসারী।

১১. ‘একাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ কে প্রতিষ্ঠা করেন? এর লক্ষ্য কী ছিল?

উত্তর: হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ‘একাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা করেন।  
এর লক্ষ্য ছিল সমাজ, নীতি এবং ধর্মীয় বিষয়ে যুক্তিনির্ভর আলোচনা করা।

১২. ডিরোজিও প্রতিষ্ঠিত আন্দোলনটির নাম কী? এর লক্ষ্য কী ছিল?

উত্তর: ডিরোজিওর প্রতিষ্ঠিত আন্দোলনের নাম ছিল ‘ইয়ং বেঙ্গল’ আন্দোলন।  
এর লক্ষ্য ছিল যুক্তিবাদ বিস্তার এবং ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরোধিতা।

১৩. ডিরোজিও কে ছিলেন? তাঁর দুজন অনুগামী বন্ধু-শিষ্যের নাম লেখো।

উত্তর: হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও ছিলেন হিন্দু কলেজের অধ্যাপক এবং ‘ইয়ং বেঙ্গল’ আন্দোলনের প্রবর্তক।  
তাঁর দুজন অনুগামী বন্ধু-শিষ্য ছিলেন কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রামগোপাল ঘোষ।

১৪. নবজাগরণের প্রভাবে উনিশ শতকে যে-সমস্ত সামাজিক প্রথা রদ করা সম্ভব হয়েছিল তা উল্লেখ করো।

উত্তর: নবজাগরণের চেতনায় আলোকিত বাঙালি মনীষীরা ঔপনিবেশিক শাসকদের সহায়তায় বিভিন্ন অন্ধসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। এর ফলে সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, নদীতে সন্তান বিসর্জন, এবং বহুবিবাহের মতো কুসংস্কার রদ করা সম্ভব হয়েছিল। জাতপাত, বর্ণভেদ, এবং অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধেও মানুষ সচেতন হয়েছিল।

১৫. ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশন কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? এর বর্তমান নাম কী?

উত্তর: ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশন ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়।  
এর বর্তমান নাম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।

১৬. বর্তমান স্কটিশ চার্চ কলেজের পূর্বতন নাম কী ছিল? কবে এই কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়?

উত্তর: স্কটিশ চার্চ কলেজের পূর্বতন নাম ছিল জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন।  
এই কলেজ ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৭. ক্যালকাটা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, শিবপুর কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? এর বর্তমান নাম কী?

উত্তর: ক্যালকাটা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, শিবপুর প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে।  
বর্তমানে এর নাম ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (IIEST)।

১৮. নবজাগরণের প্রভাবে বিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা এবং নারীশিক্ষার জন্য তৈরি হওয়া দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম ও তাদের প্রতিষ্ঠাকাল উল্লেখ করো।

উত্তর: নবজাগরণের প্রভাবে বিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য তৈরি হওয়া উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান হলো অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স (১৮৭৬)।  
নারীশিক্ষার প্রসারে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো বেথুন কলেজ (১৮৭৯)।

১৯. হিন্দু কলেজের বর্তমান নাম কী? এর প্রতিষ্ঠাকাল লেখো।

উত্তর: হিন্দু কলেজের বর্তমান নাম প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় (২০১০ সালে একে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দেওয়া হয়)।  
হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠাকাল ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দ।

২০. ‘নবজাগরণের কাল’ হিসেবে কোন্ সময়কালকে চিহ্নিত করা হয়?

উত্তর: উনিশ শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষা সংস্কৃতির অভিঘাতে বাঙালির চেতনাজগতে ও কর্মকাণ্ডে যে পরিবর্তন আসে, সেই সময়কালকেই নবজাগরণের সূচনাকাল বলা হয়ে থাকে। সাধারণত রামমোহন রায়ের সময় (১৭৭৫-১৮৩৩) থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু (১৯৪১) পর্যন্ত সময়কে নবজাগরণের কাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

 

✍️প্রশ্নের মান-৩:

১.নবজাগরণের ফলে নারীদের অবস্থানে কী পরিবর্তন এসেছে?

উত্তর:
(1) **নারীশিক্ষার বিস্তার:** নবজাগরণের ফলে নারীশিক্ষার দিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়। নারীদের জন্য নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, যেমন হিন্দু মহিলা বিদ্যালয় ও বেথুন কলেজ, যা নারীদের শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করে।

(2) **নারী আন্দোলনের উন্মেষ:** নারীদের অধিকার এবং স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এই সময় নারীরা নিজেদের অধিকারের জন্য সংগঠিত হতে শুরু করে, যা নারী আন্দোলনের ভিত্তি গড়ে তোলে।

২.নবজাগরণের প্রভাবে বাংলার সংস্কৃতিতে কী পরিবর্তন ঘটেছিল?

উত্তর: 
(1) **নতুন শিল্পধারার উদ্ভব:** নবজাগরণের ফলে বাংলা সংস্কৃতিতে নতুন শিল্পধারা ও রীতির উদ্ভব ঘটে। নাটক, কবিতা এবং সংগীতে পাশ্চাত্য প্রভাব স্পষ্টভাবে দেখা যায়। গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো নাট্যকাররা পাশ্চাত্য নাট্যরীতির থেকে অনুপ্রাণিত হন।

(2) **লোকসংস্কৃতির পুনর্জাগরণ:** এই সময় বাঙালি সমাজে লোকসংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন লোকশিল্প, গান ও নৃত্যের পুনর্জাগরণ ঘটে, যা আধুনিক শিল্পের সাথে মিলিত হয়।

৩.নবজাগরণের ফলে সমাজে বৌদ্ধিক পরিবর্তনের লক্ষণ কী কী ছিল?

উত্তর: 
নবজাগরণের ফলে সমাজে যে বৌদ্ধিক পরিবর্তন ঘটে, তার কিছু প্রধান লক্ষণ হলো:

- **অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ:** মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং তারা সমাজে প্রচলিত অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করে।
- **পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার:** নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গঠিত হয়, যা উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞানচেতনা ও নারীদের শিক্ষার প্রসারে ভূমিকা রাখে।
- **নতুন ভাবনার উদ্ভব:** ধর্ম, জাতপাত এবং নারীর অবস্থান বিষয়ে নতুন প্রশ্ন সৃষ্টি হয়, যা সমাজের কাঠামোকে নতুন করে ভাবতে উৎসাহিত করে।
- **নারী অধিকারের প্রচার:** নারীর অধিকারের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং সমাজে নারীর ভূমিকা নিয়ে নতুন চিন্তাভাবনা তৈরি হয়।

৪.নবজাগরণের ফলে বাংলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কী পরিবর্তন ঘটেছিল?

উত্তর:
নবজাগরণের ফলে বাংলার শিক্ষাব্যবস্থায় একাধিক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে, বিশেষ করে নারীদের শিক্ষার দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়। নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব হয়, যা পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে সহায়ক হয়। উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে:

- সংস্কৃত কলেজ (১৮২৪)
- জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন (১৮৩০)
- মেডিকেল কলেজ (১৮৩৫)
- মতিলাল শীল ফ্রি স্কুল অ্যান্ড কলেজ (১৮৪২)
- প্রেসিডেন্সি কলেজ (১৮৫৫)
- কলকাতা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, শিবপুর (১৮৫৬)
- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫৭)
- বিদ্যাসাগর কলেজ (১৮৭২)
- হিন্দু মহিলা বিদ্যালয় (১৮৭৩)
- বেথুন কলেজ (১৮৭৯)

৫. পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রভাব বাঙালি জীবনে কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল?

উত্তর:
উনিশ শতকে বাংলাদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাব বিশেষ করে শিক্ষিত সমাজে লক্ষ্য করা যায়। যদিও এটি প্রধানত উচ্চশিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, শহুরে মধ্যবিত্তের মধ্যে একটি নতুন ভাবনা ও চেতনার জাগরণ ঘটে। এই পরিবর্তনের ফলে বাঙালিরা প্রচলিত নিয়ম ও সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি প্রশ্ন তোলার সাহসী হয়ে ওঠে। এর ফলে, সমাজে নতুন চিন্তার উন্মেষ ঘটে এবং যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে।

 

✍️প্রশ্নের মান-৫:

 

১.উনিশ শতকের নবজাগরণের ক্ষেত্রে ডিরোজিওর ভূমিকা আলোচনা করো।

উত্তর: উনিশ শতকের নবজাগরণের সময় ভারতীয় সমাজে যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতার আবির্ভাব ঘটে। এই পরিবর্তনের পথিকৃৎ ছিলেন লুই হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিও। তিনি হিন্দু কলেজে শিক্ষক ছিলেন এবং ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের সূচনা করেন। এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল ভারতীয় যুবকদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও আধুনিক চিন্তাভাবনা প্রচার করা।

ডিরোজিওর নেতৃত্বে যুবকরা সামাজিক বৈষম্য, লিঙ্গ বৈষম্য, বাল্যবিবাহ, এবং সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। ডিরোজিও স্বাধীনতা, সাম্য, এবং ভ্রাতৃত্বের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। ১৮২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন বিভিন্ন সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় বিষয় নিয়ে যুক্তিপূর্ণ আলোচনার কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে।

হিন্দু কলেজের ছাত্ররা ১৮৩০ সালে ‘পার্থেনন’ পত্রিকা প্রকাশ করে, যা প্রগতিশীলতার প্রচারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। ডিরোজিওর প্রভাবে ছাত্রদের মধ্যে প্রচলিত রীতির প্রতি অনাস্থা, দেবদেবীর প্রতি অশ্রদ্ধা, এবং ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের প্রতি অবিশ্বাস গড়ে ওঠে। এভাবে, ডিরোজিও ভারতীয় যুবকদের মধ্যে নতুন চিন্তাধারার প্রসার ঘটান এবং সমাজের সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

২.উনিশ শতকের ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলনের পটভূমিকায় ব্রাহ্মসমাজের অবদানের কথা আলোচনা করো।

উত্তর:ব্রাহ্মসমাজ উনিশ শতকের ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই আন্দোলনের নেতারা প্রাচীন বৈদান্তিক এবং ঔপনিষদিক ধর্মের নতুন মূল্যায়ন করেন। তাঁরা মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতা ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এক নতুন চিন্তাধারার উন্মেষ ঘটান, যা সমাজে একেশ্বরবাদের ভিত্তিতে নতুন ধর্মীয় ভাবনা প্রতিষ্ঠা করে।

ব্রাহ্মসমাজের লক্ষ্য ছিল আচার-অনুষ্ঠানের রক্ষণশীলতা থেকে মুক্তি। তাঁরা সমাজের বিভিন্ন অনাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন, যা যুবকদের মধ্যে উদ্যম ও উৎসাহ জোগায়। ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে রামমোহন রায় ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর উল্লেখযোগ্য।

তাদের প্রচেষ্টার ফলে সমাজে নারী শিক্ষা, সমাজ সংস্কার ও ধর্মীয় সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রাহ্ম আন্দোলনের নেতা হেমচন্দ্র বিদ্যাসাগর নারী শিক্ষার পক্ষে সোচ্চার হন। পরবর্তীতে, এই আন্দোলনের নেতারা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন এবং ধর্মীয় মুক্তচিন্তার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ব্রাহ্মসমাজের এই পরিবর্তনগুলি ভারতের সামাজিক এবং ধর্মীয় চিত্রে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে।
 

৩.নবজাগরণের প্রভাবে ভারতীয় সংস্কৃতির কোন দিকগুলোর উন্নতি ঘটেছিল?

উত্তর:উনিশ শতকের নবজাগরণের ফলে ভারতীয় সংস্কৃতির বিভিন্ন দিকের উন্নতি ঘটে। এই সময় সাহিত্য, শিল্প, নাটক এবং সংগীতের মধ্যে আধুনিকতা ও নতুনত্বের প্রবাহ দেখা যায়। কবিতায় এবং নাটকে নতুন ধরনের রচনা প্রচলিত হয়, যেখানে সামাজিক সমস্যা ও মানবিক অভিজ্ঞতার প্রভাব প্রতিফলিত হয়।

নবজাগরণের ফলে ভারতীয় সাহিত্যে বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পায়, যা লেখকদের মধ্যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে সহায়ক হয়। এই সময়ে রামমোহন রায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো লেখকরা সমকালীন সমস্যা ও নতুন চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটান।

সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও আধুনিকতা দেখা যায়, যেখানে নতুন সুর ও রাগের আবিষ্কার হয়। বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের ভিত্তিতে চিন্তাভাবনার প্রসার ঘটে, যা সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে সহায়ক। নবজাগরণের প্রভাব ভারতীয় সংস্কৃতির বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং এটি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সূচনা করে।

৪.উনিশ শতকের শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনে ডিরোজিওর প্রভাব কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল?

উত্তর:উনিশ শতকের শিক্ষাব্যবস্থায় ডিরোজিওর প্রভাব সুস্পষ্ট। ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি শিক্ষার প্রথাগত পদ্ধতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে ডিরোজিও শিক্ষার্থীদের যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেন।

১৮২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম, যেখানে তারা বিভিন্ন সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় বিষয়ে আলোচনা করতে পারতেন। ডিরোজিওর প্রচেষ্টায় হিন্দু কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে আধুনিক শিক্ষার ধারণা গ্রহণ করে।

এই পরিবর্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন চিন্তাধারা এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে। তারা সামাজিক অনাচার, জাতীয়তা এবং স্বাধীনতার গুরুত্ব উপলব্ধি করে, যা পরবর্তীকালে সমাজে পরিবর্তনের সূচনা করে। ফলে, ডিরোজিওর শিক্ষা ও সংস্কৃতির ধারণা ভারতীয় সমাজে একটি নতুন যুগের সূচনা করে।

৫.সাহিত্যে নবজাগরণের প্রভাব কাদের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল তা আলোচনা করো।

উত্তর:উনিশ শতকের নবজাগরণের প্রভাব সাহিত্যে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো চিন্তাবিদদের মাধ্যমে নতুন চিন্তাধারার সূচনা ঘটে। তাঁদের লেখায় সমাজের নানা দিকের সমালোচনা এবং সংস্কারের আহ্বান তুলে ধরা হয়।

এরপর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো লেখকরা সাহিত্যে আধুনিকতার রূপ তুলে ধরেন। এ সময় নতুন ধরনের কবিতা, নাটক ও উপন্যাসের সৃষ্টি হয়, যা সমাজের সমস্যা, মূল্যবোধ এবং মানবিক অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করে।

সাহিত্যিকরা তাদের লেখায় যুক্তিবাদের মূল্যবোধ তুলে ধরেন, যা পাঠকদের মধ্যে নতুন ভাবনা ও অনুপ্রেরণা সঞ্চারিত করে। বিভিন্ন নাটক ও কবিতার মাধ্যমে সমকালীন সমস্যাগুলোর প্রতিফলন ঘটে, যা সমাজে পরিবর্তনের ডাক দেয়। সাহিত্যে নবজাগরণের এই প্রভাব ভারতীয় সংস্কৃতির বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
                          ................