📚বাংলা মেজর-2 ও মাইনর-2(Semester-II): অধ্যায়ভিত্তিক প্রশ্নোত্তর: অধ্যায়-৪:অনুবাদ সাহিত্য:ভাগবত,রামায়ণ ও মহাভারত।📚
✍️প্রশ্নমান-২:
প্রশ্ন : অনুবাদ সাহিত্য কাকে বলে?
উত্তর: অন্য ভাষার সাহিত্য থেকে কবি বা সাহিত্যিক যখন আরেকটি ভাষায় সাহিত্যটি রূপান্তর করে তখন তাকে অনুবাদ সাহিত্য বলে।
প্রশ্ন : অনুবাদ সাহিত্যের ধারাটি সৃষ্টির প্রেরণা কী ছিল?
উত্তর : পৌরাণিক আদর্শের প্রচার, রাজকীয় আনুকূল্য ও কাহিনীর রস আস্বাদনের প্রেরণায় অনুবাদ সাহিত্যটি সৃষ্টি হয়েছিল।
প্রশ্ন : বাংলার সাহিত্যের মধ্যযুগে অনুবাদ সাহিত্য কোন সামাজিক প্রেক্ষাপটে রচিত হয় ?
উত্তর : তুর্কী পাঠান রাজত্বকালে বিভিন্ন কারণে নিম্নবর্ণীয় হিন্দুরা মুসলিম ধর্মগ্রহণ করতে থাকলে হিন্দুধর্মকে রক্ষার তাগিদে, সমাজে সমন্বয়ের আদর্শ স্থাপন করার উদ্দেশ্যে পৌরাণিক আদর্শ সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার প্রয়োজনে অনুবাদ সাহিত্য মধ্যযুগে রচিত হয়।
প্রশ্ন : ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের অনুবাদ সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি কি কি?
উত্তর : ষোড়শ সপ্তদশ শতকের অনুবাদ সাহিত্যের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য হল চৈতন্য প্রভাবিত ভক্তিবাদের প্রভাব, গল্পরসের প্রাধান্য, ভাগবতের অনুবাদের পরিবর্তে কৃষ্ণলীলামূলক আখ্যান কাব্য রচনার প্রাধান্য, কল্পিত কাহিনীর প্রাধান্য, চরিত্র অঙ্কনে কোমলভাবের আরোপ।
প্রশ্ন : অষ্টাদশ শতকের অনুবাদ সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য কি কি?
উত্তর : অষ্টাদশ শতকে অনুবাদ সাহিত্যের পরিবর্তে পুরাণ অনুবাদের প্রাধান্য, যুগধর্মের প্রতিচ্ছবি, চটকদার গল্পের প্রাধান্য, আদি রসাত্মক প্রসঙ্গগীতি প্রভৃতি অষ্টাদশ শতকের অনুবাদ সাহিত্যে পরিলক্ষিত হয়।
প্রশ্ন : অনুবাদ সাহিত্যের প্রথমদিকের একটি বৈশিষ্ট্য কী?
উত্তর : মূলানুগত্য।
প্রশ্ন : বাংলা সাহিত্যের অনুবাদকেরা কোন সাহিত্যরীতিতে তাদের বাক্যগুলি রচনা করেন?
উত্তর : পাঁচালী রীতিতে।
প্রশ্ন : চতুর্দশ শতকে বাংলায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পর বাংলা সাহিত্যে যে বিশিষ্ট শাখার উদ্ভৰ হয় তার নাম কী?
উত্তর : অনুবাদ সাহিত্য।
প্রশ্ন : মালাধর বসুর জন্মস্থান কোথায় ? কত শতকে ?
উত্তর : মালাধর বসুর জন্মস্থান বর্ধমানের কুলীনগ্রাম। পঞ্চদশ শতকে।
প্রশ্ন : কয়েকজন ভাগবত অনুবাদকের নাম লেখ।
উত্তর : মালাধর বসু, রঘুনাথ ভাগবতাচার্য, কৃষ্ণদাস, নন্দরাম বোস, ভক্তরাম দাস।
প্রশ্ন : ভাগবতের প্রথম অনুবাদ কে করেন তাঁর রচিত গ্রন্থটির নাম কি?
উত্তর : ভাগবতের প্রথম অনুবাদ করেন মালাধর বসু। তাঁর রচিত গ্রন্থটির নাম শ্রীকৃষ্ণ বিজয় বা শ্রীকৃষ্ণ বিক্রম বা গোবিন্দ বিজয় বা গোবিন্দ মঙ্গল।
প্রশ্ন : মালাধর বসুর জীবনী ও কাব্যপ্রতিভা সম্পর্কে কে অনুসন্ধান করেন?
উত্তর : কেদারনাথ ভক্তি বিনোদ।
প্রশ্ন : মালাধর বসুর রচিত ভাগবত অনুবাদের নাম কী?
উত্তর : শ্রীকৃষ্ণবিজয় / গোবিন্দমঙ্গল।
প্রশ্ন : মালাধর বসুকে কে কী উপাধি দেন ?
উত্তর : গৌড়ের সুলতান রুকনুদ্দিন বরবক শাহই গুণরাজ খান উপাধি দিয়েছেন।
প্রশ্ন : মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণ বিজয়ের কাব্যের বিষয়বস্তু কী?
উত্তর : কৃষ্ণের জন্ম থেকে দেহত্যাগ পর্যন্ত।
প্রশ্ন : মালাধর বসুর পিতা ও মাতার নাম কী ?
উত্তর : পিতা— ভগীরথ, মাতা- ইন্দুমতী।
প্রশ্ন : কৃষ্ণবিজয় কটি পর্বে বিভক্ত ও কী কী ?
উত্তর : তিনটি পর্ব। আদি, মধ্য ও অন্ত্য লীলা।
প্রশ্ন : মালাধর বসু কোন কাব্য অবলম্বনে তার ভাগবত রচনা করেন ?
উত্তর : সংস্কৃত শ্রীমদ্ভগবত পুরাণের দশম ও একাদশ স্কন্ধের অবলম্বনে ভাগবত রচনা করেন।
প্রশ্ন : মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণ বিজয়ে কোন কোন গ্রন্থের প্রভাব আছে?
উত্তর : হরিবংশ, বিষ্ণুপুরাণ, লিঙ্গপুরাণ, যোগশাস্ত্র, মহাভারতের সভাপর্বের প্রভাব আছে।
প্রশ্ন : শ্রীকৃষ্ণ বিজয়ের আদি পর্বের কাহিনী কি?
উত্তর : বাসুদেব ও দেবকীর বিবাহ, দেবকীর গর্ভে কৃষ্ণের জন্ম, নন্দলালকর্তৃক পালন, ইন্দ্রযজ্ঞ নিষেধ, রাস অনুষ্ঠান, কৃষ্ণ বলরামের মথুরা গমন বিবৃত হয়েছে।
প্রশ্ন : শ্রীকৃষ্ণ বিজয়ের মধ্যপর্ব ও অন্তপর্বের কাহিনী কী?
উত্তর : মধ্যপর্বে শ্রীকৃষ্ণের মথুরালীলা, কংসবধ তৎপর দ্বারকাগমন পর্যন্ত বিবৃত হয়েছে।অন্ত্যপর্বে দ্বারকালীলা বর্ণিত হয়েছে। এতে রুক্মিণীর হরণ ও সত্যভামার সঙ্গে বিবাহ। উমার সঙ্গে সুভদ্রাহরণ, দ্বারকাপুরী ধ্বংস, কৃষ্ণের দেহত্যাগ বিবৃত হয়েছে।
প্রশ্ন : মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের বিশেষত্ব কী ?
উত্তর : শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বর্য্য রূপের বর্ণনা, উপাখ্যানের মৌলিকতা ও ভক্তিবাদ কাব্যের বিশেষত্ব ।
প্রশ্ন : শ্রীকৃষ্ণবিজয় গ্রন্থটির রচনাকাল সম্পর্কিত যে ছত্রটি পাওয়া যায় তা লেখ।
উত্তর : তেরশ পঁচানই শকে গ্রন্থ আরম্ভন
চতুর্দশ দুই শকে হৈল সমাপন।
প্রশ্ন : সংস্কৃত রামায়ণের আদি অনুবাদক কে? তাঁর অনূদিত রামায়ণের নাম কী ?
উত্তর : সংস্কৃত রামায়ণের আদি অনুবাদক কৃত্তিবাস ওঝা।
কৃত্তিবাসের অনুদিত রামায়ণের নাম- শ্রীরাম পাঁচালী।
প্রশ্ন : আনুমানিক কত খ্রিস্টাব্দে কৃত্তিবাসী রামায়ণ রচিত হয়? কবে মুদ্রিত হয় ?
উত্তর : আনুমানিক ১৫৯৬ খ্রিস্টাব্দে কৃত্তিবাসী রামায়ণ রচিত হয়। এই রামায়ণ ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর মিশন থেকে মুদ্রিত হয়।
প্রশ্ন : কৃত্তিবাসের পিতা ও মাতার নাম কী ?
উত্তর : কৃত্তিবাসের পিতা ও মাতার নাম যথাক্রমে বনমালী ও মালিনী।
প্রশ্ন : কৃত্তিবাসের আত্মকাহিনী কোন গ্রন্থে প্রথম প্রকাশ হয়?
উত্তর :নগেন্দ্রনাথ বসুর 'বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস' গ্রন্থের প্রথম খন্ডে কৃত্তিবাসের আত্মকাহিনী প্রকাশ পায়।
প্রশ্ন : কোন্ প্রাচীন গ্রন্থে কৃত্তিবাসের নাম আছে?
উত্তর : জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল' -এ কৃত্তিবাসের নাম আছে।
প্রশ্ন : কৃত্তিবাসী রামায়ণ মোট ক'টি খন্ডে বিভক্ত?
উত্তর : কৃত্তিবাসী রামায়ণ মোট সাতটি খন্ডে বিভক্ত।
প্রশ্ন : কৃত্তিবাসের জন্মবিবরণীবাচক শ্লোকটি কী ? তার আত্মবিবরণীর প্রথম সন্ধান কে পান ?
উত্তর : জন্মবিবরণী বাচক শ্লোক “আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী পুণ্য মাঘ মাস। /তথিমধ্যে জন্ম লইলাম কবি কৃত্তিবাস।”
তাঁর আত্মবিবরণীর প্রথম সন্ধান পান হারাধন দত্ত।
প্রশ্ন : কৃত্তিবাসের জন্মতারিখ কত?
উত্তর : কৃত্তিবাসের জন্মতারিখ ১৪৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ই জানুয়ারি।
প্রশ্ন : কৃত্তিবাস ওঝা কোথায় জন্মগ্রহণ করেন? তিনি কার পৃষ্ঠপোষকতা অর্জন করেন ?
উত্তর : কৃত্তিবাস ওঝা ফুলিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি জালালউদ্দীন মহম্মদ শাহ্র পৃষ্ঠপোষকতা অর্জন করেন।
প্রশ্ন : রামায়ণ অনুবাদে কৃত্তিবাস গ্রহণ ও বর্জন করেছেন এমন দুটি বিষয়ের নাম কর।
উত্তর : বাঙালির গল্প পিপাসা চরিতার্থ করতে কৃত্তিবাস গ্রহণ করেছেন এবং বর্জন করেছেন আদিকবির রামায়ণের কিছু অংশ।
ক।। গ্রহণ করেছেন : গণেশের জন্ম, কৈকেয়ীর বরলাভ, গুহক চন্ডাল প্রসঙ্গ, তরণীসেন মহীরাবণ-অহিরাবণ কাহিনি প্রভৃতি
খ।। বর্জন করেছেন : কার্তিকের জন্ম, বশিষ্ঠ কাহিনি, বিশ্বামিত্র প্রসঙ্গ ইত্যাদি।
প্রশ্ন : কৃত্তিবাসী রামায়ণে কেথায় বাঙালিয়ানার ছাপ পড়েছে?
উত্তর : কৃত্তিবাসী রামায়ণে বাঙালির দৈনন্দিন জীবনের ছায়াপাত ঘটেছে। যেমন-(ক) রাম-লক্ষ্মণের সৌভ্রাতৃত্ব, (খ) সীতার সর্বংসহ দুঃখময় বধূজীবন,
(গ) হনুমানের দাস্যভক্তি, (ঘ) সুগ্রীব-বিভীষণের সৌহার্দ্য ইত্যাদি প্রসঙ্গ।
প্রশ্ন: কৃত্তিবাসী রামায়ণে কোন্ ছন্দের প্রয়োগ লক্ষণীয় ?
উত্তর : কৃত্তিবাসী রামায়ণে পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দের প্রয়োগ লক্ষ্যণীয়। পয়ারের প্রবাহমানতা এ কাব্যে রবীন্দ্রনাথকথিত তানপ্রধান মোহনীয় সুরের আবেশ
তৈরি করেছে।
প্রশ্ন : বাংলা ভাষায় মহাভারতের আদি অনুবাদক কে? তার কাব্যের নাম কী ?
উত্তর : বাংলা ভাষায় মহাভারতের আদি অনুবাদক কবীন্দ্র পরমেশ্বর।তার কাব্যের নাম 'পান্ডববিজয়' বা ভারত পাঁচালী'।
প্রশ্ন : পরাগলী মহাভারত কী ?
উত্তর : কবীন্দ্র পরমেশ্বর ছিলেন চট্টগ্রামের শাসক পরাগল খাঁর সভাকবি। পরাগল খাঁ ছিলেন বিদ্যোৎসাহী, কাব্যানুরাগী ও হিন্দু সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি অনুরক্ত। পরাগলের উৎসাহে কবির কাব্য রচিত হয় বলে তাঁর কাব্যকে 'পরাগলী মহাভারত' বলা হয়।
প্রশ্ন : ছুটিখানি মহাভারত কী ?
উত্তর : চট্টগ্রামের শাসনকর্তা পরাগল খাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ছুটি খাঁ-এর আদেশে সভাকবি শ্রীকর নন্দী জৈমিনি মহাভারত অবলম্বনে বাংলা ভাষায় মহাভারত রচনা করেন। পৃষ্ঠপোষক ছুটি খাঁর নির্দেশে কবি শ্রীকর নন্দী মহাভারতের অনুসরণে শুধুমাত্র ‘অশ্বমেধ পর্ব' রচনা করেন—সেই মহাভারতই ছুটি খাঁনি মহাভারত।
প্রশ্ন : সঞ্জয়ের মহাভারত কার সম্পাদনায়, কোথা থেকে পূর্ণাঙ্গরূপে প্রকাশিত হয়েছে?
উত্তর : মনীন্দ্র ঘোষের সম্পাদনায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সঞ্জয়ের মহাভারতের পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে।
প্রশ্ন : কাশীরাম দাসের জন্ম কোথায়? পিতার নাম কী?
উত্তর : কাশীরাম দাসের জন্ম বর্ধমানের ইন্দ্রানী পরগণার অন্তর্গত সিঙ্গি (সিদ্ধি) গ্রামে, কায়স্থ বংশে। কাশীরামের পিতার নাম কমলাকান্ত।
প্রশ্ন : কাশীরামের কৌলিক পদবী কী? তিনি কার নির্দেশে মহাভারত অনুবাদ করেন ?
উত্তর : কাশীরামের কৌলিক পদবী দেব। তিনি বিনয়বশত, দেবের স্থানে দাস ব্যবহার করেন। তিনি অভিরাম মুখুটীর আশীর্বাদে ও নির্দেশে মহাভারত
অনুবাদ করেন।
প্রশ্ন : কাশীরামের মহাভারতের নাম কী? সেটি প্রথম কোথা থেকে মুদ্রিত হয়েছিল ?
উত্তর : কাশীরামের মহাভারতের নাম ‘ভারত পাঁচালী’।
সেটি প্রথম ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর মিশন থেকে মুদ্রিত হয়েছিল।
প্রশ্ন : কাশীরাম কোথায় বসে মহাভারত অনুবাদ করেন? তার মহাভারতের একটি মৌলিক উপাখ্যান কী ?
উত্তর : কাশীরাম হরিহরপুর গ্রামে বসে মহাভারত অনুবাদ করেন।তার মহাভারতের একটি মৌলিক উপাখ্যান – শ্রীবৎস কাহিনি'।
প্রশ্ন : কাশীদাসি মহাভারতের বৃহত্তম পর্ব ও ক্ষুদ্রতম পর্বর নাম কী ?
উত্তর : কাশীদাসি মহাভারতের বৃহত্তম পর্ব – শান্তি পর্ব। ক্ষুদ্রতম পর্ব – মহাপ্রস্থানিক পর্ব।
প্রশ্ন : কাশীদাসি মহাভারতের দ্বিতীয় সংস্করণ কবে, কার সম্পাদনায় কোথা থেকে প্রকাশিত হয় ?
কাশীদাসি মহাভারতের দ্বিতীয় সংস্করণ ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের সম্পাদনায় শ্রীরামপুর মিশন থেকে প্রকাশিত হয়।
✍️প্রশ্নমান-৫:
১.কাশীরাম দাসের মহাভারতের অনুবাদ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা কর।
উত্তর : কবি কৃত্তিবাস সংস্কৃতে রচিত বাল্মীকির রামায়ণ বাংলায় অনুবাদ করে বাঙালী কবিদের সম্মুখে এক বিরাট অনুবাদ জগতের দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন তার গতি অষ্টাদশ পর্যন্ত চলে। সেই অনুবাদগুলির মধ্যে মহাভারত হল উল্লেখযোগ্য। মূল মহাভারত ব্যাসদেব কর্তৃক সংস্কৃত ভাষায় রচিত বিরাট মহাকাব্য। এটি একটি
জাতির স্বরচিত স্বাভাবিক ইতিহাস।' কুরুপাণ্ডবের সংগ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কাহিনির পাশাপাশি আছে একাধিক শাখা কাহিনি। স্বভাবতই এই বিরাট মহাকাব্যকে সমগ্র অনুবাদ করতে কেউই সাহসী হয়নি। সর্বপ্রথম মহাভারতের কাহিনি সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ করেন শ্রীকর নন্দী, মতান্তরে, কবীন্দ্র পারমেশ্বর। এঁদের রচনার প্রায় দেড় শতক— পর সপ্তদশ শতাব্দীতে কাশীরাম দাস বাংলা ভাষার সর্বাঙ্গ সুন্দর ও বিরাট
মহাভারত রচনা করেন এবং তিনিই মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক। তাঁর কাব্যের নাম হল 'ভারত পাঁচালী' তবে কাশীদাসী মহাভারত নামেই অধিক প্রচলিত।
কাশীরাম দাস বর্ধমান জেলার ইন্দ্রানী পরগণার অন্তর্গত সিঙ্গি (সিদ্ধি) গ্রামে কায়স্থ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা-কমলা কান্তদেব । কবি কাশীরাম দাস ব্যাসদেবের বন্দনা
করে অনুবাদ কর্মে ব্রতী হয়েছে—
‘শ্লোকছন্দে সংস্কৃত বিরঢিলা ব্যাসে।
গীতিছন্দে কহি তাহা শুন অনায়াসে।”
তবে কবি সংস্কৃত মহাভারতের আক্ষরিক অনুবাদ করেননি।
করেছেন— ভাবানুবাদ। যার ফলে তিনি গুরুগম্ভীর রাজনৈতিক ও দার্শনিক তত্ত্বকথাপূর্ণ ভীষ্মপর্বের গীতা পর্বাধ্যায় বাদ দিতে পেরেছেন, পরিবর্তে বাঙালী মানস
উপযোগী কিছু কাহিনি সংযোজন করেছেন। যেমন শ্রীবৎস চিন্তার উপাখ্যান।
কাশীরাম দাস সংস্কৃত ভাষায় অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। তাঁর রচনা সংস্কৃত প্রভাবিত হলেও রচনার গতি কোথাও শ্লথ হয়নি, যেমন—
“সহস্র মুস্তক শোভে সহস্র নয়ন।
সহস্র মুকুটমণি কিরীট ভূষণ।।”
কবির কাব্যের ভাষা যেমন বিশুদ্ধ, ছন্দও তেমনি সুললিত। যদিও তাঁর কাব্যে পয়ার ছন্দের ব্যবহার বেশী তবে কিছু কিছু ত্রিপদীও আছে। আবার অলঙ্কারও অনুপম । বীররস প্রধান এই কাব্যটিতে চৈতন্যের প্রেমধর্মের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। তবে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের যে ছবি এঁকেছেন তা বাস্তবানুগ ও জীবন্ত। আসলে কবি তাঁর কাব্যে স্বার্থত্যাগের মহিমা, ভ্রাতৃপ্রীতি, মাতৃভক্তি, স্বজনপ্রীতি, সত্যনিষ্ঠা ও আধ্যাত্মিক আদর্শবোধ প্রকাশ করতে চেয়েছেন। সর্বোপরি তিনি বাঙালিয়ানাকেই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। তাই তাঁর কাব্য বৃত্তিবাসী রামায়ণের মতো জনপ্রিয় না হলেও বাঙালী
জীবনে তার প্রভাব কিন্তু সর্ববিদিত।
২.কাশীরাম দাস রচিত মহাভারতে কতটা বাঙালীয়ানার প্রকাশ ঘটেছে?
উত্তর : মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কাশীরাম দাস। তার রচিত গ্রন্থটির নাম “ভারত পাঁচালী”। জনমানসে তা “কাশীদাসী মহাভারত” নামেই পরিচিত। ১৮৩৬ খ্রীস্টাব্দে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের সম্পাদনায় ‘কাশীদাসী মহাভারত' মুদ্রিত হয়। এর ভাষার সঙ্গে ঊনিশ শতকের বাংলা ভাষার ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য আছে। কাশীরাম দাসের “ভারত পাঁচালী” অনুবাদ হলেও তা আক্ষরিক অনুবাদ নয়—ভাবানুবাদ বা সারানুবাদ। গ্রন্থটিতে কবির স্বকীয়তা বা মৌলিক প্রতিভার পরিচয়
পাওয়া যায়। বিভিন্ন পুরাণ-উপপুরাণ, জৈমিনি মহাভারতের আখ্যান এবং কিছু স্বরচিত কাহিনী এখানে স্থান পেয়েছে। সাধারণ মানুষের রসতৃষ্ণা চরিতার্থ করার জন্য তিনি তত্ত্ব, দর্শন ও নীতিকথা বাদ দিয়ে গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে কাহিনীকে দেশ-কাল ও বাঙালি মনের উপযোগী করে তুলেছেন। কবি সামাজিক ও পারিবারিক আদর্শ, ধর্মপ্রাণতা, নৈতিকতা, অতিথিসেবা, জীবে দয়া ও স্বার্থত্যাগের মহিমা প্রচার করে বাঙালি জীবনের উদার মানবধর্মকেই প্রচার করেছেন।
কাশীদাসি মহাভারত বাঙালিকে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার বিপুল শক্তি ও অনুপ্রেরণা দেয়। বাঙালির ধ্যান-ধারণা ও ভাবকল্পনার সঙ্গে কাশীরাম দাস মহাভারতের ভাবাদর্শকে যথাসম্ভব মিলিয়ে দিয়েছেন। সভ্যতার রূপবদলের তালে তালে বাঙালি জীবনেও কত পরিবর্তন হয়ে গেল। কিন্তু কাশীদাসি মহাভারতের কাব্যরসধারা অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার ন্যায় বাঙালির অন্তর্জীবনে কুলুকুলু নাদে প্রবাহিত। কাশীদাসি মহাভারত বাঙালির জীবনগীতা-একটি বড়ো ট্র্যাডিশন বা ঐতিহ্য। আসলে চৈতন্যোত্তর যুগের প্রেমভক্তির আদর্শ কবিকে অনুপ্রাণিত করেছিল। সেই কারণে তাঁর কাব্যে মহাভারতীয় চরিত্রগুলির মহাকাব্যিক উজ্জ্বলতা ম্লান হয়ে বাঙালীর কোমলতায় পর্যবসিত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কাশীরামের যুধিষ্ঠির শক্তিহীন ও ধর্মভীরু। দুর্বলের ক্রন্দন ও আক্ষেপ যুধিষ্ঠিরকে ভাবপ্রবণ বাঙালীতে পরিণত করেছে।
কাশীরামের কাব্য সপ্তদশ শতকের বাঙালী জীবনের কাব্য। বাংলার সমাজ এ কাব্যের পটভূমি। তাই ক্ষাত্রতেজদীপ্ত মহাভারত নয়, ভক্তিতে নৈতিকতায়,আনন্দে-হতাশায় এ কাব্য আপামর বাঙালীর ঘরের কথা। তাই সভাপর্বে আমরা দেখি,দ্রৌপদী-হিড়িম্বার কলহের মধ্যে বাঙালী সমাজের দুই সতীনের কলহের প্রকাশ। কাশীদাসি মহাভারতের সামাজিক ও পারিবারিক আদর্শ, ধর্মপ্রাণতা, নৈতিকতা, অতিথিসেবা, জীবে দয়া ও স্বার্থ ত্যাগের মহিমা বাঙালির উদার মানবধর্মকে প্রকাশ করেছে।
কৃত্তিবাসী রামায়ণের মত করুণারসের নির্ঝর না হয়েও এ কাব্য বাঙালী জীবনের ধ্যানধারণা ও ভাবকল্পনায় সমৃদ্ধ। এ কাব্য বাঙালীর জীবনযুদ্ধের কথা, বাঙালীর
জীবনপ্রবাহের জীবনগীতি ।
Sabir
৩.কৃত্তিবাসের কাব্যটি কোন্ সময়ে লেখা হয়? কবির কাব্যে বাঙালি জীবনের যে ছবি প্রকাশ পেয়েছে, তার বিবরণ দাও।
অথবা, রামায়ণের শ্রেষ্ঠ অনুবাদ গ্রন্থটির মধ্যে বাঙালির জীবন কতখানি প্রতিফলিত হয়েছে তা আলোচনা কর ।
উত্তর : রচনাকাল : কৃত্তিবাসের ‘রামায়ণ' কাব্যের কোনো পুঁথিতেই রচনাকালের উল্লেখ নেই। তবু বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, সম্ভবত পঞ্চদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে তাঁর এই কাব্যটি রচিত হয়।
বাঙালি জীবনালেখ্য হিসেবে রামায়ণ : কৃত্তিবাস বাল্মীকির ‘রামায়ণ' এর অনুসরণে তাঁর শ্রীরাম পাঁচালী রচনা করলেও বাল্মীকিকে পুরোপুরি অনুকরণ করেননি। কাহিনি, চরিত্র, পরিবেশ বর্ণনা প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাঁর নিজস্ব সংযোজন ঘটেছে। সমগ্র কাব্যটিকে তিনি রচনা করেছেন একজন বাঙালি কবির দৃষ্টিকোণ থেকে।
কৃত্তিবাসের এই কাব্যে সেকালের খাদ্য বেশভূষা, আচার-অনুষ্ঠান, রীতিনীতি প্রভৃতির পরিচয় আছে। গুহক গৃহে ভরতকে আপ্যায়ন করা হয় দধি, দুগ্ধ, নারকেল, আম, কলা প্রভৃতি দিয়ে। তাছাড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে এই কাব্যে গূড়পিঠে, তালবড়া, ছানাবড়া, নারকেল-পুলি, খাজা, গজা, জিলিপি, পায়েস, পিঠে প্রভৃতি বাঙালি খাবারের
উল্লেখ পাওয়া যায়। সন্তানজন্মের পর পঞ্চম দিনে ‘পাঁচুটি’, ষষ্ঠ দিনে ‘ষষ্ঠীপূজা' অষ্টম দিনে ‘অষ্টকলাই’, ছয় মাসে ‘অন্নপ্রাশন' প্রভৃতির বিবরণ একান্তভাবেই বাঙালি জীবনের পরিচয়বাহী । বাঙালি সমাজে প্রচলিত নিয়ম অনুসারেই অনুষ্ঠিত হয়েছে দশরথের ‘অগ্নিকার্য’, ‘আদ্যশ্রাদ্ধ’ প্রভৃতি। কৃত্তিবাসী রামায়ণ' এর চরিত্রগুলির মধ্যে বাঙালি জীবনস্বভাব অত্যন্ত স্পষ্ট। রামচন্দ্র এখানে মহাকাব্যের ক্ষত্রিয় বীর অপেক্ষা অনেক বেশি বাঙালি সন্তান। ভরত, লক্ষ্মণ এর মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে বাঙালি ভ্রাতার ধর্ম, সীতাকে মনে হয় এক অভাগিনী বাঙালি গৃহবধূ। এছাড়া অন্য চরিত্রগুলির মধ্যেও বাঙালির স্বভাবধর্মের সন্ধান পাওয়া যায়। বাঙালির ভ্রাতৃপ্রেম, পতিপরায়ণতা, পিতৃভক্তি, সেবাপরায়ণতার সঙ্গে আলস্য, কলহপ্রিয়তা, ভোগবিলাস প্রভৃতিও বর্ণিত হয়েছে। কৃত্তিবাসের এই কাব্য তাই প্রথম থেকে শেষ বাঙালিয়ানার পরিপূর্ণ।