📚বাংলা মেজর-2 ও মাইনর-2(Semester-II): অধ্যায়ভিত্তিক প্রশ্নোত্তর: অধ্যায়-৩: শ্রীকৃষ্ণকীর্তন।📚
✍️প্রশ্নমান-২:
প্রশ্ন ঃ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্যটি কে, কবে, কোথা থেকে আবিষ্কার করেন?
উত্তর : প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট গবেষক বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বা ১৩২৩ বঙ্গাব্দে বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রামের দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির গোশালা থেকে কাব্যটি আবিষ্কার করেন।
প্রশ্ন : ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্যর প্রকৃত নাম কী? এটি কি জাতীয় কাব্য ?
উত্তর : ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর প্রকৃত নাম—“শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ'। এটি ঝুমুর, ধামালী, কীর্তন সংমিশ্রিত আখ্যানধর্মী গীতিকাব্য।
প্রশ্ন : ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কার লেখা? এটি কোন্ শতকের সাহিত্য?
উত্তর : ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' বড়ু চন্ডীদাসের লেখা। এটি আনুমানিক চতুর্দশ শতকের সাহিত্য।
প্রশ্ন : ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কার সম্পাদনায়, কবে প্রকাশিত হয়?
উত্তর : ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভের সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' প্রকাশিত হয়।
প্রশ্ন : ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কটি খন্ডে বিভক্ত? যে কোনো তিনটি খন্ডের নাম লেখ ৷
উত্তর : ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' তেরোটি খন্ডে বিভক্ত। এর অন্যতম তিনটি খন্ডের নাম—জন্মখন্ড, তাম্বুলখন্ড, দানখন্ড।
প্রশ্ন ঃ ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'-এর তিনটি মূল চরিত্রের নাম কর।
উত্তর : “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর তিনটি মূল চরিত্র হল—রাধা, কৃষ্ণ, বড়াই।
প্রশ্ন : “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এ পদের সংখ্যা কত? এর শ্রেষ্ঠ পালা কোনটি ?
উত্তর : ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এ পদের সংখ্যা - ৪১৮টি। এর শ্রেষ্ঠ পালা রাধাবিরহ।
প্রশ্ন ঃ “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'-এর শ্রেষ্ঠ পালাটি ‘খন্ড' বলে উল্লেখিত নয় কেন ?
উত্তর : ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর শেষ পালায় দেখা যায়, বৃহত্তর কর্তব্যের অঙ্গীকারে বড়ু চন্ডীদাসের অসহিষ্ণু অথচ কর্তব্যপ্রিয় নায়ক মধুর রসের আকরভূমি বৃন্দাবন ত্যাগ করে চলে যান। এরপর কৃষ্ণ মথুরায় রাধার মনোবাঞ্ছা পূরণের অভিপ্রায়ে ফেরেননি। ফলে ‘রাধাবিরহ’ শেষ পালা যা কাহিনিকে সম্পূর্ণ করেছে। তাই এ খন্ড নয়, সমাপ্তি।
প্রশ্ন : শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্যের ওপরে কোন্ কোন্ গ্রন্থের প্রভাব আছে?
উত্তর : ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্যের ওপরে পদ্মাপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ এবং মূলতঃ জয়দেব গোস্বামীর ‘গীতগোবিন্দম'-এর প্রভাব আছে।
প্রশ্ন : ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'-এ একজন রাজকন্যার পরিচয় পাওয়া যায়, তার নাম কি?
উত্তর ঃ ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'-এ যে রাজকন্যার পরিচয় পাওয়া যায় তার নাম রানী লক্ষ্মী৷
প্রশ্ন : শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'-এর মধ্যে উল্লিখিত চারটি প্রবাদের উল্লেখ কর।
উত্তর : প্রবাদগুলি হল (১) ললাট লিখন খন্ডন না জাএ (দানখন্ড), (২) 'হাথ বাঢ়ায়িলেঁ কি চান্দের লাগ পাই' (ভারখন্ড), (৩) ‘বন পোড়ে আগ বড়ায়ি
জগজনে জানী। / মোর মন পোড়ে যেহ্ন কুম্ভারের পনী' (বংশীখন্ড),
(৪) কাটিল ঘাত্মত লেম্বুরস দেহ কত। (রাধাবিরহ)।
প্রশ্ন ঃ ‘শ্ৰীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্যে রাধার পিতা ও জননীর নাম কী?
উত্তর ঃ রাধার পিতা হলেন –সাগর, জননী হলেন পদুমা।
প্রশ্ন ঃ ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্যে রাধার শ্বশুর ও শাশুড়ির নাম কী?
উত্তর : রাধার শ্বশুর হলেন—গোল। শাশুড়ি হলেন-জটিলা ।
প্রশ্ন : ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্যে কৃষ্ণের পিতা ও জননীর নাম কী?
উত্তর : কৃষ্ণের পিতা হলেন—বসুদেব। জননী হলেন—দেবকী।
প্রশ্ন ঃ ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্যে কতবার বড়ু চন্ডীদাস ভণিতা ব্যবহার হয়েছে? 'বড়ু’ কথার অর্থ কী?
উত্তর : ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্যে বড়ু চন্ডীদাস ভণিতা ২৯৮ বার ব্যবহার হয়েছে। ‘বড়ু’ কথার অর্থ ঠাকুর।
প্রশ্ন : ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্যের বৃহত্তম ও ক্ষুদ্রতম খন্ডের নাম কী?
উত্তর : ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্যের বৃহত্তম খন্ড-দানখন্ড। ক্ষুদ্রতম খন্ড জন্মখন্ড।
প্রশ্ন : ‘শ্ৰীকৃষ্ণকীর্তন' যে চৈতন্য-পূর্ব তার প্রমাণ কী?
উত্তর : ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ যে চৈতন্য-পূর্ব রচনা তার প্রমাণ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত ও অন্যান্য চৈতন্যজীবনী গ্রন্থে চন্ডীদাসের নামের উল্লেখ। চৈতন্যচরিতকার বলেছেন—“বিদ্যাপতি জয়দেব চন্ডীদাসের গীত।/আস্বাদয়ে রামানন্দ স্বরূপ সহিত।।”—এই উদ্ধৃতি থেকে নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হয় যে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন চৈতন্যপূর্ব রচনা।
প্রশ্ন : 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্যে নদীর নাম উল্লেখ আছে? এই কাব্যের ছন্দ মূলতঃ কী জাতীয়?
উত্তর : “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্যে যমুনা ও কালিন্দী নদীর নাম উল্লেখ আছে।
এই কাব্যের ছন্দ মূলতঃ মিশ্রবৃত্ত।
প্রশ্ন : 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্যের কাহিনি কোন্ ঋতুতে সমাপ্ত হয়? কোন রাগে এই কাব্যের সবচেয়ে বেশি পদ রচিত হয় ?
উত্তর : ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্যের কাহিনি শরৎ ঋতুতে সমাপ্ত হয় ৷
পাহাড়ীয়া রাগে এই কাব্যের সবচেয়ে বেশি পদ রচিত হয়।
✍️প্রশ্নমান-৫:
১. শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রচনাকাল ও কাব্যটির বিষয়েও আঙ্গিকগত মূল বৈশিষ্ট্য লেখ।
উত্তর ঃ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি কবে রচনা হয়েছিল তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিভেদ আছে কারণ গ্রন্থের মধ্যে কোন রচনাকাল এর উল্লেখ নেই। তবে লিপি বিশারদদের বিচারে কাব্যটি চতুর্দশ থেকে ১৬ শতকের মধ্যে বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচিত হয়েছে বলে অনেকে মনে করেছেন।কাব্যটির বিষয়েও আঙ্গিকগত দিক অন্যান্য সকল মধ্যযুগের কাব্য কবিতা থেকে অনেক আলাদা। বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের বিষয় হয়ে উঠেছে রাধা ও কৃষ্ণের কাহিনী। যা সমস্ত মধ্যযুগের কাব্য কাহিনীতে দুর্লভ। মধ্যযুগের একমাত্র বৈষ্ণব পদাবলীতে প্রাকচৈতন্য যুগের এই ধরনের রচনা দেখা গেলেও তা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন থেকে আলাদা। আর পরবর্তী চৈতন্য যুগের কৃষ্ণ লীলাগুলি ভক্ত ভগবানের আকুতি মিনতি পর্যায়ের। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি নাট্য আঙ্গিকে গীতিকাব্য। তিনটি চরিত্র বিভিন্ন সংলাপ বা কথোপকথনের মধ্য দিয়ে কাব্যটি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটির আঙ্গিকগত যে সকল বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় তা হল-
(১) বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রাধা কৃষ্ণের লীলা কে অবলম্বন করে লেখা। এটি একটি আখ্যানকাব্য যার বিন্যাসে নাটকীয়তা আর গীতিময়তা লক্ষ্য করা যায়।
(২) শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের ভাষা প্রথম যুগের বাংলা ভাষা হলেও চর্যাপদের ভাষার আড়ষ্টতা অনেকখানি কম লক্ষ্য করা যায় ৷
(৩) ভাগবত পুরাণ এবং গীতগোবিন্দম্ কাব্যের ভাবানুবাদ বড়ু চণ্ডীদাস তাঁর কাব্যে ব্যবহার করেছেন।
(৪) আদি মধ্যযুগের সৃষ্টি হওয়া নব্য বাংলা ভাষার বিশিষ্ট লক্ষণগুলো শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে আমরা লক্ষ্য করি।
(৫) সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্রের অনুসরণে বড়ু চণ্ডীদাস তাঁর কাব্যে উৎপ্রেক্ষা উপমা রূপক অলংকার ব্যবহার করেছেন।
২.‘শ্ৰীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্যে পুরাণ ও লৌকিক সমাজের প্রভাব আলোচনা কর ।
উত্তর : পৌরাণিক বিষয়ে কোনো আখ্যান কাব্য রচনা করতে গেলে তার উপর পুরাণের প্রভাব থাকবেই। আবার কবি একজন সামাজিক মানুষ। তাই সমকালের
সমাজের প্রভাব থেকেও মুক্ত হতে পারেন না। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্যে তাই পুরাণের প্রভাব এবং লৌকিক সমাজের প্রভাব দুই-ই রয়েছে। পূর্ববর্তী বাঙ্গালী কবি জয়দেবের আখ্যান কাব্য ‘গীতগোবিন্দের' প্রভাব এ কাব্যে সবথেকে বেশি। এই কাব্যের অনুসরণেই
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের আখ্যান পরিকল্পনা। এছাড়া ভাগবত, বিষ্ণুপুরাণ, পদ্মাপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ ইত্যাদির প্রভাবও রয়েছে। কাব্যের প্রথম খণ্ড জন্মখন্ডের শুরুতে,—
“পৃথুভার ব্যথাং পৃধ্বী কথয়ামাস নিৰ্জ্জয়ান ।
ততঃ সরভসং দেবাঃ কংস ধ্বংস মনো দধুঃ।।”
—এই শ্লোকটি আছে। এই প্রসঙ্গ বিষ্ণুপুরাণ, পদ্মপুরাণেও আছে। বস্তুত, জন্মখণ্ডের বৃত্তান্ত পুরাণ অনুসারেই পরিকল্পিত।
জন্মখণ্ড ছাড়া অন্যান্য খন্ডে বড়ুচণ্ডীস পুরাণের থেকেও বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন লোকসমাজে প্রচলিত কাহিনীকে। আর সেই কাহিনীকে প্রাধান্য দিতে গিয়েই কাব্যের নায়ক কৃষ্ণ আর বিষ্ণুর অবতার, জগদীশ্বর কৃষ্ণ হয়ে থাকেন নি, হয়ে উঠেছেন এক ভব্যতাহীন লম্পট, কামুক, গ্রাম্য যুবক। তাম্বুলখণ্ড, দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড প্রভৃতিতে রাধার জন্য কৃষ্ণের যে তৎপরতা, তাতে দেবত্ব নেই, আছে লৌকিকতার প্রভাব। দানখণ্ডে
এবং নৌকাখণ্ডে কৃষ্ণ ছল করে রাধাকে যেভাবে সম্ভোগ করেছেন, তার বর্ণনায় লৌকিক কাহিনীর প্রভাব থাকাই সম্ভব। এই লৌকিকতার প্রভাব থাকার জন্যই কাব্যের
ঘটনা বর্ণনায় কিছুটা অশ্লীতার স্পর্শ ঘটেছে। তখনকার লোক রুচিকে আশ্রয় দিতে গিয়েই কবি উত্তরকালের উন্নত রুচি সম্পন্ন পাঠকের অসন্তোষের কারণ
হয়েছেন।
✍️প্রশ্নমান-১০:
১.শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটির আবিষ্কার ও প্রকাশ সম্বন্ধে আলোচনা করে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে গ্রন্থটির গুরুত্ব নির্দেশ করো।
উত্তর :- বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য আবিষ্কারের পর সাহিত্য জগতে এক প্রবল চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল । এটি রাধাকৃষ্ণ লীলা বিষয়ক পুরাতন ধরনের আখ্যান কাব্য ।
আবিষ্কার ও প্রকাশ : শ্রীকৃষ্ণকীর্তন আবিষ্কার করেন পন্ডিত বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্ধদ্ববল্লভ মহাশয় । ১৩১৬ বঙ্গাব্দে ( ইং ১৯০৯ ) বনবিষ্ণু পুরের কাছে কাঁকিল্যা গ্রামের জনৈক দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ে বাড়িতে এক গোয়াল ঘরে মাঁচা থেকে সঞ্চিত অনেক পুরাতন পুঁথির মধ্যে থেকে এটি আবিষ্কার করেছেন ।
১৩২২ বঙ্গাব্দে পরিষদ পত্রিকায় বসন্তরঞ্জন ও লিপিতত্ত্ব বিশারদ প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় দুজনে মিলিত হয়ে প্রাপ্ত পুঁথিটির লিপি বিচার করে এটিকে অতিশয় পুরাতন বাংলা আখ্যান কাব্য বলে নিধারিত করলেন । এর কয়েকমাস ১৩২৩ বঙ্গাব্দে ( ইং ১৯১৬ ) বসন্তরঞ্জনের সুযোগ্য সম্পাদনায় এই বৃহৎ পুঁথিটি “ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ” নামে প্রকাশিত হল ।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব : শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য সম্পর্কে ভাষাতাত্ত্বিকেরা মন্তব্য করেছেন যে এতদিনে মধ্য যুগের বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন মিলল । বাস্তবধর্মী সমালোচকেরা রাধাকৃষ্ণের উদ্দাম - কাম - ক্রীড়ার মধ্যে বাঙালী সমাজে যথার্থ পরিচয় পেয়ে এটিকে মাটির কাছাকাছি কাব্য বলে মন্তব্য করেছেন । এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব কে নানাভাবে ব্যক্ত করা যেতে পারে ।
বাংলা সাহিত্যে প্রভাব : বাংলা সাহিত্য এই কাব্যের প্রভাব সীমাহীন । বিশেষ করে বৈষ্ণব পদাবলীর ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অপরিসীম । দুটি সাহিত্যের মধ্যে একটি মিল রয়েছে । সেটি হল , উভয় সাহিত্যেই রাধাকৃষ্ণ বিষয়কে নিয়ে । তবে “ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ” কাব্য যেখানে রাধাকৃষ্ণ চরিত্রর পরিণতি লাভ করেছে সেখানে বৈষ্ণবপদাবলীর রাধাকৃষ্ণের কাহিনী শুরু । এছাড়াও “ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ” কাব্যটি চৈতন্যদেব কতৃক আস্বাদিত হয়েছিল বলে এর গুরুত্ব অপরিসীম ।
আখ্যান কাব্য হিসাবে গুরুত্ব : “ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ” মূলত আখ্যান কাব্য । কিন্তু নানা স্থানে ও গীতিকাব্যের লক্ষণ সুস্পষ্ট । কবি প্রায়ই যবনিকার অন্তরালে রয়ে গেছেন কিন্তু সংগতি রক্ষা করেছেন পাত্রপাত্রীর সংলাপের মধ্যে দিয়ে । তাই সবদিক দিয়ে বিচার করে এটিকে গীতি ও সংলাপ মূলক আখ্যান কাব্য বলা যেতে পারে ।
ছন্দ ও আলংকারিক গুরুত্ব : শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের ছন্দের বৈচিত্রও বিশেষ লক্ষণীয় ।
এখানে দিগক্ষরা -. “ একদিনে মনের উল্লাসে ।
সখী মনে রস পরিহাসে ।।”
একাবলী - “ আয়ী লা দেবের সুমতি গুণী
কংসের আগেক নারদমুনি ।।”
ত্রিপদি , পয়ার প্রভৃতি ছন্দের মাধুর্য লক্ষণীয় । তাঁর অলংকারাদি বিশেষ উপভোগ্য । যেমন - কৃষ্ণ কতৃক রাধার রূপ বর্ণনা “ লবলী দল কোমল ” “ জুরু আ দেখি আ জেহন রুচিক অম্বল । ”
সমাজ ও ধর্মগত গুরুত্ব : এই কাব্য থেকে তৎকালীন সমাজ , রাজনীতি , মানুষের আচার আচরণ , প্রভৃতির সঙ্গে মানুষের ধার্মিকতার বিশদ পরিচয় পাওয়া যায় ।
সর্বোপরি বলতে হয় বড়ু চণ্ডীদাসের “ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ” কাব্য খানি মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন হলেও এর অশ্লীলতা সম্পর্কে কোনও কোনও সমালোচক তিক্ত মন্তব্য করেছেন । কিন্তু এর জন্য তাকে দোষ দেওয়া যায় না । কারণ তিনি যে সময়ে এটি রচনা করেছেন সে সময়ের পরিবেশ কিছুটা স্থূল রুচির পরিচয় বহন করে । কিন্তু এই সামান্য ত্রুটিটুকু বাদ দিলে সাহিত্যের ইতিহাসে এটি অনবদ্য ।