📚বাংলা মেজর-2 ও মাইনর-2(Semester-II): অধ্যায়ভিত্তিক প্রশ্নোত্তর:অধ্যায়-১: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের যুগ বিভাগ।📚
✍️প্রশ্নমান-২:
প্রশ্ন : সাহিত্যের যুগবিভাগ কীভাবে করা হয়?
উত্তর : ভাষাগত পরিবর্তনের সূত্রকে অবলম্বন করে এবং সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি বিচার করে সাহিত্যের যুগবিভাগ করা হয়।
প্রশ্ন : বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে কটি এবং কী কী যুগে ভাগ করা হয়েছে?
উত্তর : সাহিত্যের ধারা অনুসরণ করে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে তিনটি যুগে ভাগ করা হয়েছে। যথা— (১) আদিযুগ, (২) মধ্যযুগ এবং (৩) আধুনিক যুগ।
প্রশ্ন : বাংলা সাহিত্যের শুরু কবে থেকে?
উত্তর : আনুমানিক খ্রিস্টিয় দশম শতাব্দী থেকে বাংলা সাহিত্যের শুরু।
প্রশ্ন : বাংলা সাহিত্যের আদিযুগ কোনটি ?
উত্তর : খ্রিস্টিয় দশম শতাব্দী থেকে বাংলায় তুর্কি আক্রমণের (১২০৩ খ্রি:) পূর্ব পর্যন্ত সময়কালকে বাংলা সাহিত্যের আদিযুগ বলা হয়।
প্রশ্ন : আদিযুগে বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন কী ?
উত্তর : আদিযুগে বাংলা সাহিত্যের একমাত্র প্রামাণিক নিদর্শন হচ্ছে “চর্যাপদ” বা “চর্যাচর্যবিনিশ্চয়”।
প্রশ্ন : বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের পরিধি উল্লেখ করো।
উত্তর : খ্রিস্টিয় পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত চারশ বছরের সুদীর্ঘকালটিকে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ বলে অভিহিত করা হয়।
প্রশ্ন : বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীকে কী কাল বলে অভিহিত করা হয়েছে?
উত্তর : ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
প্রশ্ন : অন্ধকার যুগ বলার কারণ কী?
উত্তর : খ্রিস্টিয় ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীতে তুর্কি শাসিত বঙ্গে বাংলা সাহিত্যে বন্ধ্যাত্ব দেখা দেয়। এই সময় বঙ্গসাহিত্যে নতুন কিছু সৃষ্টি হয়নি।
প্রশ্ন : বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সমৃদ্ধির যুগ কোনটি?
উত্তর ঃ পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত দীর্ঘ সময়কাল অর্থাৎ সমগ্র মধ্যযুগটি বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধির যুগ।
প্রশ্ন : মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যকে কটি এবং কি কি পর্বে ভাগ করা হয়েছে?
উত্তর : মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যকে তিনটি পর্বে ভাগ করা হয়েছে। এই পর্বগুলি হল: (ক) প্রাক চৈতন্য-পর্ব, (খ্রিস্টিয় পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত),(খ) চৈতন্য-পর্ব (খ্রিস্টিয় ষোড়শ শতাব্দী) এবং (গ) চৈতন্যোত্তর পর্ব(সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দী)।
প্রশ্ন : প্রাক চৈতন্য যুগের সাহিত্যের নিদর্শনগুলি কী ?
উত্তর : প্রাক চৈতন্য যুগের নিদর্শন—শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতির পদাবলি সাহিত্য।
প্রশ্ন : চৈতন্য-পর্ব সময়ে বাংলায় কী কী সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছিল?
উত্তর : চৈতন্য যুগ বা চৈতন্য সমসাময়িক যুগে বাংলা সাহিত্যে সৃষ্টি হয়েছিল চৈতন্যজীবন কাব্য “চৈতন্যভাগবত”, বিভিন্ন বৈষ্ণব শাস্ত্র ও তত্ত্বগ্রন্থ।
প্রশ্ন : বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চৈতন্যোত্তর যুগের নিদর্শনগুলি কী কী?
উত্তর : বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চৈতন্য পরবর্তী বা চৈতন্যোত্তর যুগের নিদর্শনগুলি হল আরাকান ও রোসাঙ রাজসভার কাব্য, বিভিন্ন অনুবাদ কাব্য, পদাবলি সাহিত্য, অন্নদামঙ্গল ইত্যাদি।
প্রশ্ন : বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগের শুরু কবে?
উত্তর : বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগের আরম্ভ নিয়ে মত পার্থক্য রয়েছে। তা হলেও মোটামুটি ভাবে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে ভারতচন্দ্রের মৃত্যুর পর থেকেই বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের সূত্রপাত বলে ধারণা করা হয়।
প্রশ্ন : বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের সূচনা করেন কে?
উত্তর : বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের সূচনা করেন উইলিয়াম কেরী ও তার সহযোগী সংস্কৃত পণ্ডিতেরা। তাঁদের গদ্যরচনার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যের প্রারম্ভিক স্তরটি নির্মিত হয় ।
প্রশ্ন : বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আধুনিক যুগের সূত্রপাত কবে হয় ?
উত্তর : ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপক ও খ্রিস্টান মিশনারীদের দ্বারা রচিত গ্রন্থগুলির দ্বারা আধুনিক যুগের সূত্রপাত হয় ৷
প্রশ্ন : বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগকে ক'টি পর্বে ভাগ করা হয়েছে?
উত্তর : আধুনিক যুগকে চারটি যুগ-পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। যথা—(ক) বাংলা গদ্য সাহিত্যের প্রস্তুতি পর্ব; (খ) প্রাক রবীন্দ্র যুগ; (গ) রবীন্দ্র যুগ ও (ঘ)রবীন্দ্রোত্তর যুগ।
প্রশ্ন : বাংলা গদ্য সাহিত্যের প্রস্তুতি পর্বে কে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন?
উত্তর : বাংলা গদ্য সাহিত্যের প্রস্তুতি পর্বে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়।
প্রশ্ন : প্রাক্ রবীন্দ্রযুগের সময়কাল কোনটি ?
উত্তর :১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রাক রবীন্দ্র যুগের বিস্তার।যদিও ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের বয়স চল্লিশের কাছাকাছি এবং সেই সময়ে তাঁর কিছু রচনা প্রকাশিত হলেও রবীন্দ্র প্রভাব সেইভাবে লক্ষ করা যায়নি !
প্রশ্ন : প্রাক্ রবীন্দ্রযুগের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক কারা ছিলেন ?
উত্তর : প্রাক্ রবীন্দ্রযুগের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক ছিলেন বিদ্যাসাগর, প্যারীচাঁদ মিত্র, কালীপ্রসন্ন সিংহ, বঙ্কিমচন্দ্র, মধুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, বিহারীলাল,দীনবন্ধু মিত্র, গিরিশচন্দ্র প্রমুখ প্রতিভাবান সাহিত্যিকবৃন্দ ।
প্রশ্ন : রবীন্দ্রযুগের বিশেষত্ব কী?
উত্তর ঃ এই যুগকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অসংখ্য রচনা দ্বারা সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর বহুকবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ এবং ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারকে পূর্ণ করেছে।
প্রশ্ন : রবীন্দ্রযুগের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক কারা ছিলেন ?
উত্তর : রবীন্দ্রযুগে অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক ছিলেন শরৎচন্দ্র, নজরুল,সতেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার প্রমুখ। এ ছাড়াও ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলালের মতো প্রতিভাধর নাট্যকার।
প্রশ্ন : রবীন্দ্রোত্তর যুগের সময়কাল কবে শুরু হয়?
উত্তর : ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণের পর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে রবীন্দ্রোত্তর যুগের শুরু হয় যা সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত প্রবহমান।
প্রশ্ন ঃ রবীন্দ্রোত্তর যুগের কয়েকজন বিশিষ্ট সাহিত্যিকের নাম লেখ।
উত্তর : রবীন্দ্রোত্তর যুগের কয়েকজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক হলেন বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ সাহিত্যিক ও কবিগণ।
✍️প্রশ্নমান-৫:
১.বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি কি?
উত্তর : বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যে কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল :
(১) বৈচিত্র্যের অভাব অর্থাৎ কাব্যের পরিকাঠামোগুলি একই রকম।
(২) বাংলা কাব্য সাহিত্যই মূলতঃ এ যুগে প্রসার লাভ করেছিল।
(৩) বাংলা কাব্য সাহিত্যের দুটি ধারা এই যুগে ছিল। যথা—পাঁচালি কাব্য এবং পদাবলী কাব্য।
(৪) পাঁচালি রীতিতে আছে মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ কাব্য প্রভৃতি। আর পদাবলী কাব্যে আছে চর্যাপদ, বৈষ্ণবপদ ও শাক্তপদ। কাব্যরীতিগুলির মধ্যে অন্ধ অনুকরণ প্রবৃত্তি লক্ষণীয়।
(৫) হিন্দু ও ইসলামী সাহিত্যরীতির মধ্যেও ধর্মভাবনার প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়।
(৬) উপরোক্ত দুই রীতির বাইরে আখ্যায়িকা কাব্যের রচনা কখনো কখনো পরিলক্ষিত হয় যেমন আরাকান রাজসভার কবিদের রচিত কাব্যগ্রন্থ, পূর্ববঙ্গ গীতিকা প্রভৃতি।
(৭) প্রাচীন যুগের বাংলা সাহিত্যে দেববাদ প্রাধান্য লাভ করেছিল আর মধ্যযুগের সাহিত্যে দেববাদনির্ভর মানবতাবাদ প্রাধান্য লাভ করেছিল।
সুতরাং, বলা যেতে পারে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য একই পথ ধরে বৈচিত্র্যহীনভাবে আবর্তিত হয়েছে।
২. ধর্মের সঙ্গে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের সম্পর্ক কি ছিল আলোচনা করো।
উত্তর : বিভিন্ন দেশে প্রাচীন ও মধ্যযুগে ধর্মের সঙ্গে সাহিত্যের একটি অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক ছিল বাংলা সাহিত্যও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রাচীন কালের সমাজ ব্যবস্থায় যেহেতু ধর্ম বা ধর্মীয় অনুশাসন প্রাধান্য লাভ করেছিল সেইহেতু সাহিত্যও সৃষ্টি হয়েছিল ধর্মকে কেন্দ্র করে।
বাংলা সাহিত্যেও প্রাচীন যুগে ধর্মের একটি ব্যাপক প্রভাব লক্ষ করা যায়।বাংলা ভাষার প্রাচীন ও আদিতম নিদর্শন হল চর্যাপদ। এই চর্যাপদ রচিত হয়েছিল বৌদ্ধ সহজিয়া সাধক সম্প্রদায়ের সাধনার সঙ্গীতকে কেন্দ্র করে।আদি-মধ্য যুগের অন্যতম সাহিত্য নিদর্শন হল বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যগ্রন্থটি। এই কাব্যগ্রন্থটির মধ্যেও রাধাকৃষ্ণের প্রেম কাহিনী ব্যক্ত হয়েছে। আদি মধ্যযুগের পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছিল বৈষ্ণব পদাবলী, অনুবাদ সাহিত্য, চৈতন্যচরিত কাব্য প্রভৃতির মাধ্যমে। বৈষ্ণব পদাবলীতে রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়,চৈতন্য প্রভাবিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের অনুবর্তন লক্ষ করা যায়। অনুবাদ সাহিত্যের মধ্যে রামায়ণে রামচন্দ্র ভক্তিভাবের প্রাবল্যে দেবতায় পরিণত হয়েছেন। মহাভারতেও ভক্তিভাবনা প্রকাশিত হয়েছে। চৈতন্যচরিত সাহিত্যে চৈতন্যদেব দেবত্বে উপনীত হয়েছেন। নাথ সাহিত্য, বাউলগান, শাক্তপদগুলির মধ্যেও ধর্মভাবনাই প্রাধান্য লাভ করেছে। ইসলামী সাহিত্যে ইসলাম ধর্মের প্রবক্তারাই প্রাধান্য লাভ করেছেন।
এই ধর্মীয় ভাবনা থেকে ব্যতিক্রম শুধুমাত্র পূর্ববঙ্গ গীতিকাগুলি ও রোসাঙ্ রাজসভার কবি দৌলত কাজী ও সৈয়দ আলাওলের রচনা। তবুও বলা যায় প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যে ধর্মভাবনাই প্রধান কারণ বেশির ভাগ কাব্যই ধর্মকেন্দ্রিক।
৩. ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীকে অন্ধকার যুগ নামে অভিহিত করা যথাযথ কিনা বিচার কর।
উত্তর : বাংলা সাহিত্যে আজ পর্যন্ত প্রাপ্ত নিদর্শনগুলিকে যদি ক্রমান্বয়ে সাজানো যায় তাহলে খ্রীষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে রচিত হয় চর্যাপদ। এর পর সুদীর্ঘ দুইশত বছর উল্লেখযোগ্য কোনো সাহিত্যিক নিদর্শন পাওয়া যায় নি। ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকের প্রায় দুইশত বৎসর বাংলা সাহিত্য নিষ্কলা ছিল বলেই এই সময়কে বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ নামে অভিহিত করা হয়েছে।
বাংলার ক্ষমতা দখল করার পর তুর্কিরা দেশব্যাপী বিভীষিকা ও আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে। বিশেষ করে সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলি ধ্বংসের ফলে বুদ্ধিজীবী মহল বাংলার সনাতন সংস্কৃতিকে আর ধরে রাখতে পারলো না। এছাড়াও তখনকার দিনে বৌদ্ধমঠ ও হিন্দুদের মন্দির-আশ্রম কেন্দ্রিক যে শিক্ষা-সাহিত্যের চর্চা চলছিল তাতে ছেদ পড়ল।কারণ তুর্কি শাসকেরা মন্দির, মঠ, দেব বিগ্রহ ধর্মগ্রন্থ বিনষ্ট করাকে পুণ্যকর্ম বলে মনে করত। তাছাড়াও তৎকালীন কবি সাহিত্যিকরা রাজার কাছ থেকে যে উৎসাহ ও অর্থানুকুল্য পেতেন তাও বন্ধ হয়ে যায়। এইসব কারণে এই দু-শো বছর ধরে সাহিত্যচর্চা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে মনে হয়।
কিন্তু আধুনিক সাহিত্য সমালোচকেরা সাহিত্যের ইতিহাসে এই দুশো বছরকে শূন্যগর্ভ বলে মনে করেন না। বস্তুত সাহিত্য হল একটি গতিময় প্রক্রিয়া। তাই এই গতি সুদীর্ঘ দু-শো বছর স্তব্ধ ছিল—একথা মেনে নেওয়া যায় না। দেশে অরাজকতা থাকলেও তা ছিল মূলত রাজধানী কেন্দ্রিক। সৈন্য চলাচলের রাস্তা ব্যতীত দেশের অন্য অঞ্চলে নিস্তরঙ্গ জীবনধারা চলত। তাই উল্লেখযোগ্য না হলেও গ্রামে-গঞ্জে সাহিত্যচর্চা হয়নি একথা মেনে নেওয়া যায় না। সুতরাং তখনও সাহিত্যচর্চা হয়েছিল, যদিও তার উপযুক্ত সংরক্ষণ বা প্রচলন হয়নি। যদি সাহিত্যচর্চা একেবারে বন্ধ থাকতো তবে পরবর্তী সময়ে চণ্ডীদাস, কৃত্তিবাস ওঝা, মালাধর বসু অথবা মনসা মঙ্গলের আদি কবিরে মত খ্যাতিমান কবিদেরকে পাওয়া যেত না। তাই তুর্কি আক্রমণের ফলে সাহিত্যের বন্ধ্যা জমিতে সবুজ কোনো ফসল ফলেনি,—এমন কথা বলা চলে না।আর এইসব কারণের জন্য ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীকে কখনোই অন্ধকার যুগ নামে অভিহিত করা যথাযথ নয়।
৪.প্রাচীন যুগে বাঙালী সাহিত্য সংস্কৃতির পরিচয় দাও।
উত্তর : বাংলাদেশ নদী মাতৃক দেশ। প্রাকৃতিক বৈচিত্রে ভরপুর। এখানকার মানুষকে করে তুলেছে ভাবুক প্রকৃতি প্রেমিক। ফলত গণ্ডিবদ্ধ পল্লিসমাজে পরিবেশেই বাংলা সাহিত্যে জন্ম এবং তা সীমাবদ্ধতা ওই পরিবেশের মধ্যেই। এই সীমাবদ্ধ জীবনের মধ্যে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে বড়ো অবলম্বন ছিল। তার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার বিশেষ করে হিন্দু আর্য সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। বাংলা সাহিত্যে আমরা এর পরিচয় দু-ভাবে পেয়ে থাকি। প্রথমত, বাঙালী কবি সাহিত্যিকদের রচিত সংস্কৃত সাহিত্য, দ্বিতীয়ত, বাঙালী রচিত অবহট্ট ও প্রাচীন কবিতা বা শ্লোক। এই সাহিত্যের ভাব, রীতি, অলংকার প্রভৃতি থেকে বুঝতে পারি প্রাচীন বাঙালী মানব লোক কীরূপ ছিল। এবং তাদের সাহিত্য দর্শন ছিল কী ধরনের। এরই মধ্য দিয়ে আমরা প্রাচীন বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতির পরিচয় পায়।
✍️প্রশ্নমান-১০:
১.বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যুগবিভাগের তাৎপর্য বিচার কর।
উত্তর : বলা হয় সমুদ্র যেমন জীবের আদি জননী, তেমনি ভারতীয় আর্যভাষা বর্তমানে ভারতের অধিকাংশ ভাষার আদি মূল। হাজার হাজার বছর ধরে এই ভাষা এতবার পরিবর্তিত হয়েছে যে মূলের সঙ্গে শাখার সম্পর্ক খুঁজতে গেলে আমাদের ভাষা তাত্ত্বিকের বিশেষ জ্ঞানের সহায়তার প্রয়োজন।
ভাষাচার্যদের মতে আর্যরা উত্তর পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করার সময় সঙ্গে এনেছিলেন তাদের আদি ভারতীয় আর্যভাষা। এর দুটি শাখা হল – (১) বৈদিক বা ছান্দস্ ভাষা ও (২) সংস্কৃত ভাষা।
নদীপ্রবাহ ও ভাষাপ্রবাহ একই রীতিতে বহমান। প্রকৃতির কারণে নদীর ধারা যেমন বদলায়, ভাষাও তেমনি বদলায়। পাণিনির নির্দষ্ট নিয়মে বাঁধা পড়েও সংস্কৃত ভাষা একটি অপরিবর্তনীয় সাধু ও শিষ্ট রূপ হয়ে গেল। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দ থেকেই জনসাধারণের অশিক্ষা ও জিহ্বার আড়ষ্টতার ফলে সংস্কৃত ভাষার পরিবর্তন শুরু হল।চলল প্রায় দশম শতাব্দি পর্যন্ত। এই দেড় হাজার বছর ধরে ভাষার পরিবর্তনকে প্রাকৃত বলা হয়। এই প্রাকৃতের মধ্যে দুটি ভাষাগত স্তর দেখা যায়,
(১) পালি-যে ভাষা বুদ্ধদেব নিজে বলতেন এবং শিষ্যদেরকে যে ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
(২) সংস্কৃতের পাশাপাশি প্রাকৃত ভাষা গড়ে উঠল। প্রাকৃত ভাষা মধ্য ভারতীয় আর্যভাষা নামে পরিচিত। এই প্রাকৃত ভাষার স্থানভেদে ৪টি স্তর দেখা যায়। যথা—(ক)শৌরসেনি, (খ) মহারাষ্ট্রি, (গ) মাগধি, (ঘ) অর্ধমাগধি বা জৈন মাগধি ।
উক্ত চারটি প্রাকৃত ভেঙে হল অপভ্রংশ। মাগধি থেকে জন্মলাভ করলো আধুনিক ভাষা-বাংলা, ওড়িয়া, মৈথিলি, ভোজপুরি, মাগহি ইত্যাদি।
এই বাংলা ভাষার বিকাশ ৯ম শতক থেকে শুরু। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়,শহীদুল্লাহ, রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন, সুকুমার সেন এঁদের মতামত ও ঐতিহাসিক ভাষাতাত্ত্বিক পরিবর্তনের দিক থেকে বাংলা ভাষাকে কালানুক্রমিকভাবে মোটামুটি তিনটি প্রধান শাখায় বিভক্ত করা যায়-১.আদি বাংলা ২.মধ্য বাংলা ৩.আধুনিক বাংলা।
মধ্য বাংলাকে আবার দুটি ভাগে ভাগ করা হয় -১.আদি-মধ্য ২.অন্ত্য-মধ্য।
যুগবিভাগ ও নিদর্শন ঃ
(১) আদিযুগ :
কালসীমা : ৯০০-১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ
নিদর্শন : চর্যাপদ
(২) মধ্যযুগ :
কালসীমা : ১৩৫১-১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ।
মধ্যযুগ আবার দুটি ভাগে বিভক্ত—(ক) আদি-মধ্য, (খ) অন্ত্য-মধ্য
(ক) আদি-মধ্য যুগ :
কালসীমা : ১৩৫১–১৫০০ খ্রিস্টাব্দ
নিদর্শন : বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন।
(খ) অন্ত্য-মধ্য যুগ :
কালসীমা : ১৫০১–১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ
নিদর্শন : জ্ঞানদাস, বলরামদাসের পদাবলী, বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত',কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্য চরিতামৃত', মুকুন্দ চক্রবর্তীর 'অভয়ামঙ্গল', ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’, রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের পদাবলী।
(৩) আধুনিক যুগ :
কালসীমা : ১৭৬১ – আজ পর্যন্ত।
নিদর্শন : মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, শঙ্খ ঘোষ প্রমুখের রচনা।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর নাট্যাভিনয় ও নাট্যকলার উন্নতি হয়েছে। বাংলা উপন্যাস ও ছোটগল্পের ক্ষেত্রে তারাশঙ্কর, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নরেন্দ্র মিত্র প্রমুখ সমাজ পরিপ্রেক্ষিত অবলম্বন করে কখনোও বা ধূসর ইতিহাসে ফিরে গিয়ে গত যুগের সাহিত্যধারাকে অনুসরণ করে চলেছেন। কোনো কোনো দুঃসাহসী লেখক সম্পূর্ণ অপরিচিত পথে অজ্ঞাত অভিজ্ঞতায় ঝাঁপ দিয়ে এক ধরনের উপন্যাস লিখেছেন এবং আধুনিক সমাজে তার যথেষ্ট চাহিদাও দেখা গেছে।
সাম্প্রতিক ছোটোগল্পেও কয়েকজন তরুণ লেখক প্রথমে কিছুটা নতুনত্ব দেখিয়েছেন এবং কিছুটা প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তবে এতদিন ছোটোগল্পের যা ছিল একাধিপত্য আজ সেই সমস্ত বৈশিষ্ট্যই পুরানো হয়েছে।
প্রবন্ধ নিবন্ধ রচনাতেও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। রম্যরচনার আতিশয্যের প্রসঙ্গ ভুলে থাকা যায় না। নাটকের ক্ষেত্রেও অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
গদ্যের দিক থেকে সাধু ও চলিতের বিকাশ ঘটেছে। আবার আঞ্চলিক রূপকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য ভাষার আঞ্চলিক রূপ গুরুত্ব পেয়েছে---আর এইসব বৈশিষ্ট্য বা পরিবর্তন বোঝা সহজবোধ্য হয় যুগবিভাগের কারণেই। আর এখানেই নিহিত রয়েছে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যুগবিভাগের তাৎপর্য।
........................