📚বাংলা মেজর-2 ও মাইনর-2(Semester-II): অধ্যায়ভিত্তিক প্রশ্নোত্তর: অধ্যায়-২:চর্যাপদ।📚
✍️প্রশ্নমান-২:
প্রশ্ন : বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন কী? কোন্ সময়ে তা রচিত হয়েছিল?
উত্তর : বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন হল চর্যাপদ।
খ্রিষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে তা রচিত হয়েছিল।
প্রশ্ন : কে কোথা থেকে চর্যাপদের পুঁথিটি আবিষ্কার করেন?
উত্তর : মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবারের অভিলেখালয় থেকে চর্যাপদের পুঁথিটি আবিষ্কার করেন।
প্রশ্ন : হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কতবার নেপালে পুঁথির সন্ধ্যানে যান ? কোন্ কোন্ সালে ?
উত্তর : হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় তিনবার পুঁথির সন্ধানে নেপালের যান।
১৮৯৭,১৮৯৮ এবং ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে।
প্রশ্ন : কত সালে চর্যাপদের পুঁথিটি আবিষ্কৃত হয়? তার সঙ্গে আর কোন্ কোন্ পুঁথি আবিষ্কৃত হয়েছিল?
উত্তর : চর্যাপদের পুঁথিটি আবিষ্কৃত হয় ১৯০৭ সালে।
তার সঙ্গে আবিষ্কৃত হয় সরহপাদের দোঁহা, কৃষ্ণচার্যের দোঁহা এবং অন্বয়বজ্রের সংস্কৃত টীকা আবিষ্কৃত হয়েছিল।
প্রশ্ন : হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল থেকে আবিষ্কৃত পুঁথিগুলি কী নামে,কত সালে কোথা থেকে প্রকাশ করেন?
উত্তর : হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর আবিষ্কৃত পুঁথিগুলি ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে 'হাজার বছরের পুরানো বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোঁহা’ নামে প্রকাশ করেন।
প্রশ্ন : 'হাজার বছরের পুরানো বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোঁহা’- এই গ্রন্থে কটি পুঁথি প্রকাশিত হয় ? কী কী ?
উত্তর : ‘হাজার বছরের পুরানো বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোঁহা’– এই গ্রন্থে চারটি পুঁথি প্রকাশিত হয়। যথা--- চর্যাচর্য বিনিশ্চয়, সরহপাদের দোঁহা, কৃষ্ণাচার্যের দোঁহা এবং ডাকার্ণব।
প্রশ্ন : ‘হাজার বছরের পুরানো বাংলা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোঁহা' গ্রন্থের চারটি পুঁথির কোনটি প্রকৃত বাংলা ভাষায় লেখা। কে কোন্ রচনার তা প্রমাণ করেন ?
উত্তর : ‘হাজার বছরের পুরানো বাংলা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা' গ্রন্থের চারটি পুঁথির মধ্যে কেবল ‘চর্যচর্যবিনিশ্চয়' পুঁথিটি বাংলা ভাষায় লেখা।
আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর 'The Origin and Development of the Bengali Langnage' গ্রন্থে তা প্রমাণ করেন।
প্রশ্ন : চর্যাপদের আবিষ্কৃত পুঁথিটি কিসে লেখা ছিল এবং কী অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল ?
উত্তর : চর্যাপদের আবিষ্কৃত পুঁথিটি তালপাতায় লেখা ছিল। পুঁথিটি খণ্ডিত অবস্থায় পাওয়া যায়। তার প্রথম ও শেষ দিকের কিছু পাতা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
প্রশ্ন : চর্যাপদের প্রাপ্ত পুঁথিগত ক'টি পদ পাওয়া গিয়েছিল? ক'টি পদ প্রকৃত পক্ষে ছিল বলে জানা যায় ?
উত্তর : চর্যাপদের প্রাপ্ত পুঁথিতে সাড়ে ছেচল্লিশটি পদ পাওয়া গিয়েছিল।
তাতে প্রকৃতপক্ষে ৫০টি পদ ছিল বলে জানা যায়।
প্রশ্ন : চর্যাপদের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন, এমন চারজন পন্ডিত ব্যক্তির নাম লেখ।
উত্তর : চর্যাপদ নিয়ে আলোচনা করেছেন, এমন চারজন পণ্ডিত হলেন- আচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী, বিধুশেখর শাস্ত্রী এবং ড.সুকুমার সেন।
প্রশ্ন : চর্যাগীতির প্রাপ্ত পুঁথিটির সঙ্গত নাম কী? কোন্ সূত্র থেকে সেটা জানা যায় ?
উত্তর : চর্যাগীতির প্রাপ্ত পুঁথিটির প্রকৃত নাম 'চর্যাগীতিকোষ'।
পরবর্তীকালে আবিষ্কৃত চর্যার তিব্বতী অনুবাদ থেকে সেটা জানা যায়।
প্রশ্ন : চর্যাপদের তিব্বতি অনুবাদকে কে কত সালে আবিষ্কার করেন ?
উত্তর : চর্যাপদের তিব্বতি অনুবাদটি ড. প্রবোধ চন্দ্র বাগচী মহাশয় ১৯০৮ সালে আবিষ্কার করেন।
প্রশ্ন : হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত চর্যাপদের পুঁথিটি কী জাতীয় রচনা ছিল? তার লেখকের নাম কী ?
উত্তর ঃ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাপদের পুঁথিটি ছিল টীকা গ্রন্থ। ৫০টি পদ ও তার টীকা সঙ্কলিত ছিল। নির্মলগিরা টীকা নামে পরিচিত ছিল।
টীকাকারের নাম ছিল মুনি দত্ত।
প্রশ্ন : চর্যার পদগুলি কারা রচনা করেছেন? কী উদ্দেশ্যে?
উত্তর : চর্যারপদগুলি রচনা করেছেন বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকেরা –ধর্ম, সাধনা ও ধর্মতত্ত্বের প্রচার উদ্দেশ্যে।
প্রশ্ন : চর্যাপদের প্রাপ্ত পুঁথিতে কতজন পদকারের নাম পাওয়া যায়? তাঁদের মধ্যে কার রচিত পদের সংখ্যা বেশী?
উত্তর : চর্যাপদের প্রাপ্ত পুঁথিতে মোট ২২ জন পদকারের নাম পাওয়া যায়। তবে তিব্বতি পুঁথি থেকে খণ্ডিত ২৫ সংখ্যক পদের পদকার হিসেবে 'তান্তিপাদ’ নামটি পাওয়ায় ২৩ জন পদকারের অস্তিত্ব স্বীকার হয়।
এঁদের মধ্যে কাহ্নপাদের রচিত পদের সংখ্যা বেশী-১২টি।
প্রশ্ন : কোন্ ভাষা থেকে চর্যাপদের বাংলা ভাষার জন্ম? কোন্ সময়ে ?
উত্তর : মাগধী অপভ্রংশের খোলস ছেড়ে চর্যাপদের প্রাচীন বাংলা ভাষার জন্ম। তবে এই ভাষায় সৌরসেনী প্রাকৃত এবং অপভ্রংশে প্রভাবও আছে।
সময়টা হলো নবম দশম শতাব্দী।
প্রশ্ন : একাধিক পদ রচনা করেছেন এমন চারজন পদকর্তার নাম লেখ।
উত্তর : (১) কাহ্ন পাদ, (২) ভুসুকু পাদ, (৩) সহর পাদ, (৪) কুকুরী পাদ, (৫) লুই পাদ, (৬) শান্তি পাদ ।
প্রশ্ন : হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যার ভাষাকে বলেছেন ‘সন্ধ্যা ভাষা'। সন্ধ্যা ভাষা কী? এই ভাষায় লেখার কারণ কী?
উত্তর : ‘সন্ধ্যা ভাষা’ কোনো স্বতন্ত্র ভাষা নয় সাঙ্কেতিক ভাষা। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন, ‘আলো আঁধারী ভাষা, কতক বুঝা যায়, কতক বুঝা যায় না।'
বিধর্মী বা শত্রু ভাবাপন্ন ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে ধর্মের গুঢ় তত্ত্ব আড়াল করবার জন্যই পদকাররা সন্ধ্যা ভাষার, অর্থাৎ রহস্যময় সাংকেতিক ভাষায় লিখতেন।
প্রশ্ন : চর্যাপদে কোন্ ধর্মের তত্ত্বকথা ব্যক্ত হয়েছে? কী ভাবে?
উত্তর : চর্যাপদে সহজিয়া বৌদ্ধ ধর্মের সাধনতত্ত্বের কথা ব্যক্ত হয়েছে, রূপক সংকেতের মাধ্যমে।
প্রশ্ন : চর্যাপদের মধ্যে কোন্ বাংলা ছন্দের নিদর্শন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে?
উত্তর : চর্যাপদের মধ্যে কলাবৃত্ত নির্ভর 'পয়ার ও ত্রিপদী' ছন্দের নিদর্শন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
প্রশ্ন : চর্যাপদের গুরুত্বপূর্ণ একটি সাহিত্য লক্ষণ উল্লেখ করো।
উত্তর : ধর্মতত্ত্বের কথা রূপকাশ্রয়ে ব্যক্ত করতে গিয়ে পদকারেরা বাস্তব সংসারের চিত্র ব্যবহার করেছেন, তাতে সমকালের বাঙালির দৈনন্দিন জীবনচিত্র,সুখ-দুঃখ, হাসি কান্নার জীবন্ত চিত্র ফুটে উঠেছে। যা উল্লেখযোগ্য কাব্য লক্ষণ।
প্রশ্ন : কোন্ কোন্ দিক থেকে চর্যার পদগুলি গুরুত্বপূর্ণ?
উত্তর : বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন হিসেবে দশম দ্বাদশ শতাব্দীর বাংলাদেশের চর্যাপদগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন : চর্যাপূর্বকালের বা সমকালের বাঙালি রচিত দুটি সংস্কৃত কবিতা সংকলনের নাম লেখ।
উত্তর : চর্যাপূর্বকালের বা সমকালের বাঙালি রচিত দুটি সংস্কৃত কবিতা সংকলনের নাম— ‘কবীন্দ্রবচন সমুচ্চ' ও 'সদুত্তিকর্ণামৃত'।
প্রশ্ন : চর্যাপূর্ব বা সমকালের বাঙালি রচিত দুটি প্রাকৃত কাব্য সংকলনের নামোল্লেখ করো ।
উত্তর : চর্যাপূর্ব বা সমকালের বাঙালি রচিত দুটি প্রাকৃত কাব্য সংকলনের নাম হল হাল-এর ‘গাথাসপ্তশতি' এবং পিঙ্গলাচার্যের ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’।
প্রশ্ন : বাংলা সমাজ ও সাহিত্যের ইতিহাসে ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতককে কী নামে অভিহিত করা হয় ?
উত্তর : বাংলা সমাজ ও সাহিত্যের ইতিহাসে ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতককে অন্ধকার যুগ বলে অভিহিত করা হয়।
প্রশ্ন : মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ছাড়া আর কে কে চর্যাপদ আবিষ্কৃত করেন ?
উত্তর : মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ছাড়া কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অধ্যাপক শশীভূষণ দাশগুপ্ত, পণ্ডিতপ্রবর রাহুল সংকৃত্যায়ন চর্যাপদ আবিষ্কার করেন।
প্রশ্ন : চর্যাপদের প্রধান কবি কাকে বলা হয়? তাঁর রচিত পদসংখ্যা কয়টি?
উত্তর : কৃষ্ণপদাচার্য যা কাহ্নপাকে চর্যাপদের প্রধান কবি বলা হয়।
কৃষ্ণপদাচার্য বা কাহ্নপা রচিত পদের সংখ্যা বারো।
প্রশ্ন : 'বর্ণরত্নাকর'-এর রচনাকাল কত? 'বর্ণ রত্নাকর' কার রচনা?
উত্তর : 'বর্ণরত্নাকর' এর রচনাকাল চতুর্দশ শতাব্দী।
বর্ণরত্নাকর' জ্যোতিরীশ্বরের রচনা।
প্রশ্ন : লুইপা কে? তিনি কবে আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে মনে করা হয়?
উত্তর : চর্যার আদি সিদ্ধাচার্য হলেন লুইপা।
লুইপা খ্রিষ্টীয় সপ্তম অষ্টম শতাব্দীর দিকে আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে ড. শহীদুল্লাহ অনুমান করেছেন।
প্রশ্ন : 'চর্যা' শব্দের অর্থ কী?
উত্তর : 'চর্যা' শব্দের অর্থ আচরণীয়।
প্রশ্ন : চর্যার রচয়িতাদের কি নামে অভিহিত করা হত?
উত্তর : চর্যাপদের রচয়িতাদের সাধারণত সিদ্ধাচার্য নামে অভিহিত করা হত।
প্রশ্ন : চর্যাপদের 'চর্যাচর্য বিনিশ্চয়' নামকরণ কে করেছিলেন ?
উত্তর : চর্যাপদের 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়' নামকরণ করেছিলেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
প্রশ্ন : চর্যার ভাষাকে কী নামে অভিহিত করা হয়?
উত্তর : চর্যার ভাষাকে 'সন্ধ্যাভাষা' বা 'আলো আঁধারি' ভাষা বলে অভিহিত করা হয়।
প্রশ্ন : চর্যাপদের সমাজের কোন শ্রেণির জীবনযাত্রা বর্ণিত হয়েছে?
উত্তর : চর্যাপদে সমাজের নিম্ন শ্রেণির অস্পৃশ্য মানুষের জীবনযাত্রা বর্ণিত হয়েছে।
প্রশ্ন : 'চর্যাগীতি' বলতে কী বোঝ?
উত্তর : যে সব গানে বৌদ্ধ যোগীদের সাধ্য তত্ত্ব ও সাধনপ্রক্রিয়া পরিবেশিত হয়।সেগুলিকে বলা হয় 'চর্যাগীতি'।
প্রশ্ন : চর্যাপদের ভাষাকে 'সন্ধ্যা-ভাষা' বলা হয়েছে কেন?
উত্তর : সন্ধ্যা ভাষার অর্থ হল আলো-আঁধারি ভাষা। আসলে কতক আলো, কতক অন্ধকার, খানিক বোঝা যায়, খানিক বোঝা যায় না। চর্যার ভাষা সকলের কাছে বোধগম্য নয়-তাই চর্যার ভাষা 'সন্ধ্যা ভাষা'।
প্রশ্ন : চর্যার দার্শনিক তত্ত্বটি কী?
উত্তর : চর্যার টীকাকার মুনিদত্ত চর্যার দার্শনিক তত্ত্বটি উদ্ধার করতে চেষ্টা করেছেন।এর দর্শনকে শূন্যবাদ' বলে অভিহিত করেছেন। শূন্যতার মধ্যেই সুখ দুঃখের লোপ ঘটে এবং এতেই মানুষের অস্তিত্ব নিহিত। একমাত্র গুরুর উপদেশেই মহাসুখময় নির্বাণ লাভ করা যেতে পারে। এটাই চর্যার দার্শনিক তত্ত্ব।
প্রশ্ন : 'সন্ধ্যা' শব্দটির ব্যুৎপত্তি লেখো।
উত্তর : সম্ ধা ধাতু থেকে এই শব্দের ব্যুৎপত্তি। ‘সন্ধ্যা' ভাষার অভীষ্ট অর্থ সম্যক ধ্যান যোগে বুঝতে হয়।
প্রশ্ন : 'নবচর্যাপদ' কী ?
উত্তর : হরপ্রসাদের চর্যাপুঁথি আবিষ্কারের অনেক পরে, ড. শশীভূষণ দাশগুপ্ত নেপাল থেকে আরো দুশো পঞ্চাশটি নতুন চর্যাগান আবিষ্কার করেন। তা থেকে আটানব্বইটি নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘নবচর্যাপদ' মুদ্রিত হয়। এগুলিই হল “নবচর্যাপদ।।
✍️প্রশ্নমান-৫:
১.চর্যাপদে যে ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে তার নাম কী? এই ভাষার বৈশিষ্ট্য কী কী ?
উত্তর ঃ মাগধী অপভ্রংশ থেকে বাংলা ভাষার সৃষ্টি হয়েছে। প্রাচীনযুগে এই বাংলা ভাষার একমাত্র নিদর্শন হল চর্যাপদ। চর্যাপদের ভাষা বাংলা ভাষা হলেও হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়-এর নাম দিয়েছেন সন্ধ্যা ভাষা অর্থাৎ সম্যকভাবে অনুধাবন করার ভাষা। এই সন্ধ্যা ভাষার বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপ।
(১) এর, অর বিভক্তির দ্বারা সম্বন্ধপদের সৃষ্টি।
(২) গৌণকর্ম সম্প্রদানে-রে, কে-ক বিভক্তির ব্যবহার।
(৩) ত-তে বিভক্তি দিয়ে অধিকরণের অর্থ প্রকাশ।
(৪) মাঝ, অন্তর, সাঙ্গ প্রভৃতির অনুসর্গ পদরূপে প্রয়োগ।
(৫) ইল-যোগে অতীতকালের ক্রিয়াপদ গঠন ।
(৬) ইব যোগে ভবিষ্যৎকালের পদ গঠন।
(৭) ইলে, ইতে-ইয়া যোগে অসমাপিকার পদ সৃষ্টি।
(৮) চর্যাপদে বাংলাভাষার নিজস্ব বিশিষ্ট ইডিয়ম প্রয়োগের নিদর্শন সুপ্রচুর।
(৯) চর্যার ভাষার অর্বাচীন অপভ্রংশ, ভাষার কিছু চিহ্ন আছে।
২.চর্যাপদের নামকরণ নিয়ে যে সমস্যা আছে তা আলোচনা করো।
উত্তর ঃ চর্যাপদের নামকরণ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি হয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় ‘হাজার বছরের পুরানো বাংলা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোঁহা' গ্রন্থে পুঁথিটির নামকরণ করেন “চর্যা বিনিশ্চয়’। এই নাম পুঁথিটির প্রকৃত নাম নয়। পুঁথিটি খণ্ডিত থাকায় প্রকৃত নাম তখন জানা সম্ভব হয়নি। সম্পাদক নিজের বিবেচনা মতো এই নামকরণ করেছেন । আচার্য বিধুশেখর শাস্ত্রী মনে করেন, একটি ভ্রান্ত, পাঠের উপর ভিত্তি করে হরপ্রসাদ এই নামকরণ করেছেন। সেই পাঠে ‘আশ্চর্য চর্যাচয়' কথাটি আছে। তাই, বিধুশেখর
‘আশ্চর্য চর্যাচয়’ নামটি ব্যবহার করতে চান। কিন্তু মনীন্দ্র মোহন বসু তাঁর 'চর্যাপদ' গ্রন্থে বলেছেন, ‘আশ্চৰ্য্য’ কথাটি চর্যাপদের বিশ্লেষণ। পুঁথির নামের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তাই বিধুশেখরের নামকেও ঠিক বলা যায় না। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী মধ্যপন্থা অবলম্বন করেন আর নামকরণ করেন—চর্য্যশ্চর্য্য বিনিশ্চয়'। পণ্ডিতদের বিবেচনা প্রসূত এই সব কাল্পনিক নামকরণের প্রবৃত্তি ঘুচে গেল চর্যাপদের তিব্বতি টীকা আবিষ্কৃত হবার পর। ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী এই টীকা গ্ৰন্থ প্রকাশ করলে জানা যায়, মুনিদত্তকৃত নির্মলগিরা টীকার প্রকৃত নাম ছিল ‘চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'। ‘বৃত্তি’ শব্দের অর্থ টীকা। কাজেই, মূল সংকলনটির নাম ছিল ‘চর্যাগীতিকোষ’—এটা মনে করা যেতেই পারে।
৩.চর্যাপদ যারা রচনা করেছেন তাদের সম্পর্কে কী জানা যায় তা আলোচনা করো।
উত্তর : চর্যাপদের মুনিদত্তকৃত সংস্কৃত টীকার তিব্বতী অনুবাদ আবিষ্কৃত হলে জানা যায়, চর্যাপদের ৫১টি পদ লিখেছিলেন ২৪ জন সিদ্ধাচার্য। সাধন ভজন সংক্রান্ত এই পদ বা গানগুলির শেষে―ভণিতায় পদকারেরা নিজেদের নাম জানিয়েছেন। ২৪ জন পদাকারের মধ্যে কাহ্নপাদ, ভুসুকুপাদ, সরহপাদ, কুক্কুরীপাদ, লুইপাদ, শবর পাদ,শান্তিপাদ প্রমুখের পদের সংখ্যা একাধিক। তিব্বতি গ্রন্থ থেকে পদকর্তাদের পরিচয় কিছু কিছু জানা যায়। শৈব নাথ ধর্মের এবং তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের যে 'চৌরাশি সিদ্ধাচার্য' বা ধর্ম গুরুর কথা পাওয়া যায়, চর্যাকারদের কেউ কেউ তাঁদের অন্তর্ভুক্ত। তাঁরা বাংলা,বিহার, উড়িষ্যা ও আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করতেন। সেই জন্যই তাঁদের পদগুলিতে পূর্ব ভারতের ছবিই প্রতিফলিত। পদাকারেরা সব সময় ভণিতায় যে প্রকৃত নাম ব্যবহার করতেন, তা নয়। ছদ্ম নামও ব্যবহার করতেন। যেমন 'কুক্কুরীপাদ' কারো প্রকৃত নাম হতে পারে না, এটি ছদ্ম নাম
হওয়াই স্বাভাবিক। কোনো নাম বিভিন্ন ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। ফলে পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি ঘটে। পদাকারদের মধ্যে ব্রাহ্মণ, অব্রাহ্মণ, বাঙালি, অবাঙালি, ধনী-দরিদ্র, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ--সব রকমই ছিল। ‘কুক্কুরীপাদ’ আগে ব্রাহ্মণ ছিলেন, পরে বৌদ্ধ হন।ভুসুক প্রথমে অবাঙালি ছিলেন পরে বাঙালি হয়েছেন চন্ডালী বিবাহ করে- আজ
ভুসুকু বঙ্গালি ভৈলি নিতা ঘরণী চন্ডালী লেলী'। সরহপাদের সম্পর্ক কিছু তথ্য পাওয়া যায়। তাঁর নামে দোঁহা পাওয়া গিয়াছে। লুই পাদ প্রাচীন হলেও কাহ্নপাদ জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর পদের সংখ্যা দেখেই সেটা বোঝা যায়। তিনি একাই ১৩টি পদ লিখেছেন।
৪.চর্যার রচনাকাল সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর : চর্যার পদাকারদের জীবৎকাল স্পষ্টভাবে জানা সম্ভব হয়নি বলে পদগুলির রচনাকাল সম্পর্কেও স্পষ্টভাবে কিছু বলা যায়নি। অন্যান্য বিষয়ের উপর নির্ভর করেই রচনাকাল নির্ণয়ের চেষ্টা হয়েছে। ভাষাগত লক্ষণ বিচারই তার মধ্যে প্রধান।নব্যভারতীয় আর্যভাষাগুলি অপভ্রংশের খোলস ছেড়ে স্বতন্ত্র ভাষা রূপে গণ্য হতে থাকে খ্রিস্টীয় নবম-দশম শতাব্দীতে। কিছু শক্তি অর্জন করার পরই কোনো ভাষায় কাব্য রচনা সম্ভব। তাই দশম শতাব্দী থেকে চর্যাপদ রচনা শুরু হয়েছে, এটা অনুমান করলে অযথার্থ হয় না। ভাষাচার্য ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় চর্যাপদের ভাষা বিচার করেই তাঁর ‘The Origin and Development of Bengali Language' গ্রন্থে বলেছেন— ‘The Period 950-1200 A.D. would thus seem to be a reasonable date to give to these poems' তিনিই গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন চর্যাপদের ভাষা অপভ্রংশ নয়, ওড়িয়া-অসমিয়াও নয়। চর্যাপদের ভাষার যা লক্ষণ, তা দশম-থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে বজায় ছিল। ভাষাতাত্ত্বিক ড. সুকুমার সেনও তাঁর ভাষার ইতিবৃত্ত গ্রন্থে সুনীতিকুমারের মতকে সমর্থন করেছেন। ড. মহম্মদ শহীদুল্লাহ্ও চর্যার রচনাকাল দশম দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে বলেই সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। প্রাপ্ত পুঁথির লিপি বিচার করে রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ড. সুকুমার সেন প্রমুখ পন্ডিতেরা বুঝেছেন, সে লিপি চতুর্দশ শতাব্দীর আগের নয়। মুনি দত্তের টীকাটি ছিল অনুলিপি। সেই বিচারেও মূল পুঁথি দ্বাদশ শতাব্দীর হতে পারে। কাজেই, চর্যাপদ দশম-দ্বাদশ শতাব্দীর রচনা বলা যেতেই পারে।
৫.চর্যাপদে যে ধর্মতত্ত্ব বিশ্লেষিত হয়েছে তা আলোচনা করো।
উত্তর ঃ বুদ্ধদেবের মৃত্যুর পর বুদ্ধদেবের বাণী ও আদর্শ নিয়ে মতবিভেদে বৌদ্ধ সম্প্রদায় হীনযান ও মহাযান এই দুটিভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।মহাযান সম্প্রদায় আবার বজ্রযান ও সহজযান এই দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এই সহজযানী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সাধনার সঙ্গীত হল চর্যাপদ। চর্যাপদে সহজিয়াদের সাধন তত্ত্বই বিবৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে বোধিচিত্তের বৈশিষ্ট্যই হল তিনি করুণা ও আনন্দময়। এই করুণা ও আনন্দের সহজাত বোধ নিয়েই সহজিয়াদের সাধনা।দেহসাধনার দ্বারা সিদ্ধাচার্যরা জন্ম-মৃত্যু ও জাগতিক সুখ দুঃখের অতীত নির্বিকল্প সুখ উপভোগ করতে চান। মহাসুখ বা নির্বাণ লাভই সহজিয়াদের মূল সাধনা। তাঁদের মতে এই মহাসুখ লাভ করতে গেলে গুরুকে অবলম্বন করতে হবে। মানুষের দেহে প্রধান তিনটি নাড়ী আছে। এই তিনটি নাড়ী হল ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুন্মা। ইড়া ও পিঙ্গলার গতি হল নিম্নাভিমুখী আর সুষুন্মার গতি হল নাভিদেশ থেকে মস্তিষ্কের উর্দ্ধদিকে। ইড়া ও পিঙ্গলা, সুষুন্মাকে সবসময় নিম্নদিকে টেনে রাখে। সাধক ইড়া ও পিঙ্গলার প্রভাব থেকে সুষুন্মাকে মুক্ত করে মস্তিষ্কের ঊর্দ্ধদিকে নিয়ে যান, ফলে মহাসুখ লাভ হয়। এই ধর্মতত্ত্বই চর্যাপদে বিবৃত হয়েছে।
✍️প্রশ্নমান-১০:
১.চর্যাপদে তৎকালীন সমাজজীবনের যে প্রতিচ্ছবি বর্ণিত হয়েছে তা আলোচনা কর।
উত্তর : সাহিত্য সমাজের দর্পণ। কবিরা সমাজবদ্ধ জীব, তাই তাদের জগৎ বা অজ্ঞাতসারে সমাজ তাদের সাহিত্যে ছায়া ফেলবেই। চর্যাকবিরা আধ্যাত্মবোধ প্রকাশে অত্যন্ত সচেতনভাবে তাদের দৃষ্ট সমাজের অসংখ্য তথ্য ব্যবহার করেছেন। বৃহত্তর বঙ্গের পটভূমিকায় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বাঙালির সমাজজীবন, গৃহজীবন ও পারিবারিক জীবনের বাস্তব চিত্রে চর্যাপদ পূর্ণ। সেকালের মানুষের জীবন-জীবিকা, খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান, আমোদ-প্রমোদ, প্রেম-ভালোবাসা, রীতি-নীতি, আচার-ব্যবহার, চাল-চলন, পোশাক-পরিচ্ছদ, কথাবার্তা কী নেই চর্যাগীতিতে? সেই দিক দিয়ে চর্যাগীতি রত্নগর্ভা অজন্তা। সেকালের দরিদ্র, অবহেলিত, পরিত্যক্ত, ডোম, ব্যাধ, শবর প্রভৃতি জাতির একটি পরিপূর্ণ জীবনচিত্রে চর্যাগীতি আকর্ষণীয়। চর্যাগীতিতে প্রতিফলিত সমাজচিত্রের উপাদানগুলি নিম্নে আলোচিত হলো—
৷৷ এক ৷৷ ভৌগোলিক পরিবেশ :
চর্যাগীতি মূলত বাংলাদেশের বৌদ্ধ সাধকদের সাধন সঙ্গীত। তাই তাদের রচনায় উপমান ব্যবহারে বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিবেশ প্রকৃতির প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এই ভৌগোলিক প্রকৃতির মধ্যে আবার প্রাধান্য অনুসারে নাব্য ভূ-প্রকৃতি সর্বাগ্রে গণ্য। নদীমাতৃক-সমুদ্র, নদী, খাল, বিলে বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেক বেশি উর্বরা। পরমার্থ সাধনার ক্ষেত্রে নদী ও সমুদ্রের রূপক অবশ্য ভারতীয় ভক্তি সাহিত্যে বহুদিন থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু নদী, খাল, নৌকা চালনা ও সাঁকো নির্মাণের রূপক চর্যাকারীরা যত ব্যাপকরূপে ব্যবহার করেছেন তার তুলনা অন্য কোথাও নেই। এছাড়া চর্যাপদের বিভিন্ন পদে সাঁকো, নৌকা প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার নদীমাতৃক বাংলাদেশের কথা এবং নাব্য ভূ-প্রকৃতির কথা মনে করিয়ে দেয়।
৷৷ দুই ৷৷ সমাজসংস্থান :
চর্যাপদগুলি যে সময় রচিত হয়েছিল সেসময় বাংলাদেশে সেন রাজবংশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত। সেন বংশের পূর্বেকার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পালবংশীয় রাজারা ধর্ম
ও সামাজিক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কিছুটা উদারনৈতিক ছিলেন। নিজেরা বৌদ্ধ হলেও
ব্রাহ্মণ্য ধর্ম সম্পর্কে তাদের কোন অসহিষ্ণুতার প্রমাণ ইতিহাসে নেই। কিন্তু ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী সেন রাজগণ পরধর্ম সম্পর্কে বেশ অসহিষ্ণু ছিলেন। তাদের আমলে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রভাব ও ব্রাহ্মণ্য বর্ণাশ্রম প্রথা অনুযায়ী সামাজিক স্তর বিভাগের রীতি বিশেষ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। এই বর্ণানুযায়ী সমাজব্যবস্থার বেদাশ্রিত জনগোষ্ঠী ছিল অভিজাত এবং বেদধর্ম এবং বেদাচার বহির্ভূত জনগোষ্ঠী ছিল অন্ত্যজ ও অস্পৃশ্য। অভিজাত সমাজ ও অনভিজাত সমাজ পারস্পরিক জুগুপ্সা ও বিরূপতা পোষণ করত। চর্যাকারীগণ ছিলেন তান্ত্রিক বৌদ্ধ—এই কারণে চর্যাগীতির রচয়িতারা ডোম্বি, কামলি, শবর প্রভৃতি
অন্ত্যজ শ্রেণির ব্যক্তি এবং চর্যাগীতির পাত্রপাত্রীগণ ডোম, চণ্ডাল, কুন্তি, শবর, ব্যাধ,
জেলে প্রভৃতি অস্পৃশ্য শ্রেণিভুক্ত। সমাজের অভিজাত উচ্চ বর্ণের মানুষ যে নিম্নবর্ণের
মানুষ সম্পর্কে একধরনের বিরূপতা পোষণ করতেন তারই ইঙ্গিত পাওয়া যায় কাহ্নপাদের একটি চর্যায়-
“নগর বাহিরি রে ডোম্বি তোহোরি কুড়িআ।
ছোই ছোই জাসি বাম্হণ নাড়িআ।।”
।। তিন ৷৷ বাসস্থান :
সেকালের উচ্চবর্ণের লোকেরা গ্রামীণ সমতলভূমিতে বাস করত। কিন্তু ডোম,শবর, ব্যাধ, চণ্ডালেরা গ্রাম সীমান্তে পাহাড়ের বুকে বা উঁচু টিলার ওপর ছোট ছোট কুঁড়েতে বাস করত। চর্যায় আছে—
ক. “টালত মোর ঘর নাহি, পড়বেষী।”
খ. “উঁচা উঁচা পাবত তহিঁ বসই সবরী বালী।”
গ. “নগর বাহিরি রে ডোম্বি তোহরি কুড়িআ।”
।। চার ।। জীবিকা :
চর্যাপদের পদকারগণ সমাজজীবনের নানাদিক থেকে উপেক্ষিত মানুষগুলির নানা জীবিকা বা বৃত্তির কথা বলেছেন।যেমন—(ক) মাঝি-নৌকা চালানো, (খ) শবর বা ব্যাধ-শিকার করা,(গ) ডোম—চাঙাড়ি তৈরি করা, (ঘ) তাঁতি—তাঁত বোনানো, (ঙ) ধুনারি-তুলা ধুনা, (চ) শুঁড়ি—মদ চোয়ানো, (ছ) কাঠুরিয়া—গাছ কাটা বা ফাড়া এছাড়াও জলদস্যুর কথা, ব্রাহ্মণের কথা, চৌর্য বৃত্তির কথা, ধীবরদের কথাও আছে।
।। পাঁচ ।। বেশভূষা :
চর্যাপদে যাদের কথা তুলে ধরা হয়েছে তাদের বেশভূষার পরিচয় সবিস্তারে উল্লেখিত হয়নি। তবে শবর কন্যারা মাথায় ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জার মালা, কানে কুন্তল বা কানেট, পায়ে ঘণ্টা নেয়ুর বা নুপুর পরিধান করত। সোনা ও রপার প্রচলন ছিল অত্যন্ত উঁচু সমাজে। এছাড়াও তখনকার যোগীরা হাড়ের মালা পড়ত।
৷৷ ছয় ।। আসবাবপত্র :
চর্যাপদ শ্রমজীবিদের চিত্রে পূর্ণ। তাই তাদের ব্যবহৃত আসবাবপত্র খুব সাধারণ ছিল। যেমন—ভাতের হাঁড়ি, দুধ দুইবার পিটা, মদ রাখবার ঘড়া, নানাকার্যে ব্যবহৃত ঘড়লি বা গাড়ু, বসবার জন্য ব্যবহৃত পিড়ি প্রভৃতি। এছাড়া অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে কুঠার ও টাঙ্গি, রান্না করবার খুন্তি, ঘরদোর রক্ষা করবার জন্য কোঞ্চাভাল (তালাচাবি), জলসেচের সেগুতি ও নদী পারাপারের জন্য নৌকার ব্যবহার ছিল।
৷৷ সাত ৷৷ খাদ্যদ্রব্য ও ফলমূল :
চর্যাপদে প্রধান খাদ্যরূপে ভাতের কথা আছে। এছাড়াও শিকার থেকে পাওয়া মাংসের কথা, গোরুর দুধের কথা চর্যাপদ থেকে পাওয়া যায়। ফলের মধ্যে তেঁতুল ও কম্বুচিনার কথা চর্যাপদে আছে। তবে কম্বুচিনা কি ফল ছিল তা জানা যায় না। তবে এ ফল পাকলে শবর-শবরীরা আনন্দে মেতে উঠত একথা আমরা চর্যাপদ থেকে জানতে পারি।
।। আট ।। পশুপাখি ও জীবজন্তু :
গোরু গৃহে পালিত হত। মাংসের জন্য হরিণ শিকার করা হত। এছাড়াও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে ইঁদুর, সাপ, খরগোশ, হাতি, শিয়াল ও সিংহের কথা উল্লেখ আছে। পাখির মধ্যে ময়ূর ও কাকের কথা চর্যাপদ থেকে জানতে পারি।
।। নয় ।। আমোদ-প্রমোদ ও উৎসব অনুষ্ঠান :
চর্যাপদের মানুষগুলি দরিদ্র ছিল। কিন্তু তাদের দারিদ্র্যপীড়িত জীবনে উৎসব অনুষ্ঠান লেগেই থাকত। অবসর বিনোদনের অন্যতম উপায় ছিল, নয়বল (দাবাখেলা)।তাদের সমাজে তৎকালীন সময়েও নৃত্যগীতেরও বেশ চল ছিল। নাচে-গানে কোন কোন ডোম রমণী পটু ছিল। সেকালে বুদ্ধ নাটক অনুষ্ঠিত হত। সতেরো নং চর্যায় আছে—
“নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী
বুদ্ধ নাটক বিসমা হোই”
এরকম নাট্যানুষ্ঠানে স্ত্রী লোকেরা নর্তকীর ও পুরুষ লোকেরা গায়কের ভূমিকা পালন করত। এই নাট্যানুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে হেরুকবিনা, পটহ, মাদল, ডমরু, ঢোল, কাশি, দুন্দুভি, ডোঙ্গরী প্রভৃতির ব্যবহার ছিল। নাট্যানুষ্ঠানের পরে সবাই মদ্যপান করত কিংবা কপ্পুর দেওয়া পান কম্বুচিনা খেত।
।। দশ ।। সমাজিক সম্পর্ক :
সংস্কার বিশ্বাস প্রথা, বিবাহরীতি : স্বামী, স্ত্রী, শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ, শ্যালিকা নিয়ে
পরিবার পূর্ণ থাকত। বিয়েতে যৌতুক নেওয়া হত। শাখা প্রথা প্রচলিত ছিল। দিনের বেলায় বউ ভয়ে বেরোতে পারত না। রাত্রিবেলায় সেই বউ উচ্চবর্ণের পুরুষদের সঙ্গে মিলিত হতে যেত। যাওয়ার সময় তারা শ্বশুর-শাশুড়িকে বাইরে থেকে তালাবন্ধ করে রাখত। মানুষ মারা গেলে সৎকার করা হত।
আলোচনার সমাপ্তিতে এসে বলতে পারি ধর্মের আঁধার হিসাবে চর্যাপদ লেখা হলেও তা আজ থেকে হাজার বছর আগেকার বাস্তব সমাজের নানা তথ্যে পূর্ণ। যা সেকালের সামাজিক ইতিহাস রচনায় উল্লেখযোগ্য দলিল।
২.চর্যাপদের সাহিত্যমূল্য বা কাব্যমূল্য আলোচনা করো।
উত্তর : বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ। এগুলি বৌদ্ধ সহজিয়া সম্প্রদায়ের সাধনপ্রণালী। সহজিয়া সিদ্ধাচার্যরা ধর্ম জীবনের অঙ্গ হিসাবে এই চর্যাপদ রচনা করেছিলেন। কিন্তু তা হলেও বাস্তব জীবনের চিত্রের ক্ষণিক উদ্ভাসে এবং মন ও প্রাণের আকস্মিক উদ্বেলতায় চর্যা মাঝে মাঝে সত্যই রস সৃষ্টি করেছে। পদগুলি হয়ে উঠেছে সাহিত্যমূল্যের রসে উত্তীর্ণ।
এবারে ধর্মজীবনের অঙ্গ হিসাবে চর্যাপদগুলি লিখিত হলেও তার মধ্যে কতটা পরিমাণে কাব্যমূল্য লুকিয়ে আছে তা আমরা খোঁজার চেষ্টা করব—
চর্যাপদের সাহিত্যমূল্য:
।। এক ।। চর্যাপদ : গান, কবিতা, ক্ষুদ্র কবিতা, খণ্ড কবিতা, দীর্ঘ কবিতা নয় :চর্যাপদ আকারে ক্ষুদ্র কবিতা কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ কবিতা। সমকালীন চুটকি জাতীয় কবিতা অবশ্যই নয়। কিন্তু দীর্ঘ কবিতাও নয় আবার বৈষ্ণব বা শাক্তপদের মতো ক্ষুদ্র কবিতা হলেও কোনো ক্রম রক্ষা করেনি। কাহিনী নির্মাণ করেনি। তবে সেকালের কবিতার মতো চর্যাপদের ‘ভণিতা প্রথা' বর্তমান। অধিকাংশ কবিতা দশ চরণে সমাপ্ত। তবে দু একটা কবিতা আট, বারো বা চোদ্দো চরণের আছে। আবার গান করা হত বলে প্রতিটি চর্যার মাথায় রাগ আছে এবং রাগিণীরও উল্লেখ আছে। চর্যাগুলিতে প্রাপ্ত রাগ রাগিণীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –‘গুর্জরী', ‘দেবক্রী’, ‘দেশাখ’, ‘কামোদ’, ‘ধনসী’ প্রভৃতি। প্রতিটি চর্যায় দুটি করে চরণের পরে ‘ধু' শব্দটি আছে। অর্থাৎ প্রতিটি প্রবচনই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাওয়া হত। চর্যাপদের সাহিত্যমূল্য বিচারে এগুলি অবশ্যই স্মরণীয়।
৷৷ দুই ৷৷ চর্যাপদ : ছন্দ : চর্যাপদের ছন্দ ষোড়শ মাত্রিক পদ। কুল ছন্দ কোনো কোনো ছান্দসিকের মতে এই পাদাকুলক ছন্দ থেকে হিন্দি চৌপায় ও বাংলা ‘পয়ার’ ছন্দের উৎপত্তি। বাংলা সাহিত্যের প্রথম কাব্যগ্রন্থ চর্যাপদ হলেও প্রতিটি কবিতায়
মিলবন্ধন ও পর্ব নির্মাণকৌশল ও ছন্দ সৃষ্টি শ্রদ্ধাযোগ্য।
চর্যাপদে মোট 37টি কবিতায় এরকম ৪ + ৪ + ৪ + ৪ = ১৬টি মাত্রার চরণবন্ধ ও অন্ত্যমিল বর্তমান। এছাড়াও ১০টি চর্যাপদে ৮ + ৮ + ১২= ২৮ মাত্রার চরণ ও অন্ত্যমিল আছে। যেমন—
উঞ্চা উঞ্চা পাবত তঁহি
বসই সবরী বালী। =৮ + ৮ + ১২
বলাবাহুল্য, এই চর্যাগুলির শব্দচয়ন যেমন সুন্দর তেমনি প্রতিটি পদ ছন্দ মাধুর্যের জন্য শ্রুতিনন্দন। তবে চর্যার ছন্দকে আমরা প্রাচীন মাত্রাবৃত্তের আদিরূপ বলে মনে করি।
৷৷ তিন ৷। চর্যাপদ : অলংকার : চর্যাপদ কর্তাগণ সৌন্দর্যের উপাসক ছিলেন বলে তাঁদের গানে অলংকার সহজলভ্য। বিচিত্র অলঙ্কারে চর্যাগীতি ঠাসা।অন্তানুপ্রাসের জন্য আন্ত্যমিলনের ধ্বনির ছটা যেমন বর্তমান তেমনি প্রতিটি কবিতা শেষ অলংকারের একেকটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত —
সোনে ভরিতী করুণা নাবী।
রুপা থোই নাহিক ঠাবী।।
প্রতিটি কবিতার মতই এই কবিতার দুরকম অর্থ বা শ্লেষ অলংকারের বৈশিষ্ট্য। আবার করুণা নাবী রূপক অলঙ্কার। এছাড়াও চর্যাগীতিতে উপমা, উৎপ্রেক্ষা, অতিশয়োক্তি, বিরোধাভাস ও ব্যাজস্তুতি অলঙ্কারের উদাহরণ প্রচুর। তবে চর্যাতে বিরোধাভাসের উদাহরণই বেশি দ্রষ্টব্য। যেমন-
ক. দুলি দুহি পিটা ধরণ নী জাই।
খ. রুখের তেন্তলি কুম্ভীরে খাঅ।
গ. বলদ বিআ এল গবি আ বাঁকে
আবার, “নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী।/বুদ্ধ বিষমা হোই।।”–এই পদটি লক্ষ করা
যায় তাহলে দেখা যাবে যে এখানে নাচন্তি ও গান্তি শব্দের সংযুক্ত ব্যঞ্জন “ন্ত ক্রমানুসারে ধ্বনিত হয় যা ছেকানুপ্রাসের উদাহরণ।
।। চার ।। চর্যার প্রবাদ প্রবচন : চর্যাগীতিতে বেশ কিছু প্রবাদ প্রবচন আছে
যেমন-
।। ক ৷৷ আপনা মাংসে হরিণা বৈরী।
।। খ ।। দুহিল দুধু কি বেন্টে ডামাঅ।।
কাব্যের চমৎকারিত্ব সৃষ্টিতে এই প্রবাদগুলি চর্যাগীতিগুলিকে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পৌঁছে দিয়েছে।
।। পাঁচ ।। চর্যার ধাঁধা : চর্যাপদে এমন কিছু ধাঁধা আছে যেগুলি আমাদের ভাবিয়ে তোলে। এগুলির রচনার কৌশল ও উল্লেখযোগ্য যেমন-
।। ক ।। বলদ বিআ এল গবিআ বাঁঝে।
।। খ ।। জো সো চৌর সো সাবি
।। গ ।। নিতে নিতে যিআলা যিহে যম জুঝা।
।। ছয় ।। চর্যাপদের সমাজচিত্র : সাহিত্য সমাজজীবনের দর্পণ। কবিরাও সমাজবদ্ধ জীব। তাই তাদের জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে সমাজ তাদের কাব্যে ছায়া ফেলবেই। তাই চর্যার কবিরা তাদের জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে তাদের কাব্যে আধ্যাত্মবোধ প্রকাশ করতে গিয়েও অত্যন্ত সচেতনভাবে তাদের দৃষ্ট সমাজের অসংখ্য তথ্য ব্যবহার করেছেন।
বৃহত্তর বঙ্গের পটভূমিকায় দশম-দ্বাদশ শতাব্দির বাঙালির সমাজজীবন, গৃহজীবন ও পারিবারিক জীবনের বাস্তব চিত্রে চর্যাপদ পূর্ণ। সেকালের মানুষের জীবন-জীবিকা, খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান, আমোদ-প্রমোদ, প্রেম-ভালোবাসা কি নেই চর্যাগীতিতে?' সেদিক থেকে দেখতে গেলে চর্যাপদ যেন রত্নগর্ভা অজন্তা। আলোচনার পরিশেষে এসে বলতে পারি চর্যাগীতি সাধনসঙ্গীত হলেও রসের প্রকাশে, চিত্রকলা সৃষ্টিতে, গানে ও ছোটো গল্পের আখ্যানের ভঙ্গিতে মানব জীবনের বৈচিত্র্য প্রকাশ পায়। ছন্দ অলংকারের মাধুর্য প্রকাশে ধাঁধা ও প্রবাদ প্রবচনের মাধুর্যে, তৎকালীন সমাজজীবনের চিত্র পরিস্ফুটনে চর্যাপদ সর্বকালীন সাহিত্যের আসনে স্থান লাভ করেছে। তাইতো চর্যাপদ শুধুই ধর্মীয় সঙ্গীত নয় এর সাহিত্যসম্পদ ও কাব্যমূল্য অসাধারণ।
...............
For pdf whatsapp 👉9547382324