📚রূপনারায়ণের কূলে -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: সম্পূর্ণ কবিতা, কবি পরিচিতি ও বিষয়বস্তু📚
কবি পরিচিতি:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)- এককথায় তাঁর পরিচয়, তিনি বিশ্বকবি। তিনি ভারত তথা সমগ্র এশিয়া মহাদেশের প্রথম নোবেলজয়ী। কবিতা,গান, ছোটোগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক থেকে শুরু করে চিত্রচর্চা- সাহিত্য ও শিল্পের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর অবাধ বিচরণ। অবশ্য তাঁর মূল খ্যাতি কবি হিসেবে। তিনি সর্বজনশ্রদ্ধেয় কবিগুরু। বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে তিনি এককভাবে একটি অধ্যায়। বাংলা সাহিত্যের নির্যাস পেতে হলে আগে তাঁকে জানতে হবে। উল্লেখযোগ্য কাব্য- ‘মানসী’, ‘চিত্রা’, ‘চৈতালি’, ‘গীতাঞ্জলী’, ‘পুনশ্চ’ প্রভৃতি।
উৎস:
‘রূপনারানের কূলে’ কবিতাটি কবির ‘শেষলেখা’ কাব্যের অন্তর্গত। এই কাব্যের কবিতাগুলি কবির মৃত্যুর কিছুকাল আগে রচিত হয়েছিল এবং তাঁর মৃত্যুর পরে ‘শেষলেখা’ নামে কাব্য আকারে প্রকাশিত হয়। কবি নিজে কোনো কবিতারই নামকরণ করে যান নি। কবিতাগুলি সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত ছিল। আলোচ্য কবিতাটি শেষলেখা কাব্য সংকলনের এগারো সংখ্যক কবিতা।
বিষয় সংক্ষেপ:
‘রূপনারানের কূলে’ কবিতাটি একটি দার্শনিক-ভাবসমৃদ্ধ কবিতা। রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় ‘রূপ’ হল দৃশ্যমান এই জগত আর ‘অরূপ’ হল অনুভূতিগোচর। এখানে ‘রূপনারান’ কোনো নদী নয় বরং দৃশ্যমান এই জগৎসংসারই হল ‘রূপনারান’। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কবির উপলব্ধি এই কবিতার মূল বিষয়বস্তু।
জীবনের শেষ লগ্নে পৌঁছে কবির চেতনা হল। এই বিশেষ চেতনা হওয়াকেই কবি বলেছেন জেগে ওঠা। সংসারের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা মানেই ঘুমিয়ে থাকা। মৃত্যুর পূর্বে মানুষের মন মোহমুক্ত থাকে তাই কবির এই চেতনা পুরোপুরি বাস্তব। কবি বলেছেন যে এই জগৎ কোনো স্বপ্ন নয়। রক্তের অক্ষরে কবি নিজের রূপ প্রত্যক্ষ করলেন অর্থাৎ দুঃখে-কষ্টে-বেদনায় আহত যে মানব-সত্তা সেটাই হল মানুষের প্রকৃত স্বরূপ। কষ্টের মধ্য দিয়েই মানুষ নিজেকে নিজে খুঁজে পায়। কবিও নিজেকে চিনেছেন শতকষ্টের মধ্যে।
এরপর কবি সত্যের মহত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন এইভাবে- সত্য কখনো ঠকায় না, তাই সত্য যতই কষ্টকর হোক সত্যকে স্বীকার করাই দরকার।
কবিতার শেষ অংশে কবির মৃত্যুচেতনা স্থান পেয়েছে। সারাজীবন ধরে আমরা যা অর্জন করি, সেইসব পার্থিব জিনিস মৃত্যুর হাতে তাকে সঁপে দিয়েই আমাদের মুক্তি।
শেষকথা- মৃত্যুর আগে মানুষের ভাবনা একমুখী থাকেনা। তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তাই সেই মুহুর্তেও কবিতা লিখতে পেরেছেন। এই কবিতাতেও তিনরকম ভাবনার স্রোত মিশে রয়েছে। কবির আত্মোপলব্ধি, সত্যোপলব্ধি আর মৃত্যুচেতনা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
শব্দার্থ:
রূপনারান– রূপনারায়ণ বা রূপনারান একটি নদীর নাম (দ্বারকেশর এবং শিলাই নদীর মিলিত প্রবাহের নাম রূপনারায়ণ) কিন্তু আলোচ্য কবিতায় রূপনারান কোনো নদীর নাম নয়। কবি দৃশ্যমান এই জগতসংসারকে রূপনারান বলেছেন। বঞ্চনা– প্রতারণা, ছলনা। আমৃত্যু– মৃত্যু পর্যন্ত। দেনা– ঋণ।
সম্পূর্ণ কবিতা:
রূপনারানের কূলে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রূপ-নারানের কুলে
জেগে উঠিলাম,
জানিলাম এ জগৎ
স্বপ্ন নয়।
রক্তের অক্ষরে দেখিলাম
আপনার রূপ,
চিনিলাম আপনারে
আঘাতে আঘাতে
বেদনায় বেদনায়;
সত্য যে কঠিন,
কঠিনেরে ভালােবাসিলাম,
সে কখনাে করে না বঞ্চনা।
আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন,
সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে,
মৃত্যুতে সকল দেনা শােধ করে দিতে।
..............................