📚বি.এ মেজর বাংলা: আমাদের ভাষা সংকট-প্রমথ চৌধুরী:প্রশ্নোত্তর(প্রশ্নের মান-২,৫,১০)📚

✍️ প্রশ্নমান-২:

প্রশ্ন: "আমার ভাষা সংকর"-কে এটি আবিষ্কার করেন?

উত্তর : এটি আবিষ্কার করেন শ্রীযুক্ত বারীন্দ্রকুমার ঘোষ।

প্রশ্ন: “দেশসুদ্ধ লোকের ভাষা সংকর হয়ে গেছে"-তাৎপর্য কী?

উত্তর: প্রাবন্ধিকের মতানুযায়ী, দেশের মানুষের কথাবার্তায় বহু ইংরাজি শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে তাই ভাষা সংকর হয়ে গেছে। 'সংকর' শব্দের অর্থ মিশ্রিত।

প্রশ্ন: পশ্চিম ইউরোপের ভাষাগুলিকে প্রথম চৌধুরি ক'ভাগে ভাগ করেছেন?

উত্তর: ভাষাগুলিকে তিনি দুভাগে ভাগ করেছেন। (১) রোমান (২) জার্মান ভাষা।

প্রশ্ন: 'বিলেতি' শব্দের অর্থ কী? প্রাবন্ধিক কোন অর্থে ব্যবহার করেছেন?

উত্তর: 'বিলেতি' শব্দের অর্থ বিদেশী। প্রাবন্ধিক 'ইউরোপীয়' অর্থে ব্যবহার করেছেন।

প্রশ্ন: ভারতচন্দ্রের সময়ে বাংলায় বসবাসকারী বিলেতি জাতিগুলির উল্লেখ কর।

উত্তর: বিলেতি জাতিগুলি-(১) ফিরিঙ্গি, (২) ফরাসি, (৩) আলেমান, (৪) ওলন্দাজ, (৫) দিনেমার, (৬) ইংরেজ।

প্রশ্ন : প্রমথ চৌধুরীর মতানুযায়ী ছয়টি বিলেতি জাতির ভাষা কি কি ছিল? 

উত্তর: (১) ফরাসি -French (২) ফিরিঙ্গি -পোর্তুগিজ (৩)আলেমান -German (৪) ওলন্দাজ -Dutch (৫)

দিনেমার -Dane (৬) ইংরেজ -English |

প্রশ্ন: ভারতচন্দ্রের কালে বিলেতি ছয়টি জাতির আড্ডা কোথায় ছিল?

উত্তর : পোতুর্গিজদের আড্ডা-হুগলি। ওলন্দাজদের আড্ডা-চুঁচুড়া। দিনেমারদের- শ্রীরামপুর। ইংরেজদের আড্ডা-কলকাতা। আলেমানদের আড্ডা-আসমানে অর্থাৎ সর্বত্র।

প্রশ্ন: কোন্ কোন্ জাতি রোমান ভাষা ব্যবহার করত বলে প্রমথ চৌধুরি মনে করেন?

উত্তর: ফিরিঙ্গি অর্থাৎ পোর্তুগিজ আর ফরাসি জাতি রোমান ভাষা ব্যবহার করত বলে প্রথম চৌধুরি উল্লেখ করেছেন।

প্রশ্ন: প্রমথ চৌধুরীর মতে, কোন জাতি জার্মান ভাষা ব্যবহার করত বলে বলেছেন?

উত্তর : আলেমান, ওলন্দাজ, দিনেমার ও ইংরেজ জাতি জার্মানিক ভাষা ব্যবহার করত বলে প্রমথ চৌধুরী উল্লেখ করেছেন।

প্রশ্ন: “সে ফর্দ ছিল দশ পাতা লম্বা"-ফর্দটি কিসের ফর্দ ছিল?

উত্তর: বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ পত্রিকায় বাংলার অঙ্গীভূত পোর্তুগিজ শব্দাবলীর একটি ফর্দ ছিল দশ পাতা লম্বা।

প্রশ্ন: “বাংলা ভাষার চিরকেলে বদ-অভ্যাস”-বদ অভ্যাসটি কী?

উত্তর: বাংলা ভাষার চিরকেলে বদ-অভ্যাস পরের ধনে পোদ্দারি করা।

প্রশ্ন: “বাংলা তো তার স্বধর্ম পালন করে চলেছে"-স্বধর্মর স্বরূপ ব্যাখ্যা কর। উত্তর: বাংলা 'স্বধর্ম' বলতে এখানে অন্য ভাষার শব্দকে উদরস্থ ও আত্মস্থ করার স্বভাবটিকে বোঝানো হয়েছে।

প্রশ্ন: প্রমথ চৌধুরির মতে, বাংলা ভাষা মুসলমান ও পোর্তুগিজদের থেকে কি গ্রহণ করেছিল?

উত্তর: সেকালে বাংলা ভাষা মুসলমানদের কাছ থেকে কর্মের ভাষা নিয়েছিল, পোর্তুগীজ ও ফরাসিদের কাছ থেকে নিয়েছিল দ্রব্যর নাম। আজ আমরা ইংরাজি থেকে দুই প্রকার কথাই গ্রহণ করছি। উপরন্তু জ্ঞানের ভাষাও আত্মসাৎ করছি।

প্রশ্ন: "বোতল-গেলাস বাংলা ভাষা থেকে কখনও বেরিয়ে যাবে না"-কারণ উল্লেখ কর।

উত্তর: সুরাপান অথবা মদ্যপান সূত্রে বাংলা ভাষায় বোতল গ্লাস শব্দদ্বয় প্রবিষ্ট হয়েছিল বলে প্রমথ চৌধুরির অভিমত। বাঙালি আর মদ্যপান না করলেও ঔষধি সেবন করবে, কেশ তৈল ব্যবহার করবে। আর তারই অনুসঙ্গ হিসাবে বোতল গ্লাস শব্দদ্বয় টিকে থাকবে।

প্রশ্ন: বাংলা ভাষার যবন দোষ ঘোচানো অসম্ভব কেন?

উত্তর : বাঙালীর মৌখিক ভাষায় যেসব যবন শব্দ স্বাভাবিক হয়ে গেছে তাকে লেখার ভাষায় মেনে না নিলে সে ভাষা হয় প্রাণহীন, দুর্বল। এজন্যই বাংলা ভাষার যবন দোষ ঘোচাতে গেলে ভাষারই ক্ষতি করা হবে।

প্রশ্ন: “এ পত্রের যবনিকা পতনের পূর্বে আর একটি কথা বলব"-পত্রটি কী? কথাটি কী?

উত্তর: 'পত্র' বলতে এখানে 'আমাদের ভাষা সঙ্কট' প্রবন্ধটিকেই বলা হয়েছে। কথাটি হল, বাংলা ভাষা বাঙালির ভাষা নয়। বংশে বাঙালি হচ্ছে মঙ্গল দ্রাবিড় এবং তার ভাষা হচ্ছে সংস্কৃতের প্রপৌত্রী।

প্রশ্ন: “বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিষয় নবানি গৃহ্নাবতি নরোহপরানি"-কথাটির প্রসঙ্গ নির্দেশ কর।

উত্তর : কথাটির অর্থ-মানুষ জীর্ণ বস্ত্র পরিহার করে নববস্ত্র গ্রহণ করে। এখানে, বাংলার আদিম অধিবাসীরা স্বভাষা ত্যাগ করে মাগধী প্রাকৃত গ্রহণ করেছিল-তার কথাই বলা হয়েছে।

প্রশ্ন: "সেই দিন থেকে এদেশের লোকের মনেরও পুনর্জন্ম হয়েছে"-তাৎপর্য কী?

উত্তর : বাংলার আদিম মানুষেরা যেদিন স্বভাষা ত্যাগ করে মাগধী প্রাকৃত গ্রহণ করে সেই দিন থেকেই তাদের মনের পুনর্জন্ম হয়েছে বলা হয়।

প্রশ্ন: প্রমথ চৌধুরীর মতে, বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায় ফেরা কেন অসম্ভব?

উত্তর : প্রমথ চৌধুরীর মতে, বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায় ফেরা অসম্ভব কারণ আমরা যদি এখন বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায় ফিরে যেতে চাই, তাহলে আমাদের ফিরতে হবে আদি দ্রাবিড় + আদি মঙ্গল ভাষায়, কিন্তু সে ভাষাও হবে সংকর।

✍️প্রশ্নমান-৫:

১. 'আমাদের ভাষা সংকট' প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী আমাদের ভাষা সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার যে উপায় নির্দেশ করেছেন তা সংক্ষেপে লেখ। প্রবন্ধটির প্রকাশকাল লেখ।

উত্তর: উন্নত নাগরিক রুচি অসাধারণ বাবৈদগ্ধ ও তীক্ষ্ণ মননশীলতার অধিকারী প্রমথ চৌধুরী কাব্য, প্রবন্ধ ও ছোটোগল্প সর্বক্ষেত্রেই তাঁর স্বকীয় বৈশিষ্ঠের উজ্জ্বল পরিচয় রেখে গিয়েছেন। তিনি ছিলেন যৌবনধর্মের অগ্রদূত-যা স্থবির জরাজীর্ণতাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে নবীনত্বের জয়গান করতে চেয়েছেন। তিনি করুণ আবেগে আর্দ্র বাংলাদেশের জলীয় পরিবেশের সতেজ মনের ভাবনাকে প্রকাশ করেছেন। ফরাসি সুলভ মন ও মেজাজের অধিকারী ছিলেন তিনি। তাই প্রমথ চৌধুরী লক্ষ্য করেছেন যে বাংলা ভাষার মধ্যে বহু বিদেশি ভাষার সংমিশ্রণ আছে। সেই কারণেই নির্ভেজাল বাংলা ভাষায় কথা বলা বা সাহিত্য রচনা করা এখন আর সম্ভব নয়। কেননা সারা দেশের লোকের ভাষা সংকর হয়ে গেছে। এমন কি রাজমিস্ত্রি, ছুতোরমিস্ত্রি প্রমুখেরা যে যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজকর্ম করেন, তার বেশির ভাগ নামই বিদেশি। আসলে 'মিস্ত্রি' শব্দটাই তো বিদেশি।

বাংলা ভাষার মধ্যে আরবি, ফরাসি, ওলন্দাজ, পোর্তুগীজ প্রভৃতি জাতির ভাষা অনুপ্রবিষ্ট হয়ে গিয়েছে। কারণ আমাদের দেশে বহুকাল ধরে মুসলমানী শাসন প্রচলিত ছিল। তাই তো প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরী বলেছেন-"আমরা হচ্ছি কৃষিজীবীজাত, অথচ 'জমি' থেকে 'ফসল' পর্যন্ত কৃষিসংক্রান্ত প্রায় সকল কথাই হয় ফরাসি আর আরবি। আর জমিদারী সংক্রান্ত সকল কথাই ঐ আরবি-ফরাসির দান।" দৃষ্টান্ত হিসাবে আমরা দেওয়ান, ইজারাদার, পত্তনিদার, কানুগগো প্রভৃতির কথা উল্লেখ করতে পারি। আমাদের কর্মজীবনে প্রায় প্রতিদিনই আইন, আদালত, আরজি, রায়, ফয়সালা, জারি প্রভৃতি শব্দের মুখোমুখি হতে হয়। এই কারণেই প্রাবন্ধিক রসিকতার সুরে জানিয়েছে "পরের ধনে পোদ্দারি করা হচ্ছে যখন বাংলা ভাষার চিরকেলের বদ অভ্যাস, তখন এ যুগে যে তা অসংখ্য ইংরেজি শব্দ শুধু মুখস্থ নয় উদরস্থও করবে সে তো ধরা কথা।" আসলে বাংলা ভাষা চিরকাল পরের ভাষাকে আপন করে নিতে চেয়েছে।

তাই প্রাবন্ধিকের অভিমত বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলা ও সাহিত্য রচনা করা কখনও সম্ভবপর নয়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিত লেখকগণ এই চেষ্টা করলেও তা ফলপ্রসু হয়নি। "আলালের ঘরের দুলাল" ও 'হুতোম পেঁচার নক্সা" চলিত বাংলা গদ্যে লেখা হলেও সেখানেও প্রচুর বিদেশি শব্দ চোখে পড়ে। প্রবন্ধের শেষে প্রাবন্ধিক যখন বলেন-"বাংলা ভাষা বাঙালির ভাষা নয়" তখন আমরা চমকে উঠি। কেননা বাঙালি বলতে মোঙ্গল এবং দ্রাবিড় গোষ্ঠীর মধ্যেকার মানুষদের বোঝায়। তাই প্রাবন্ধিকের অভিমত যদি বিশুদ্ধ বাংলা ভাষাকে ফিরে পেতে চাই তাহলে আমাদেরকে আদি দ্রাবিড় এবং আদি মোঙ্গল ভাষাতে ফিরে যেতে হবে। কেননা বাঙালি জাতির মন এবং ভাষা সংকর। তাই বাংলা ভাষার এই মিশ্রণের জন্য দুঃখ বা অনুশোচনা করে লাভ নেই। কেননা বাইরের জিনিসকে আত্মিকরণ করে নেওয়া প্রাণের ধর্ম। তাই সংমিশ্রিত বাংলাকে বর্জন না করে গ্রহণ করে নেওয়াই শ্রেয় বলেই প্রাবন্ধিক মনে করেন।

"আমাদের ভাষা সংকট" প্রবন্ধটি ২৪শে জুন ১৯২২ খ্রিঃ প্রকাশিত হয়।

২. বিদেশি শব্দকে স্বদেশি করা হচ্ছে আমাদের ভাষার চিরকালের ধর্ম। বাংলা ভাষা কিভাবে বিদেশি শব্দকে গ্রহণ করেছে তার বিবরণ দাও। নবাবী আমলের কবি বলতে কার কথা বলা হয়েছে?

উত্তরঃ "মোদের গরব মোদের আশা, আমরি বাংলা ভাষা"-আমাদের এই বাংলা ভাষার সংকট সম্পর্কে লেখক প্রমথ চৌধুরী 'আমাদের ভাষা সংকট' প্রবন্ধে সে কথাই বলেছেন। তিনি আরও বলেছেন আমাদের বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডারে ইউরোপীয় ভাষা অবাধে ঢুকছে। মধ্যযুগ থেকে এই কাজ শুরু হয়েছে। যেমন নবাবী আমলের যে ছয়টি জাতিকে ভারতচন্দ্র জানতেন তাদের মধ্যে পোর্তুগিজ, ফরাসি, রোমানীয়, ওলন্দাজ, ইংরাজী, আলেমান (জার্মানী) প্রভৃতি ভাষা থেকে বহু শব্দ আমাদের ভাষার মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে। এই মধ্যযুগে আমাদের দেশে প্রধান জীবিকা ছিল কৃষি। তাই কৃষিসংক্রান্ত বহু শব্দ যেমন-জমি, ফসল প্রভৃতি আরবি শব্দ। জমিদারী এবং আদালত সংক্রান্ত সব কথা আরবি ও ফরাসি থেকে এসেছে।

ভাষাচার্য ড. সুকুমার সেনের মতে-"পোর্তুগীজরা অনেক জিনিস বাঙ্গালায় আনিয়াছিল। সেগুলির পোর্তুগীজ নামও বাঙ্গালায় চলিয়া গিয়াছে। এমন শব্দের সংখ্যা শতাধিক।" এ প্রসঙ্গে প্রমথ চৌধুরী বলেছেন-"বহুকাল পূর্বে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় বাংলার অঙ্গীভূত পোর্তুগীজ শব্দাবলীর একটি ফর্দ দেখে আমার চক্ষু স্থির হয়ে যায়, কেননা সে ফর্দ ছিল দশ পাতা লম্বা।" এ থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায় বাংলা ভাষায় পোর্তুগীজ শব্দের অনুপ্রবেশ কতখানি ব্যাপকভাবে ঘটেছে। এমনকি আমাদের ভাষায় ওলন্দাজ শব্দের ব্যবহারও লক্ষ্য করা যায়। যেমন-'রুইতন', 'হরতন' প্রভৃতি শব্দ। এরপর প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরী ইংরাজী শব্দের নানান শব্দ ব্যবহারের প্রতি বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ইংরেজরা যখন এদেশে এলো তখন বহু ইংরাজী শব্দ বাংলা ভাষায় আত্মসাৎ করেছে। নানা যন্ত্রের নাম, প্রতিদিন ব্যবহৃত জিনিস যেমন-গেলাস, বোতল, চেয়ার প্রভৃতি শব্দ ইংরাজী তৎসম শব্দরূপে না হোক তদ্ভব রূপে চিরকাল বজায় থাকবে। কোনো বাঙালিই এই ইংরাজী শব্দগুলিকে দূর করতে পারবেন না। কর্মজীবনে ভাষার সঙ্গে ইংরাজীর যেমন যোগ রয়েছে তেমনি জ্ঞানের ভাষাতেও আছে তার প্রভাব। যেমন-'Idea' শব্দটিই ইংরাজী। কাজেই, "দিবে আর নিবে মিলিবে মেলাবে"-বাংলাদেশের ভাষার এটাই ধর্ম। তাই বিদেশি ভাষাকে স্বদেশি করার প্রবণতা বা ইচ্ছা আমাদের ভাষার চিরকালের ধর্ম। তাই প্রাবন্ধিকের মন্তব্য-যদি অতীতে বিদেশি শব্দ গ্রহণে আপত্তি না থাকে, তাহলে বর্তমানে ইংরাজী শব্দ গ্রহণে আপত্তি কেন। বস্তুত ইংরাজী শব্দ গ্রহণ করে বাংলা ভাষা তো তার স্বধর্ম পালন করে চলেছে এ কথাই প্রাবন্ধিক তাঁর প্রবন্ধে বলেছেন।

নবাবী আমলের কবি বলতে কবি ভারতচন্দ্রের কথা বলা হয়েছে।

৩. “বাংলার মতো মিশ্রভাষা এক উর্দু বাদ দিলে ভারতবর্ষে বোধ হয় আর দ্বিতীয় নেই"-এই অভিমত স্থাপনে প্রাবন্ধিক কী কী উদাহরণ দিয়েছেন? 'বাংলার ভাষা সংকর'-এটি কার আবিষ্কার বলে তিনি উল্লেখ করেছেন?

উত্তর: মুসলমান যুগে বাংলা ভাষার শরীরে অনেক ফরাসি ও আরবি শব্দ আশ্রয় করেছিল। প্রমথ চৌধুরির কথায়, বাঙালি কৃষিজীবী জাত, অথচ 'জমি' বা 'ফসল' অর্থাৎ কৃষি সংক্রান্ত প্রায় সকল কথাই হয় ফারসি নতুবা আরবি। জমিদারি সংক্রান্ত সমস্ত কথাবার্তাই ওই আরবি-ফারসির দান, সংস্কৃতের বিন্দুমাত্র গন্ধ নেই। বাঙালিদের কর্মজীবনের যা স্তম্ভ অর্থাৎ দেশের মাটি, তার নামও 'জমি'। তাই একথা সর্বৈব সত্য কৃষি সংক্রান্ত শব্দ গৃহীত হয়েছে আরবি-ফারসি থেকে।

আইন-আদালত সংক্রান্ত সমস্ত ভাষা প্রায় আরবি-ফারসি। 'আরজি' থেকে 'রায়' বা 'ফয়সালা' পর্যন্ত মামলার আদ্যোপান্ত সব কথাই বাংলা ভাষাকে মুসলমানের দান। পরাধীন ভারতবর্ষে ইংরেজরা যে ডিক্রি দেন সেই 'ডিক্রি' শব্দটি ফরাসি শব্দ, বলা। যায় ফরাসি শব্দ কোথায় যেন হারিয়ে দিয়েছে ইংরেজকে। আরবি-ফারসির পরিব্যপ্ত সফরে বাংলা ও ইংরাজিকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে। প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরীর তাই অভিমত, বাংলার মতো মিশ্রভাষা এক উর্দু বাদ দিলে দ্বিতীয় আর নেই।

'বাংলা ভাষা সংকর' এটি শ্রীযুক্ত বারীন্দ্রকুমার ঘোষ মহাশয়ের আবিষ্কার বলে 'আমাদের ভাষা সংকট' প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরীর অভিমত।

৪. "ফলে বাঙালির মুখে যা ছিল active, বাঙালির লেখায় তা passive হয়ে পড়ল"-কোন্ প্রসঙ্গে একথা বলা হয়েছে? পশ্চিম ইউরোপের ভাষাগুলিকে কটি ও কী কী ভাগে ভাগ করা হয়েছে?

উত্তর : বাংলার মতো বর্ণসংকর ভাষাকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতরা পুনরায় আর্যভাষায় পরিণত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাদের এই চরম প্রচেষ্টার ফল হল বিপরীত। তাঁদের ওই তিরস্করণী বুদ্ধির প্রতাপে বাংলা ভাষা থেকে শুধু যে আরবি-ফারসি বিতাড়িত হল তা নয়, তার সঙ্গে বহু তদ্ভব শব্দকেও তাড়িয়ে দেওয়া হল। বাংলা সাহিত্যে 'বিবাহ', 'প্রণয়' এসব সাধুভাষা প্রবেশ করল, বাংলা ভাষার গেল খোল নোলচে বদলে। 'দ্বারা', 'সহিত', 'কর্তৃক', 'পরন্তু', 'অপিচ যদ্যপিসাৎ'-প্রভৃতির সাহায্য ছাড়া উক্ত সাধুভাষায় পদ এবং বাক্য গঠিত হতে পারল না। তাই বাঙালির মুখে যা ছিল active, লেখার_গুণে তা হয়ে গেল passive। তবে বাংলা ভাষার উপর এই আর্যপ্রভাব খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তার প্রমাণ, বাংলা সাহিত্যের গগনে যে দুই পতাকা উড়ল তা হল প্যারীচাঁদ মিত্রের 'আলালের ঘরের দুলাল' ও কালীপ্রসন্ন সিংহের 'হুতোম প্যাঁচার নক্সা'। বাংলা সাহিত্যে ঘটে গেল যুগান্তর।

পশ্চিম ইউরোপের ভাষাগুলিকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যেমন: (১) Roman Language, (২) Germanic Language |

✍️প্রশ্নমান-১০:

১. প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধে লেখক ইংরাজী ভাষার অনুপ্রবেশকে সমর্থন করেছেন কিভাবে? তিনি আমাদের ভাষা সংকট কিভাবে কাটিয়ে উঠতে হবে তা তাঁর নির্দেশিকা জ্ঞাপন করেছেন-আলোচনা কর।

উত্তর : আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রমথ চৌধুরী একজন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্করূপে বিরাজমান। উন্নত নাগরিক রুচি, অসাধারণ বাগবৈদগ্ধ ও তীক্ষ্ণ মননশীলতার অধিকারী প্রমথ চৌধুরী কাব্য, প্রবন্ধ ও ছোটোগল্প সর্বক্ষেত্রেই তাঁর স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের উজ্জ্বল পরিচয় রেখে গিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের জোলো পরিবেশে ফরাসি সুলভ বুদ্ধির দীপ্তি বিকীর্ণ করতে চেয়েছিলেন। 'আমাদের ভাষাসংকট' প্রবন্ধে আমরা তাঁর পরিহাসদীপ্ত মনের পরিচয় খুঁজে পাই। এই প্রবন্ধটিতে তিনি বাংলা ভাষার মাধ্যমে ইংরাজী শব্দের প্রবেশকে স্বাগত জানিয়েছেন দ্বিধাহীনভাবে। তাই উচ্চশিক্ষিত ও ইংরাজী শিক্ষিত মানুষের কথোপকথনের দিকে কান পাতলেই বহু ইংরাজী শব্দের ব্যবহার চোখে পড়বে। এমনকি স্বল্প শিক্ষিত বাঙালিদের কথার মধ্যেও প্রচুর ইংরাজী শব্দের প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়।

বাংলা ভাষা একটি মিশ্রভাষা। তার কারণ বাংলা মৌখিক ভাষার বিশেষ্য, বিশেষণ বেশির ভাগই ইংরাজী, ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম পদের ক্ষেত্রে বাংলার স্পর্শ লক্ষ্য করা যায়। এই কারণেই প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরী বলেছেন-“রাজমিস্ত্রি-ছুতোর মিস্ত্রিদের অধিকাংশ যন্ত্রপাতির নামের যে বিলেতে জন্ম তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই; কেননা মিস্ত্রি কথাটাই বিলেতি।” সুতরাং ইংরাজী শব্দগুলি বাংলা শব্দভাণ্ডারে তদ্ভব আকারে অনুপ্রবেশ ঘটেছে।

ফরাসি, পোর্তুগীজ, ওলন্দাজ, আলেমান, দিনেমার প্রভৃতি ভাষাগোষ্ঠীর মানুষদের কাছ থেকে বাঙালিরা নিয়ে এসেছিল কেবল কর্মের ভাষা ও বিভিন্ন জিনিসপত্রাদির নাম। কিন্তু ইংরাজী ভাষা গোষ্ঠীর মানুষদের কাছ থেকে আমরা এই দুটি বিষয় ছাড়াও অতিরিক্ত আরও একটা জিনিস আত্মসাৎ করেছি, তা হল জ্ঞানের ভাষা। অর্থাৎ বাংলা সাহিত্যের নবাব পরীক্ষা-নিরীক্ষার অনুপ্রেরণা হল ইংরাজী সাহিত্য। তাই প্রাবন্ধিক বলেছেন-"এ যুগে ইংরেজরা আমাদের অনেক জিনিস দিয়েছে, যা আমাদের ভাষার স্বনামেও আমাদের ঘরে স্বরূপে আছে ও থেকেও যাবে।" এমন কি পাশ্চাত্য রীতিসম্মত পঞ্চাঙ্ক নাটক, সাহিত্যিক মহাকাব্য, চতুর্দশপদী কবিতাবলী, পত্রকাব্য, অমিত্রাক্ষর ছন্দ-যা আমাদের সাহিত্যে আনয়ন করেছিলেন মধুসূদন দত্ত। কিন্তু এ সবের প্রকৃত উৎসভূমি হল ইউরোপ। এমন কি উপন্যাস, গীতিকবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, রম্যরচনা বাঙালি বুদ্ধিজীবী মানুষেরা এসব কিছুর প্রথম সন্ধান পেয়েছিলেন পাশ্চাত্য সাহিত্য থেকেই। সেইজন্য বোধহয় দেশ-ভাষার ঐতিহ্য-সচেতন প্রাবন্ধিক ভারতচন্দ্রের নবাবী আমলে প্রবেশ করে রাজসভার কবি-কথিত সমকালীন বাংলাদেশের বসবাসকারী ছয়টি বিদেশি জাতির উল্লেখ করে তাদের কথ্য ভাষার শ্রেণী পরিচয় দান করেছেন। তাই লেখকের অভিমত-"...বিদেশী শব্দকে স্বাদেশিক করা হচ্ছে আমাদের ভাষার চিরকালের স্বভাব।"

তাই প্রবান্ধিক মনে করেন ইংরাজদের উপর ২০০ বছরের ক্ষোভ নিয়ে যদি কেউ ইংরাজী ভাষার অনুপ্রবেশকে রোধ করতে চান তাহলে আমাদের ভাষার শক্তিশালী ইমারত অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়বে। আমাদের শব্দভাণ্ডার থেকে বহু যুৎসই শব্দ বেরিয়ে যাবে, ফলে বাংলা ভাষা অনেকাংশেই নিষ্প্রভ হয়ে যাবে এতে সন্দেহ নেই। তাই প্রসঙ্গত প্রাবন্ধিকের যুক্তিসম্মত একটি মতামত এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য বলে মনে করি-“এ যুগে ইংরেজেরা আমাদের অনেক জিনিস দিয়েছে, যা আমাদের ভাষার স্বনাম ও আমাদের ঘরে স্বরূপে আছে ও থেকেও যাবে। একটা সর্বলোকবিদিত উদাহরণ দেওয়া যাক। বোতল গেলাস বাংলা ভাষা থেকে কখনও বেরিয়ে যাবে না, কেননা ও দুই চিজও বাংলাদেশ থেকেও কখনো বেরিয়ে যাবে না।” সুতরাং ইংরাজী জ্ঞানের ভাষা যদি কিছু পরিমাণে বাংলা ভাষার অন্তরঙ্গ হয়ে থাকে তাহলে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই। যেহেতু দেশের জনগণ ইংরাজী ভাষায় শিক্ষিত নয়, সেজন্য এইসব ইংরাজী শব্দ স্বল্পসংখ্যক লোকের মুখেই শোনা যায়। তাই লেখকের অভিমত- "ইংরেজি শিক্ষার প্রসাদে অনেক নূতন জ্ঞান, অনেক নূতন ভাব আমাদের মনের ভিতর ঢুকে গিয়েছে, তাই তাদের বিলেতি নামও আমাদের মুখে মুখে চলেছে। যেহেতু দেশের জনগণ ইংরেজি-শিক্ষিত নয়, সে কারণ ঐ সব ইংরেজি কথা স্বল্পসংখ্যক লোকের মুখে শোনা যায়, আর তাদের বিদেশি ধ্বনি আমাদের কানে সহজেই ধরা পড়ে।"

এমন কি ফোর্ট উইলিয়ামী-গদ্য সংস্কৃত ও সংস্কৃত ঘেষা তৎসম শব্দ বহুল দীর্ঘ সন্ধি-সমাস বহুল জটিল বাক্যের আড়ম্বরে বাংলা ভাষার আর্যীকরণ ঘটাতে চেয়েছিল। এই উদ্দেশ্যে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখকেরা বাংলা ভাষার কায়া থেকে আরবি-ফার্সী সহ অসংখ্য তদ্ভব কথাকেও হটিয়ে দিল। তবে ফোর্ট উইলিয়ামী গদ্যে 'ফারসি-আরবির স্পর্শমাত্র নেই'- প্রমথ চৌধুরীর এই মন্তব্য সবটা ঠিক নয়। রামরাম বসুর 'রাজাপ্রতাপাদিত্য চরিত্র' গ্রন্থে আরবি ও ফারসি শব্দের রীতিমত প্রাচুর্য চোখে পড়ে। তবে শেষ পর্যন্ত প্রবন্ধের মূল লাইনেই উপনীত হয়ে প্রমথ চৌধুরী প্রবন্ধ-সূচনায় সিদ্ধান্তের প্রমাণে অবগত করেছেন, "বাংলা ভাষা বাঙালির ভাষা নয়'-এর রীতি সংকর। আদিতে বাঙালি জাতি মঙ্গল-দ্রাবিড়ের সংমিশ্রণে তৈরি। তাই তারও ভাষা এই সূত্রে মাগধী প্রাকৃত অর্থাৎ মিশ্র রীতির। তাই সম্প্রতিকালে আমরা কেউ যদি বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায় ফিরে যেতে চাই তাহলে পুনরায় আদি দ্রাবিড় বা আদি মঙ্গল গোষ্ঠীর ভাষাতে ফিরে যেতে হবে।

প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরী 'আমাদের ভাষা সংকট' কাটিয়ে উঠার উপায় হিসাবে বলেছেন, বাংলা ভাষার মধ্যে বহু বিদেশি ভাষার সংমিশ্রণ আছে। নির্ভেজাল বাংলা ভাষার কথা বা সাহিত্য রচনা করা এখন আর সম্ভব নয়। কেন না দেশশুদ্ধ লোকের 'ভাষা সংকর হয়ে গেছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শাসক দল অনুপ্রবেশ করেছে এবং তাদের ভাষা আমাদের ভাষার সাথে সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে। তাই বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায় ফিরে যেতে হবে-যেটা সম্ভব নয়। বাঙালি জাতির মনে ও ভাষাতে সংমিশ্রণ ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে লেখকের উক্তি-“বাঙালি জাতি আমাদের সৃষ্টি করেছে, আমরা বাঙালি জাতিকে সৃষ্টি করিনি।” বাংলা ভাষার এই সংমিশ্রণের জন্য দুঃখ বা অনুশোচনা করে লাভ নেই। কেন না বাইরের জিনিসকে আত্মিকরণ করে নেওয়া প্রাণের ধর্ম। আমাদের বাংলা ভাষাও বহু বিদেশি ভাষার সমন্বয়ে একটি বলিষ্ঠ ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে। তাই বাংলা ভাষা সম্পর্কে আমাদের যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তা কাটিয়ে উঠতে হবে।

                                ...............