📚বি.এ মেজর বাংলা: অতিথি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:প্রশ্নোত্তর: প্রশ্নের মান-২,৫,১০📚

✍️প্রশ্নমান-২:

প্রশ্ন: 'অতিথি' গল্পটি কোন্ পত্রিকার কোন্ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়?

উত্তর : 'অতিথি' গল্পটি 'সাধনা' পত্রিকার ভাদ্র-কার্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।

প্রশ্ন: 'অতিথি' গল্পে ক'টি পরিচ্ছেদ? কোন্ পরিচ্ছেদটি সবচেয়ে বড়ো?

উত্তর : 'অতিথি' গল্পের পরিচ্ছেদ মোট ৬ টি। প্রথম পরিচ্ছেদটি সবচেয়ে বড়ো।

প্রশ্ন: 'অতিথি' গল্পের সূচনা হয় কিভাবে?

উত্তর : 'অতিথি' গল্পের সূচনা হয় জমিদার মতিলালবাবুর সঙ্গে গল্পের নায়ক তারাপদর সাক্ষাৎ ও আলাপের ঘটনা দিয়ে।

প্রশ্ন: মতিলাল বাবুর পরিবারের সঙ্গে আলাপ হবার সময় তারাপদর বয়স কত ছিল?

উত্তর: মতিলালবাবুর সঙ্গে আলাপের সময় তারাপদর বয়স ছিল পনেরো-ষোল।

প্রশ্ন: কোন্ কাজের মধ্য দিয়ে তারাপদ মতিলালবাবুর পরিবারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়?

উত্তর: রান্নার সময় নিখুত ভাবে মাছ কুটে দিয়ে, রান্নায় সহায়তা করার মধ্যে দিয়ে তারাপদ মতিলালবাবুর পরিবারের সদস্য হয়ে ওঠে।

প্রশ্ন: মতিলালবাবুর স্ত্রী ও কন্যার নাম কী? তারাপদর প্রতি তাদের মনোভাব কেমন ছিল?

 উত্তর: মতিলালবাবুর স্ত্রীর নাম অন্নপূর্ণা, কন্যার নাম চারুলতা। অন্নপূর্ণা তারাপদর প্রতি স্নেহশীলা হয়ে ওঠেন। কিন্তু বাবা-মা'র স্নেহে ভাগ বসাচ্ছে ব'লে চারু তারাপদর প্রতি ঈর্ষান্বিতা হয়ে ওঠে।

প্রশ্ন: তারাপদর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সময় চারুর বয়স কত ছিল? 

উত্তর: তারাপদর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সময় চারুর বয়স ছিল ৯ বছর মাত্র।

প্রশ্ন: তারাপদর ভাই বোন ক'টি? সে কত নম্বর পুত্র?

উত্তর: তারাপদরা পাঁচ ভাই, তিন বোন। সে পুত্রদের মধ্যে চতুর্থ।

প্রশ্ন: তারাপদ কত বয়সে ঘর ছাড়ে? কেন? 

উত্তর: তারাপদ সাত-আট বছর বয়সে ঘর ছাড়ে। ঘরের বন্ধন তার ভালোলাগে না,সে মুক্তি পিপাসু। তাই ঘর ছেড়ে পথে বেরিয়ে পড়ে।

প্রশ্ন: ঘর ছেড়ে তারাপদ কাদের সঙ্গে কীভাবে কাটিয়েছে?

 উত্তর: ঘর ছেড়ে তারাপদ প্রথমে যাত্রাদলের গান গেয়েছে, তারপর পাঁচালীর দলে গান গেয়েছে। গানও শিখেছে কিছু। সেখান থেকে পালিয়ে যোগ দেয় জিমনাস্টিকের দলে। এই দলে সে বাঁশি বাজাত। এখান থেকে পালাবার পথেই মতিলালবাবুর সঙ্গে আলাপ পরিচয়।

প্রশ্ন: তারাপদ কোথায় যাবার জন্য মতিলালবাবুর নৌকায় চেপেছিল? সেখানে কী উদ্দেশ্যে যেতে চেয়েছিল?

উত্তর: তারাপদ নন্দীগ্রামে যেতে চেয়ে মতিলালবাবুর নৌকায় আশ্রয় নেয়। সেখানে যাত্রার নতুন দলে যোগ দেবার উদ্দেশ্যেই যেতে চেয়েছিল।

প্রশ্ন: রাতে তারাপদর কী খাওয়ার অভ্যাস ছিল?

উত্তর: রাতে তারাপদ যা পেত তাই খেত, না পেলে না খেয়ে থাকারও অভ্যাস ছিল।

প্রশ্ন: তারাপদ মতিলালবাবুদের নৌকায় ক'দিন ছিল? সেই ক'দিন তারাপদ কী কী কাজ করেছিল?

উত্তর: তারাপদ মতিলালবাবুদের নৌকায় দশদিন কাটায়। সেই ক'দিন সে বাজার করা, রান্না করা, নৌকা চালানোর কাজ ক'রে সকলকে সাহায্য করত।

প্রশ্ন: তারাপদর মতো ছেলেটাকে কাছে পেয়ে মতিলালবাবু ও অন্নপূর্ণার মনে কোন্ বাসনা জাগতে থাকে?

উত্তর: তারাপদকে কাছে পেয়ে মতিলালবাবু ও অন্নপূর্ণার মনে পুত্রবাৎসল্য জন্মায়। তাঁদের পুত্রসন্তান না থাকায় দুঃখ ছিল। সেই দুঃখ ভুলতে চেয়েছিলেন তারাপদকে আশ্রয় ক'রে।

প্রশ্ন: তারাপদকে চারু প্রথমে সহ্য করতে পারত না কেন?

উত্তর: তারাপদ চারুর স্নেহ ভালোবাসার সাম্রাজ্যে ভাগ বসাচ্ছিল ব'লে ঈর্ষায় চারু তারাপদকে সহ্য করতে পারত না।

প্রশ্ন: "এই মেয়েটি একটি দুর্ভেদ্য প্রহেলিকা।"-মেয়েটি কে? কেন তার সম্পর্কে এমন কথা বলা হয়েছে? 

উত্তর:👉 "এই মেয়েটি  হ'ল চারুলতা; মতিলালবাবুর একমাত্র কন্যা।

 👉সে বড্ড জেদী এবং চাপা স্বভাবের, তার মনের কথা বোঝা সহজসাধ্য ছিল না বলেই তার সম্পর্কে এমন কথা হয়েছে।

প্রশ্ন: তারাপদ নৌকায় চাপার কতদিন পরে মতিলালবাবুর গ্রামে পৌঁছায়? গ্রামের নাম কী?

 উত্তর: 👉নৌকায় চাপার দশ দিন পর মতিলালবাবুর গ্রামে পৌঁছায়। 

👉গ্রামের নাম কাঁঠালিয়া।

প্রশ্ন: কাঁঠালিয়া গ্রামে পৌঁছে তারাপদর প্রথম কাজটি কী হয়?

উত্তর: কাঁঠালিয়া গ্রামে পৌঁছে তারাপদর প্রথম কাজ হয় গ্রাম পর্যটন।

 প্রশ্ন: তারাপদ কীভাবে মতিলালবাবুর গ্রামের মানুষের আপনজন হয়ে ওঠে?

উত্তর: তারাপদ মতিলালবাবুর গ্রামে পৌঁছেই গ্রাম পর্যটনে বের হয় এবং গ্রামের মানুষকে পছন্দ মতো দাদা, দিদি, মাসি ইত্যাদি সম্বোধনে দু'ঘণ্টার মধ্যেই সবার আপনজন হয়ে ওঠে।

প্রশ্ন: কাঁঠালিয়া গ্রামে চারুর সমবয়সী সখী কে? তার সঙ্গে চারুর আড়ি হয় কেন?

উত্তর:👉 কাঁঠালিয়া গ্রামে চারুর সমবয়সি সখী হ'ল সোনামণি। 

👉চারু সোনামণির সঙ্গে তারাপদর পরিচয় করানোর আগেই তারাপদ সম্পর্কে সোনামণি অনেক তথ্য জেনে ফেলেছে, এমন কি, একটি বাঁশি উপহার পেয়েছে, তাই ঈর্ষায় সে সোনামণির সঙ্গে আড়ি দিয়েছে।

প্রশ্ন: তারাপদকে ইংরেজি শেখাবার জন্য মতিলালবাবু কাকে নিয়োগ করেন?

উত্তর: তারোপাদকে ইংরেজি শেখাবার জন্য মতিলালবাবু গ্রামের এনট্রেন্স স্কুলের হেডমাস্টার রামরতনবাবুকে নিয়োগ করেন। তিনি প্রতিদিন সন্ধ্যা বেলা তাকে ইংরেজি শেখাতে আসতেন।

প্রশ্ন: মতিলালবাবুর বাড়িতে কতদিন কাটাবার পর তারাপদর সঙ্গে চারুর বিবাহের কথা ভাবা হয়?

উত্তর: মতিলালবাবুর বাড়িতে তারাপদর দুই বছর কাটাবার পর চারুর সঙ্গে তার বিবাহের কথা ভাবা হয়।

প্রশ্ন: তারাপদর বিবাহের দিনস্থির হয় কোন্ মাসে? কেন?

উত্তর: বিবাহের দিন স্থির হয় শ্রাবণ মাসে। কারণ এই মাস থেকে নদীতে জল থাকে। জিনিসপত্র আনা, আত্মীয় স্বজন আনাগোনার জন্য নদীপথই বড় মানুষদের অবলম্বন তাই।

প্রশ্ন: তারাপদ কোথায় রথের মেলার খবর জানতে পারে? কীভাবে?

উত্তর:তারাপদ নদীর ধারে গিয়ে মেলার জিনিসপত্র নৌকা বোঝাই হয়ে নদী পথে যেতে দেখে এবং মানুষের কথা শুনে জানতে পারে, 'কুড়ুল কাটায়' নাগবাবুদের এলাকায় রথের মেলা বসবে।

প্রশ্ন: তারাপদর বিবাহ উপলক্ষে তার বাড়ি থেকে কে কে কাঁঠালিয়ায় আসে? কীভাবে?

উত্তর: তারাপদর মাতা ও ভ্রাতারা আসে, নৌকা যোগে।

✍️প্রশ্নমান-৫:

১. তারাপদর সঙ্গে মতিলালবাবুর পরিবারের প্রথম সাক্ষাৎ কোথায়? সে কীভাবে মতিলালবাবুর পরিবারের সদস্য হয়ে ওঠে? আলোচনা করো।

উত্তর : 👉তারাপদর সঙ্গে মতিলালবাবুর পরিবারের প্রথম সাক্ষাৎ হয় এক গঞ্জের ঘাটে। সেখানে মতিলালবাবু নৌকা লাগিয়ে ছিলেন রান্না-খাওয়া করবার অভিপ্রায়ে। তারাপদ সেখানে উপস্থিত হয়ে মতিলালবাবুর কাছে জানতে চায়, তারা কোথায় যাবে। কাঁঠালিয়া গ্রামে যাবে শুনে তারাপদ প্রার্থনা জানায়, তাকে যদি একটু নৌকায় ঠাঁই দেয় এবং নন্দীগ্রামে নামিয়ে দেয়। মতিলালবাবু সম্মত হওয়ায় খুশী হয়ে তারাপদ তাঁদের সঙ্গী হয়ে যায়।

👉তারাপদ অত্যন্ত মিশুকে ছেলে। তার উপর কর্মতৎপর। যেকোনো কাজ সে সহজে শিখে নেয় এবং করতেও উৎসাহিত হয়। তাই রান্নাবান্নার কাজে সে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই হাত লাগায়। তার অকপট, সহজ সরল আচরণ ও কর্মপ্রবৃত্তির জন্য নৌকার সকলেই তাকে ভালোবেসে ফেলে। আপন করে নেয়। সন্ধ্যাবেলা তার সুরেলা কণ্ঠের গান শুনেও সকলে মুগ্ধ হয়ে যায়। মতিলালবাবু এবং তাঁর পত্নী অন্নপূর্ণা তারাপদকে পুত্র স্নেহে কাছে টেনে নিলেন। তারাপদও তাঁদের আপনজন হয়ে উঠল। বাজার করা, রান্না-বান্নার জোগাড় করা, নৌকা চালানো-এসব কাজে তো সাহায্য করতই; সন্তানের মতো আচরণে, বাঁশি শুনিয়ে, গান শুনিয়েও সে পরিবারটির আপনজন হয়ে ওঠে। কখন নন্দীগ্রাম অতিক্রম ক'রে নৌকা কাঁঠালিয়ার দিকে এগিয়ে গিয়েছে, সে খোঁজ আর রাখেনি। পরিবারটির সঙ্গে নৌকায় দশদিন কাটিয়ে সে কাঁঠালিয়া গ্রামে পৌঁছালে এবং সঙ্গে থেকে গেলে কেউ অখুশি হয়নি। বরং পুত্রহীন মতিবাবু আর অন্নপূর্ণা তাকে পুত্রস্নেহেই আঁকড়ে ধরেছেন। তারাপদ হয়ে উঠেছে ঘরের ছেলে। কেবল মতিলালবাবুর একমাত্র কন্যা চারুলতা তার একচেটিয়া স্নেহ ভালোবাসার রাজ্যে ভাগীদার হয়ে ওঠায় তারাপদকে খুব ঈর্ষা করেছে। পরে অবশ্য তার মধ্যেও অনুরাগের জন্ম হয়েছে।

২. "ওমা, সে কী কথা! পাঁচটা আঙুল আছে বলে কি একটি আঙুল ত্যাগ করা যায়।"-কে, কাকে বলেছে? কোন সময়ে? বক্তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করো।

উত্তরঃ 👉"ওমা, সে কী কথা! পাঁচটা আঙুল আছে বলে কি....."-একথা মতিলালবাবুর স্ত্রী অন্নপূর্ণা বলেছেন তারাপদকে।

👉নৌকায় কাঁঠালিয়া ফেরার পথে, গঞ্জের ঘাটে এক সুন্দর, গৌরবর্ণের, হাসি খুশী ব্রাহ্মণ বালককে পেয়ে তার পরিচয় জানবার সময় একটি কথার প্রেক্ষিতে এই কথা বলেন।

অন্নপূর্ণা জমিদার গৃহিণী হ'লেও নিরহংকারী, কোমল হৃদয়া, স্নেহময়ী। তাঁর একটি মাত্র কন্যা সন্তান চারুলতা। কোনো পুত্র সন্তান নেই। বংশ রক্ষার কথা ভেবে তাঁর মনে একটু দুঃখতো ছিলই। তারাপদর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং আলাপ হবার পর অন্নপূর্ণার মনে পুত্রবাৎসল্য জেগে উঠেছে। ছেলেটার নানা গুণে মুগ্ধ হয়ে তাকে কাছে রাখবার জন্য আগ্রহী হন। প্রশ্ন করে জানতে পারেন, তারাপদর মা আছে, চারটে ভাই, তিনটে বোন আছে; মা-ভাই-বোনেরা তো বটেই, পাড়া প্রতিবেশীরাও তাকে ভালোবাসে। তবু সে কেন ঘর ছেড়ে আসে, এ প্রশ্নের জবাব তিনি পান না। তবু ছেলেটাকে আপন সন্তানের মতো বুকে আঁকড়ে ধরতে চান। "তাঁহার বড়ো ইচ্ছা, খাওয়াইয়া পরাইয়া এই গৃহচ্যুত পান্থ বালকটিকে পরিতৃপ্ত করিয়া দেন।" তাই চাকরদের পাঠিয়ে গ্রাম থেকে দুধ মিষ্টি আনালেন। তারাপদ বেশি খায় না। দুধতো খায়ই না। তাই, অন্নপূর্ণার তৃপ্তিও হয় না। তারাপদর মুখে কুশ লবের গান শুনে অভিভূত অন্নপূর্ণার মনে ইচ্ছা জাগে, “ছেলেটিকে কোলে বসাইয়া বক্ষে চাপিয়া তাহার মস্তক আঘ্রাণ করেন।" চারুর ঈর্ষার কথা মনে রেখে তিনি প্রকাশ্যে তারাপদকে, চারুর সামনে অন্তত স্নেহ করতেন না।

তারাপদর প্রতি স্নেহময়ী অন্নপূর্ণা এতটাই স্নেহময়ী হয়ে ওঠেন যে, মতিলালবাবু যখন চারুর বিবাহের জন্য পাত্র সন্ধান করছেন তখন প্রস্তাব দেন তারাপদর সঙ্গেই চারুর বিবাহ ঘটাতে। তাতে ছেলে-মেয়ে দুটোই কাছে থাকবে। অন্নপূর্ণার চরিত্রের মধ্যে দিয়ে লেখক যে চিরন্তন মাতৃ হৃদয়ের সার্থক ছবিটিই ফুটিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছেন, তা স্বীকার করতেই হবে।

৩. "সোনামণির দাদা! শুনিয়া সর্বশরীর জ্বলিয়া যায়।"-সোনামণি কে? কার সর্বশরীর জ্বলে যায়? কারণ কী? আলোচনা করো।

উত্তর:👉 সোনামণি হ'ল কাঁঠালিয়া গ্রামের জমিদার মতিলালবাবুর এক প্রতিবেশিনীর বিধবা কন্যা। সে জমিদার কন্যা চারুলতার সমবয়সী এবং সখী।

👉চারুলতারই সর্বশরীর জ্ব'লে যায় সোনামণির আদিখ্যেতা দেখে।

তারাপদকে আবিষ্কার ক'রে কাঁঠালিয়া গ্রামে নিয়ে এসেছে চারুর বাবা-মা। তাই, তারাপদ চারুদের সম্পত্তি। তারাপদকে চিনবে, জানবে, ব্যবহার করবে, এমন কি ভালোবাসবে, তিরস্কার করবে চারুরাই। তারাপদ যদি গর্বের বিষয় হয়, তবে তা চারুদেরই। তাই, চারুর সই সোনামণি ক'দিন পরে চারুর সঙ্গে দেখা করতে এলে চারু তাকে তারাপদর সম্পর্কে বলতে থাকে। তখন সোনামণি জানায়, তারাপদ দাদার সম্পর্কে সে জানে। এতেই ঈর্ষায় চারুলতার সর্বশরীর জ্বলে যায়।

তারাপদ কাঁঠালিয়া পৌঁছাবার পরই পুরো গ্রামটা ঘুরে নিয়েছে। যাদের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছে, তাদের দাদা, দিদি, মাসি প্রভৃতি সম্বোধন ক'রে আপন করে নিয়েছে। ক'দিনে সোনামণিদের বাড়িতেও সে কয়েকবার গিয়েছে। পরিচয় যথেষ্টই হয়ে গেছে। সোনামণি তাকে দাদা ব'লে সম্বোধনও করে থাকে!-এসব জেনে চারুলতার রাগ হয়। নতুন জিনিসটা দেখাবার আগেই যদি অন্য কেউ ব্যবহার করতে শুরু করে, তাহলে জিনিসটার মালিকের তো রাগ হ'তেই পারে। চারুলতা চেয়েছিল, তারাপদর সম্পকে সোনামণিকে একটু একটু করে জানাবে আর কৌতুক উপভোগ করবে। কিন্তু, তাও প্রথমেই বিপত্তি ঘটায় চারুলতা অসন্তুষ্ট হয়। তার সর্বশরীর জ্বলে যায়। 

৪.“তখন বালিকা লজ্জায় ক্রোধে ক্ষিপ্ত হইয়া ঘর হইতে দ্রুত বেগে ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল।"-বালিকাটি কে? কোন্ ঘর হ'তে সে বের হয়ে গেল? তার লজ্জা ও ক্রোধের কারণ আলোচনা করো।

উত্তর: 👉 বালিকাটি হ'ল জমিদার মতিলালবাবুর একমাত্র কন্যা চারুলতা। 

👉সে তারাপদর পড়ার ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

👉তারাপদ যখন তার কৌতূহল মেটাবার জন্য গ্রামের স্কুলের প্রধান শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে ইংরাজী পড়াশুনা শুরু করেছে, তখন জেদি এবং খেয়ালি চারুলতাও ইংরাজি পড়া শুরু করে। কিন্তু, চারুর পড়াশোনা শুধু পড়াশোনার জন্য ছিল না; তারাপদকে নজরে রাখা আর তাকে বিরক্ত করা ছিল তার উদেশ্য। তারাপদর মন দিয়ে লেখা বা পড়ামুখস্থ করা চারুর সহ্য হত না। তাই, খাতার উপর কালি ঢেলে, কলম লুকিয়ে রেখে বা বইয়ের পাতা ছিঁড়ে পড়ায় বিঘ্ন ঘটিয়ে সে তৃপ্তি পেত।

এই বিঘ্ন সৃষ্টির মাত্রা এমন জায়গায় পৌঁছল যে তারাপদ মসীলিপ্ত খাতাটা ছিঁড়ে ফেলে মৌন হয়ে বসে রইল। কারো সঙ্গে আর কথা বলতেও চাইল না। চারু মুশকিলে পড়ে গেল। তারাপদর মন ভাঙাবার জন্য সে খাতার একটা ছেঁড়া পাতায় লিখল, 'আমি আর কখনো খাতায় কালি মাখাব না।"-এবং সেদিকে তারপদর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করতে লাগল। তারাপদ তা দেখে হাসি আটকাতে পারে না। আর তার হাসি দেখে চারুলতা একই সঙ্গে লজ্জিত এবং ক্রুদ্ধ হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। লজ্জা এই জন্য যে, তারাপদর কাছে তার দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে গেছে। আর ক্রোধ এই জন্য যে, তারাপদ চারুলতার আচরণে হেসেছে। অর্থাৎ, তাচ্ছিল্য করেছে।

৫. "সে শোবার ঘরের দ্বার রুদ্ধ করিয়া রহিল। কিছুতেই বাহির হইল না।"-কার কথা বলা হয়েছ? সে কেন দ্বার রুদ্ধ ক'রে বসে ছিল। তার পরিণতি কী ঘটেছিল?

উত্তর: 👉"সে শোবার ঘরের দ্বার রুদ্ধ করিয়া রহিল"-এখানে চারুলতার কথা বলা হয়েছে।

👉চারুলতার বয়স এগারো অতিক্রম করায় মতিলালবাবুর পাত্রের সন্ধান করতে লেগেছেন। একদিন রায়ডাঙার বাবুদের বাড়ি থেকে মেয়ে দেখতে এল। চারুলতার কর্তব্য ছিল, সেজেগুজে তাদের সামনে গিয়ে বসা। কিন্তু চারু নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ ক'রে ব'সে রইল। মতিলালবাবুর অনুরোধ, উপদেশ, পরামর্শ, তিরস্কার কোনো কিছুতেই সে দরজা খুলল না। খেয়ালি এবং জেদি চারুলতা জেদের বসে যে সিদ্ধান্ত নেয়, তার নড়চড় হ'তে দেয় না। তাই বাধ্য হয়েই মতিলালবাবু পাত্রপক্ষকে মিথ্যা করে মেয়ের হঠাৎ অসুখের কথা ব'লে, আজ পাত্রী দেখানো যাবে না ব'লে বিদায় জানিয়ে দেন। মেয়ের হয়তো কোনো দোষ আছে, তাই বাবা মিথ্যা ব'লে পাত্র পক্ষকে ভাগাচ্ছে। মেয়ের এই জেদ দেখে তার বাবা-মা বুঝতে পারেন, বাইরের পাত্রের সঙ্গে বিবাহে চারুর ঘোরতর আপত্তি। তারাপদর সঙ্গে বিবাহেই তার আগ্রহ। তাই তাঁরা তারাপদর সঙ্গেই চারুলতার বিবাহের সিদ্ধান্ত পাকা করেন। তার কুলপরিচয় জানার ব্যাপারে, মা-ভাইদের মতামত নেবার ব্যাপারে তৎপর হয়ে ওঠেন। এসব করার সময় চারু কোনও আপত্তি করেনি। বরং মনে মনে সে খুশি হয়েছে।

কিন্তু চারুর দুর্ভাগ্য, তারাপদর সঙ্গে তার বিবাহ সম্পন্ন হয়নি। বিবাহের আয়োজন যখন প্রায় সম্পূর্ণ হয়েছে, তারাপদর মা-ভাইদেরও নৌকা যোগে আনানো হয়েছে, তখনই সংসার বন্ধন ভীরু তারাপদ কাউকে কিছু না বলে মতিলালবাবুর বাড়ি ছেড়ে চ'লে গেছে! চারুলতার স্বামী হিসেবে তারাপদকে পাওয়ার আশা ব্যর্থ হয়েছে।

৫. 'অতিথি' গল্পের কোন পরিচ্ছেদে নদীপ্রকৃতির পরিচয় দেওয়া হয়েছে? নিজের ভাষায় সেই পরিচয় উপস্থাপিত করো। 

উত্তর :👉 'অতিথি' গল্পের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে নদী প্রকৃতির পরিচয় দেওয়া হয়েছে।

👉কাঁঠালিয়া গ্রামের পাশ দিয়ে যে নদী প্রবাহিত হয়ে গেছে, তাতে গ্রীষ্মকালে জল থাকে না। মাঝে মাঝে ডোবার মতো আকার নেয়। নৌকা চলে না। ডোবাগুলোর কাদাজলে নৌকাগুলো ডুবে থাকে। নদীর মধ্যে দিয়ে গাড়ি চলে যায়। তার চাকার দাগ অঙ্কিত থাকে নদী বক্ষে। জৈষ্ঠ্য মাস পর্যন্ত এই অবস্থা থাকলেও আষাঢ় শ্রাবণে নদী ভ'রে ওঠে। কোথা থেকে জলধারা এসে নদীকে প্রাণবন্ত ক'রে তোলে। গ্রাম্য বালক-বালিকারা সানন্দে নদীর তীরে এসে নাচানাচি করে। জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীকে যেন আলিঙ্গন করে। শুষ্ক নির্জীব গ্রামের মধ্যে হঠাৎই যেন বিপুল প্রাণের হিল্লোল এসে প্রবেশ করে। ভরা নদীতে তখন নৌকা ভাসে। দেশ-বিদেশ থেকে ছোট বড়ো কত নৌকা মাল বোঝাই হয়ে আসে। আত্মীয় স্বজনেরাও নৌকা যোগে কুটুম্ব বাড়িতে খোঁজ নিতে আসে।

নৌকা যোগের সুযোগ বেড়ে যাওয়ায় এসময় কোনো কোনো গ্রামে রথের মেলা, অন্যান্য মেলার আয়োজন করা হয়। নৌকা বোঝাই হয়ে মেলায় বেচাকেনার সামগ্রী, নাগরদোলা, যাত্রাপালা ইত্যাদির সামগ্রী এসে উপস্থিত হয়। সেই সব নৌকার যাত্রীদের, দাঁড়ি-মাল্লাদের চেঁচামেচি, গান-বাজনার দাপটে নদীবক্ষ যেন প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। মানুষের জীবনযাপনে, নিকটতম সঙ্গী হয়ে ওঠে। অত্যন্ত সহায়ক হয়ে ওঠে। 

৬. 'অতিথি' গল্পের সর্বাধিক বেদনা জনক ঘটনা কোনটি? এই গল্পের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা করো। 

উত্তর:👉 'অতিথি' গল্পের সবচেয়ে বেদনা জনক ঘটনা হ'ল বিয়ের জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত একটা পরিবারের সকলকে হতাশ করে বিয়ের পাত্র তারাপদর নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া।

👉গল্পের নায়ক পনের-ষোল বছরের কিশোর তারাপদ। তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হ'ল বন্ধন ভীরুতা। বনের পাখির মতো সে স্বাধীনভাবে উড়ে বেড়াতে চায়, কিন্তু খাঁচায় ধরা পড়তে ভয় পায়। বাইরের প্রকৃতি, বৃহত্তর সংসার তাকে ডাকে। তাই বাইরের ডাকে ছোটবেলা থেকেই তারাপদ ঘর ছাড়া। যখন যেখানে যার সঙ্গে ভালো লাগে, তার সঙ্গেই থেকে যায়। যেকোনো কাজ করে মানুষের সহায়তা করতে তার প্রবল আগ্রহ। এজন্য সব মানুষ তাকে ভালোবাসে। সেও সকলকেই ভালোবাসে। কিন্তু কারো বন্ধন স্বীকার করে না। অতিথির মতো কোনো দলেস, কোনো সংস্থায় বা কোনো পরিবারে হাজির হয়, ক'দিন আপন জনের মতোই থাকে, তার পর আবার অন্য কোথাও হারিয়ে যায়।

গল্পে আমরা দেখেছি, তারাপদ যাত্রাদলে, পাঁচালির দলে, জিমন্যাস্টিকের দলে যোগ দিয়ে গান গেয়েছে, বাঁশী বাজিয়েছে। সবশেষে এসে আশ্রয় নিয়েছে মতিলালবাবুর পরিবারে। এখানে একটা দুটো দিন নয়, পুরো দুটো বছর কাটিয়ে দিয়েছে। এই পরিবারে তারাপদ থেকেছে এক অতিথির মতই। তারাপদই গল্পের নায়ক। সে দৈবক্রমে মতিলালবাবুর পরিবারে আশ্রয় নিয়েছে। এই পরিবারেই চিরতরে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনাও দেখা দেয়। কিন্তু, তারাপদ সেই সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে, কাউকে কিছু না ব'লে আবার নিরুদ্দেশ হয়েছে। অতিথি যেমন কোথাও চিরস্থায়ী আশ্রয় গ্রহণ করে না, তেমনি তারাপদও কোথাও চিরস্থায়ী আশ্রয় গ্রহণ করে নি। নায়কের চরিত্রের এই বিশেষত্বক ব্যঞ্জিত করার জন্যই রবীন্দ্রনাথ গল্পটির নামকরণ করেছেন 'অতিথি'। এই নামকরণ ব্যঞ্জনাধর্মী এবং অবশ্যই সার্থক।

✍️প্রশ্নমান-১০:

১.‘অতিথি’-গল্পে ‘তারাপদ’ এক অনন্য সৃষ্টি -বিশেষ তথ্য সহযোগে বিশ্লেষণ করো।

অথবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অতিথি’ গল্প অবলম্বনে তারাপদ চরিত্রটি আলোচনা করো।

উঃ 'অতিথি' গল্পের নায়ক পনেরো ষোলো বৎসরের বালক তারাপদই সমগ্র ঘটনার মূল ভূমিকায় অধিষ্ঠান করে আছে। তাকে কেন্দ্র করে গল্পের সমস্ত কাহিনি, চরিত্র, ভাবধারা আবর্তিত হয়েছে। লেখক রবীন্দ্রনাথ আশ্চর্য ভঙ্গিতে চিরপথিক তারাপদর জীবনের বিশেষ একটা খণ্ডিত মুহূর্তকে অবলম্বন করে গল্পের অবয়ব নির্মাণ করেছেন। বিশেষ মুহূর্তটি স্থান প্রকৃতির প্রতি তারাপদর বিশেষ অন্তরঙ্গতা বোধ, যার হাতছানিতে সাংসারিক সমস্ত স্নেহ, মোহ-মায়ার বন্ধনকে ছিন্ন করতে দুর্বার গতিতে তারাপদ ধেয়ে যায়। তাই এটাকে শুধুমাত্র গল্প হিসাবে চিহ্নিত না করে জীবন দর্শনের চূড়ান্ত অভিব্যক্তি হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে, আর সেটা বাস্তবায়িত হয়েছে তারাপদকে দিয়েই। 

তারাপদর স্বল্পকালীন জীবন পরিক্রমার মধ্য দিয়েই গল্পের পূর্ণাঙ্গ অবয়ব মূর্ত হয়ে উঠেছে। গল্পের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে তারাপদর বাল্য-কৈশোরের নির্বিকার নির্লিপ্ত চিত্তের ঔদাসীন্য ভাবধারা। তবে কাঁঠালিয়ার জমিদার মতিলালবাবুর স্ত্রী অন্নপূর্ণার মধ্যস্থতায় তারাপদর অতীত জীবন সম্পর্কে যেটুকু জানা যায় তা এইরূপ-সে মা-বাবার চতুর্থ পুত্র এবং বাল্য বয়সেই পিতৃহীন। মা ও ভাইবোনের আদরে-স্নেহে, পাড়া প্রতিবেশীর প্রশ্রয়ে সে বড়ো হয়ে উঠেছে। ঠিক এমন এক মুহূর্তে কাউকে কিছু না জানিয়ে একটা বিদেশি যাত্রাদলের সঙ্গে মিশে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ায় বহু অনুসন্ধানের পর মা-ভাইয়েরা ও প্রতিবেশীরা একযোগে তাকে ফিরিয়ে আনলেও তার পালিয়ে যাবার মনোবৃত্তিকে কিছুতেই তারা দমন করতে পারেনি। বাধ্য হয়ে তারা এক সময়ে তারাপদকে সংসারে প্রতিষ্ঠা করবার বাসনা ত্যাগ করে। এরপর থেকেই তারাপদ বন্ধনহীন হয়ে শুরু করে তার নতুন জীবনের পদার্পণ। যাত্রাদলের পালা সাঙ্গ করে পাঁচালি গানের দলে অংশগ্রহণ তবে ক্ষণিকমাত্র। তারপর বিশেষ কৌতুহলবশত কিছুদিন জিমন্যাষ্টিকের দলে গিয়ে খেলাধুলা শিখে এসেছে। তারাপদ তো কোথাও থেমে থাকার পাত্র নয়। তাই এখানেও তার দীর্ঘকাল থাকা হল না। তাই সমস্ত ছেড়ে একদিন সে সখের যাত্রা দেখার জন্য একাকী নন্দীগ্রামে পাড়ি দিয়েছিল, তখনই মতিবাবু, অন্নপূর্ণা ও চারুশশীর সঙ্গে নদীতীরে তার সাক্ষাৎ ঘটে। লেখক গল্পের প্রথমেই বিশেষ কৌশলে তারাপদর নির্লিপ্ত উদাসীন বন্ধন মুক্ত স্বভাবের পরিচয় দিয়েছেন। তবে সে উদাসীন হলেও কোনও কর্মে সে অপটুতার পরিচয় রাখেনি। বহু প্রয়াসে এবং আত্মপ্রচেষ্টার দ্বারা যে-কোনো কর্ম স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে আয়ত্ব করতে সক্ষম হয়েছে। এ সম্বন্ধে বিশেষ আংশিক পরিচয় মেলে মতিলালবাবুর নৌকায় যাত্রাকালে-মাঝিদের রান্নায় সাহায্য করেছিল, দু'একবার রান্না করে দেখিয়ে দিয়েছিল সেও রান্না করতে জানে। তারপর মাঝিদের সঙ্গে নৌকার হাল ধরে নিজের পটুতার পরিচয় দিয়েছিল। তাছাড়া তারাপদর কতকগুলি সহজাত গুণ ছিল যেটাকে মিশুকে চরিত্র হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। তার দ্বারা অতি সহজেই সে যে-কোনো মানুষের মন জয় করতে পারতো। যাত্রার দলে অধিকারীর মন সে অনায়াসে জয় করে নিয়েছিল। গানের প্রতি বিশেষ ঝোঁকবশত পাঁচালি গানের দলে সে লব কুশের পালা আয়ত্ত করেছিল। নৌকার উপর সুমিষ্ট কণ্ঠে গান গেয়ে মতিবাবু অন্নপূর্ণার চারু শশী মাঝি মাল্লাদের এক নিমেষেই মন জয় করেছিল। জিমনাস্টিকের দলে ঢুকে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর তাগিদে খেলা শেখা, নৌকারোহী দোকানির সঙ্গে মিশে মেলায় পানের খিলি বিক্রি করা শিখেছিল। বিশেষ কৌতূহলবশত স্বাভাবিক প্রবণতায় বাঁশি বাজানো শিখে করুণ সুর মূর্ছনায় শ্রোতাদের মন মুগ্ধ করে দিত। তারাপদ তো আর পাঁচটা ছেলের মতো নয়-“যে-কোনো দৃশ্য তাহার চোখের সম্মুখে আসে তাহার প্রতি তারাপদর সকৌতূহল দৃষ্টি ধাবিত হয়, যে-কোনো কাজ তাহার হাতের কাছে আসিয়া উপস্থিত হয় তাহাতেই সে আপনি আকৃষ্ট হইয়া পড়ে। তাহার দৃষ্টি তাহার হস্ত তাহার মন সর্বদাই সচল হইয়া আছে; এইজন্য সে নিত্য সচলা প্রকৃতির মতো সর্বদাই নিশ্চিন্ত উদাসীন, অথচ সর্বদাই নিরাসক্ত।"

গল্পের সূচনা এবং পরিণত সমস্ত তারাপদকে ঘিরেই। খণ্ড খণ্ড চিত্রের মধ্য দিয়ে তারাপদর মানস বৈশিষ্ট্যের সূত্রগুলি সম্পর্কে অবহিত হলেও এটাই তার জীবনের সর্বশেষ কথা নয়। মানব জীবন যেমন তার কাছে বিশেষ আকর্ষণের বস্তু ছিল ঠিক তেমন প্রকৃতির রূপ রস সৌন্দর্য তার বিশেষ উপভোগের বস্তু ছিল। কিন্তু কোনও বিষয়েই আবদ্ধ থাকা ছিল তার স্বভাব বিরুদ্ধ, তাই সে এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছে। কারণ তারাপদর বিধাতা পুরুষ-"জন্ম নক্ষত্র তাহাকে গৃহহীন করিয়া দিয়াছে।” তাই সে চিরপথিক, এই পথ চলতেই তার আনন্দ। কালের অমোঘ নিয়মে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গায়িত জীবনোচ্ছাসের মধ্য দিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্ভার মনুষ্য চিত্তে বাসা বাঁধে একটা আসক্তির জগৎ রচনা করে আবার পরক্ষণেই কালের দুরন্ত তাড়ায় তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনে এটাই পরখ করেছে পরিণতি * অংশে কেবল মাত্র শূন্যতা এসে ধরা দিয়েছে। কিন্তু তারাপদ তাদের চেয়ে ভিন্ন পথের যাত্রী। নির্বিকার ঔদাসীন্যে আত্মভোলা জীবনদৃষ্টি দিয়ে মানুষ সমাজ এবং প্রকৃতির আঙিনায় সে বিচরণ করেছে, মনুষ্য লোকের সুখ-দুঃখ ব্যথা বেদনা স্নেহ-মায়া প্রেম-প্রীতি ক্ষণিকের জন্যে তাকে বেঁধে রাখলেও দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখতে পারেনি। অকাতরে বিদায় দিয়েছে। এই বিদায়ের মধ্য দিয়ে তারাপদর স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

মতিবাবুর গৃহে আশ্রয় পাবার পর আপন প্রতিভার বলে সবই জয় করলেও চারু- শশী যেন তার কাছে দুর্বোধ্য রয়ে যায়। বিশেষ করে সোনামণির সঙ্গে যখন সে কথাবার্তা বলতে থাকে, তবুও চারুশশীকে জয় করার জন্য তারাপদ আপ্রাণ চেষ্টা করে ধীরে ধীরে চারুকে সম্পূর্ণ ভাবে অধিকার করে বসল, চারুর মনে প্রণয়ের উদয় হয়। মতিবাবু অন্নপূর্ণা সৎপাত্রে কন্যা দান করার জন্য অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে আয়োজন প্রস্তুত করতে থাকে, কিন্তু তারাপদকে বাঁধবে কে? পৃথিবীর এমন কোনও কঠোর বন্ধন নেই যে তারাপদকে বেঁধে রাখতে পারে। বিবাহের আয়োজন যখন প্রস্তুত তারাপদর বিধাতাপুরুষ তাকে ডাক দিল নাগবাবুদের বিখ্যাত রথযাত্রার মেলাতে। স্নেহ-প্রেম- বন্ধুত্বের ষড়যন্ত্র ‘বন্ধন' কে ছিন্ন করে সবার অলক্ষে বর্ষার রাত্রেই সে বেরিয়ে পড়ে রথযাত্রার উদ্দেশ্যে। পিছনে পড়ে থাকে মতিবাবু অন্নপূর্ণার সাধবাসনা আর চারুশশীর জীবনের প্রথম প্রণয়। যাদের কাছে তারাপদ চিরকালের আপন জন হয়ে বিরাজ করতে পারতো তাদের কাছে কেবলমাত্র 'অতিথি' হিসাবে চিহ্নিত হয়ে রইল।