📚বি.এ মাইনর বাংলা:অভাগীর স্বর্গ -শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়:প্রশ্নোত্তর(প্রশ্নের মান -২,৫,১০)📚

✍️প্রশ্নমান-২:

প্রশ্ন: 'অভাগীর স্বর্গ' গল্পটি শরৎচন্দ্রের কোন্ গল্প গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত এবং তার প্রকাশকাল কত?

উত্তর : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'অভাগীর স্বর্গ' গল্পটি 'হরিলক্ষ্মী' গল্প গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত এবং গ্রন্থটির প্রকাশকাল ১৯২৬ খ্রিঃ।

প্রশ্ন: এক বর্ষীয়সী স্ত্রী-র মৃত্যুর সংবাদ দিয়ে 'অভাগীর স্বর্গ' গল্পের সূচনায় এই বর্ষীয়সী স্ত্রীলোকটি কে ছিলেন? তাঁর মৃত্যুর কারণ কী?

উত্তর : 'অভাগীর স্বর্গ' গল্পে যার মৃত্যু সংবাদ দিয়ে গল্পের সূচনায় সেই বর্ষীয়সী স্ত্রীলোকটি হলেন ঠাকুরদাস মুখুয্যের স্ত্রী। তাঁর মৃত্যুর কারণ সাত দিনের জ্বর। 

প্রশ্ন: 'অভাগীর স্বর্গ' গল্পের সূচনায় ও উপসংহারে দু'জন স্ত্রীলোকের মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে তারা কে কে?

উত্তর : 'অভাগীর স্বর্গ' গল্পের সূচনায় যার মৃত্যু সংবাদ দেওয়া হয়েছে তিনি ঠাকুরদাস মুখুজ্যের বর্ষীয়সী স্ত্রী এবং গল্পের উপসংহারে যার মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে সে হল স্বামী পরিত্যক্তা এক দুলে বৌ, নাম অভাগী। 

প্রশ্ন: 'অভাগী' নামটি কে কেন দিয়েছিল?

উত্তর: অভাগী নামটি দিয়েছিল তার বাবা (অভাগীর বাবা)। অভাগীকে জন্ম দিয়েই তার মা মারা গিয়েছিল বলে 'বাবা রাগ করিয়া নাম দিল অভাগী'।

প্রশ্ন : ঠাকুরদাস মুখুজ্যের স্ত্রীর শবযাত্রা দেখে কী মনে হয়েছিল? 

উত্তর : 'অভাগীর স্বর্গ' গল্পে ঠাকুরদাস মুখুজ্যের স্ত্রীর শবযাত্রা দেখে মনে হয়েছিল এ যেন বড়বাড়ির গৃহিনী পঞ্চাশ বর্ষ পরে আর একবার নতুন করে তাঁর স্বামী গৃহে যাত্রা করছেন।

প্রশ্ন: 'আর একটি প্রাণী একটু দূরে থাকিয়া এই দলের সঙ্গী হইল'। প্রাণীটির নাম কী? সে কোথায় যাচ্ছিল? উত্তর :👉 'অভাগীর স্বর্গ' থেকে উদ্ধৃত এই মন্তব্যটিতে প্রাণীটি হল কাঙালীর মা অভাগী। 

👉কাঙালীর মা কুটীর প্রাঙ্গণে গোটা কয়েক বেগুন তুলে হাটে যাচ্ছিল। 

প্রশ্ন: সে চোখের জল মুছিতে মুছিতে সকলের পিছনে শ্মশানে আসিয়া উপস্থিত হইল'- সে কে? শ্মশানটি কোথায় অবস্থিত ছিল?

উত্তর : 👉এখানে 'সে' বলতে কাঙালীর মা অভাগীর কথা বলা হয়েছে। 

👉শ্মশানটি অবস্থিত ছিল গ্রামের একান্তে গরুড় নদীর তীরে।

প্রশ্ন: কাঙালীর বাবার নাম কি ছিল? সে কোথায় থাকতো?

উত্তর:👉 কাঙালীর বাবার নাম ছিল রসিক বাঘ।

👉 রসিক বাঘ তার অন্য বাঘিনীকে নিয়ে গ্রামান্তরে থাকতো।

প্রশ্ন: 'এই ছলনায় বহুদিন কাঙালীর মা কাঙালীকে ফাঁকি দিয়া আসিয়াছে।' কাঙালীর মা কে? ছলনাটি কি ছিল?

উত্তর:👉 কাঙালীর মা অভাগী। 

👉অভাগীর দুঃখের সংসার। কাঙালীকে নিয়ে অতি কষ্টে দিন কাটাতো সে। কোনোদিন তার কপালে খাবার জুটতো, কোনোদিন জুটতো না। যেদিন কপালে কিছু জুটতো না সেদিন সন্তানকে কিছু খাইয়ে নিজে খিদে নেই বলে কাটিয়ে দিত। এখানে 'ছলনা' বলতে অভাগীর ক্ষিদে না থাকার অজুহাতের কথা বলা হয়েছে।

প্রশ্ন: 'কাঙলার মার মত সতী-লক্ষ্মী আর দুলে পাড়ায় নেই'- কথাটি কে কাকে বলেছে?

উত্তর: উদ্ধৃত কথাটি বলেছে বিন্দির মা রাখালের পিসিকে। 

প্রশ্ন: 'আয় তোকে রূপকথা বলি'—কথাটি কে কাকে বলেছে? কোন্ রূপকথার কথা বলেছে সে?

উত্তর :👉 উদ্ধৃত মন্তব্যটি করেছে অভাগী তার ছেলে কাঙালীকে। 

👉এখানে রূপকথার গল্প বলতে অভাগী রাজপুত্তুর, কোটাল পুত্তর বা পক্ষীরাজ ঘোড়ার কথা নয়, সে এমন রূপকথা শুরু করেছিল যা পরের কাছে শোনা নয়, নিজের সৃষ্টি। সেখানে শুধুই শ্মশান আর শ্মশান যাত্রার কাহিনী। সেই রথ, রাঙা পা দুটি আর স্বর্গে যাওয়া।

প্রশ্ন: অভাগী তার শেষ কোনো ইচ্ছার কথা কাঙালীকে বলেছিল? 

উত্তর : 'অভাগীর স্বর্গ' গল্পে অভাগী স্বামীর পায়ের ধূলো আর কাঙালীর হাতের আগুন পায়ে আলতা, মাথায় সিঁদুর নিয়ে বামুন মার মত সগ্যের রথে চেপে সগ্যে যেতে চেয়েছিল।

প্রশ্ন: কাঙালীর বয়স কত? তার মা কত বৎসর বয়সে মারা গিয়েছিল? 

উত্তর:👉 কাঙালীর বয়স ১৫ বৎসর। 

👉তার মা ৩০ বৎসর বয়সে মারা গিয়েছিল। 

প্রশ্ন: অভাগীর নাড়ী কে দেখেছিল? তার নাড়ী দেখার অর্থ কে বুঝেছিল?

উত্তর: 👉অভাগীর নাড়ী দেখেছিল ঈশ্বর নাপিত।

👉 ঈশ্বর নাপিতের গম্ভীর মুখ, দীর্ঘ নিশ্বাস এবং পরিশেষে মাথা নাড়ার অর্থ কাঙালী উপলব্ধি করেছিল।

প্রশ্ন: 'সে শুধু একটু পায়ের ধূলা দিতে গিয়া কাঁদিয়া ফেলিল' 'সে' কে? কেন সে কাঁদিয়া ফেলিল? 

উত্তর:👉 'অভাগীর স্বর্গ' থেকে উদ্ধৃত এই মন্তব্যটিতে সে বলতে অভাগীর স্বামী রসিক দুলেকে বোঝানো হয়েছে।

👉সে কেঁদে ফেলেছিল কারণ সে জানতো না যে স্ত্রীকে কোনো দিন এতটুকু ভালোবাসেনি, অশন-বসন দেয়নি, কোনো খোঁজখবর রাখেনি এমনকি সন্তানেরও খোঁজ নেয়নি সেই স্ত্রী তাকে কতটা ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। এটা ভেবেই সে কেঁদে ফেলেছিল।

প্রশ্ন: 'এ কি তোর বাপের গাছ আছে যে কাটতে লেগেছিস?' কথাটি কে কাকে বলেছে? কেন বলেছে?

উত্তর:👉 কথাটি বলেছে জমিদারের হিন্দুস্থানী দারোয়ান।

👉স্ত্রী অভাগীর মৃত্যুর পরে স্বামী রসিক স্ত্রীর ইচ্ছা পূরণের জন্য বাড়ির প্রাঙ্গণে অভাগীর লাগানো বেল গাছটা একটা কুড়ুল চেয়ে কাটতে গেলে জমিদারের দারোয়ান তার গালে সশব্দে একটা চড় মেরে এই মন্তব্যটি করেছে।

প্রশ্ন: কাঙালী দারোয়ানের গাছ কাটতে না দেওয়া ও বাবাকে মারার প্রতিবিধানের জন্য কার কাছে গিয়েছিল? তার ফল কি হয়েছিল?

 উত্তর:👉 কাঙালী সদ্য মাতৃহীন বালক মায়ের শোকে ও বাবাকে মারার উত্তেজনায় প্রতিবিধানের জন্য জমিদারের গোমস্তা অধর রায়ের কাছে গিয়েছিল।

👉অধর রায় সবকিছু শোনার পর গাছের দাম পাঁচ টাকা চেয়েছিল কিন্তু কাঙালী এই গাছ তার মায়ের লাগানো বলে জানালে অধর রায় পাঁড়েকে দিয়ে কাঙালীকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিল।

প্রশ্ন: মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য কাঙালী দ্বিতীয় বার কার বাড়ি গিয়েছিল? এবং তার ফল কি হয়েছিল?

উত্তর: 👉কাঙালী অধর রায় কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে মুখুয্যে বাড়িতে গিয়েছিল। 

👉কাঙালী বৃদ্ধ ঠাকুর দাসকে তার মায়ের শেষ ইচ্ছার কথা জানালে তিনি তাঁরই কাঠের দরকার বলে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল।

প্রশ্ন: 'কাঙালী আর প্রার্থনা করিল না'-কেন সে আর প্রার্থনা করেনি?

 উত্তর: কাঙালী তার মা অভাগীর স্বর্গ লাভের ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করতে প্রথমে জমিদারের গোমস্তা এবং পরে মুখুয্যে বাড়িতে গিয়ে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে আসে। শুধু তাই নয়, অনেক অবজ্ঞা, লাঞ্ছনা, গঞ্জনাও তাকে শুনতে হয়। বালক কাঙালী ঐ সময়ের মধ্যে বুঝে যায় এই সমাজটাই গরীবের বিরুদ্ধে। তাই সে আর কারো কাছে প্রার্থনা জানায়নি।

প্রশ্ন : 'এই বলিয়া সে ঘটনাটা প্রকাশ করিয়া কহিল'-কে কোন্ ঘটনার কথা প্রকাশ করেছিল?

উত্তর : 'অভাগীর স্বর্গ' গল্পে অভাগীর ছেলে কাঙালী মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য গোমস্তার কাছ থেকে বিতাড়িত হয়ে মুখুয্যে মশাইয়ের কাছে গিয়ে আবেদন জানালে মুখুয্যে মশাই প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে পারেন না। এমন সময় এক কর্মচারী অভাগীর শেষ ইচ্ছা ছেলের হাতে মুখে আগুনের জন্য একটা গাছের জন্য কাঙালী তাঁর কাছে এসেছে বলে জানায়।

প্রশ্ন: 'কে কাঙালীর হাতে খড়ের আঁটি ফেলে দিয়েছিল?' তার পর কি হয়েছিল?

উত্তর : 👉'অভাগীর স্বর্গ' গল্পে রাখালের মা কাঙালীর হাতে খড়ের আঁটি জ্বেলে দিয়েছিল।

👉এরপর নদীর চড়ের গর্তে শোয়ান অভাগীর উপর সকলে মিলে মাটি চাপা দিয়ে কাঙালীর মায়ের শেষ চিহ্ন বিলুপ্ত করে দিয়েছিল।

প্রশ্ন: অভাগীকে মাটি চাপা দেওয়ার সময় কাঙালী কী করছিল?

উত্তর: সবাই যখন তার মাকে মাটি চাপা দিতে ব্যস্ত তখন মাতৃহীন বালক কাঙালী পোড়া খড়ের আঁটি থেকে বের হওয়া স্বল্প ধুয়াটুকু যা ঘুরে ঘুরে আকাশে উঠছিল, তার দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করছিল স্বর্গের রথ এসে তার মাকে স্বর্গে নিয়ে যাচ্ছে কি না। কেননা সেটাই তার মায়ের শেষ ইচ্ছা ছিল।

প্রশ্ন : 'অভাগীর অভাগ্যের দেবতা অগোচরে বসিয়া কি ভাবিলেন জানি না।'-'অভাগীর অভাগ্যের দেবতা' বলতে কী বোঝানো হয়েছে?

উত্তর : 'অভাগীর স্বর্গ' গল্পে কাঙালীর মা জন্মের মুহূর্ত থেকে অভাগী। কেননা জন্ম মুহূর্তেই সে মাকে হারিয়েছে। তারপর যে রসিক বাঘের সাথে তার বিয়ে হয়েছিল সে তার অন্য বাঘিনীকে নিয়ে গ্রামান্তরে চলে গিয়েছে। শুধু কাঙালীর মুখ চেয়ে দারিদ্র্য আর দুর্ভাগ্য নিয়ে তিরিশটি বছর ধরে জীবন যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। তাই সে অভাগী। আর তার দেবতা সেই অর্থেই অভাগ্যের দেবতা।

প্রশ্ন: ভট্টাচার্য মশাই কাঙালীকে কী উপদেশ দিয়েছিল?

উত্তর : 'অভাগীর স্বর্গ' গল্পে কাঙালী তার মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য মুখুয্যে মশাইয়ের কাছে আবেদন জানিয়ে ব্যর্থ হলে ভট্টাচার্য মশাই ফর্দ করতে করতে অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সাথে কাঙালীকে তার মৃত মায়ের মুখে নুড়ো জ্বেলে নদীর চড়ায় মাটি দিতে বলেছিল।

প্রশ্ন: 'নিঃশব্দে ধীরে ধীরে তাহার মরা মায়ের কাছে গিয়া উপস্থিত হইল' মন্তব্যটির তাৎপর্য কী?

উত্তর : 'অভাগীর স্বর্গ' গল্পে কাঙালী তার মায়ের স্বর্গে যাওয়ার ইচ্ছাকে সফল করতে গোমস্তা থেকে শুরু করে সম্ভ্রান্ত বংশীয় মুখুয্যে মশাইয়ের বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে এই সত্য উপলব্ধি করেছিল যে নিম্ন জাত আর গরীব বলে তার আবেদনের কোনো মূল্য নেই। সমাজপতিরা তাদের বিরুদ্ধে। ঘন্টা দুয়েকের অভিজ্ঞতাতেই সে যেন বৃদ্ধ মানুষের মত অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিল। বুঝেছিল গরীব হওয়া পাপ, গরীবদের জন্য এই পৃথিবী বিমুখ। তাই নিঃশব্দে সে মরা মায়ের কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল।

✍️প্রশ্নমান-৫:

১.'এই ঘন্টা দুয়েকের অভিজ্ঞতায় সংসারে সে যেন একেবারে বুড়া হইয়া গিয়াছিল'-এখানে 'সে' বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে? তার 'ঘন্টা দুয়েকের অভিজ্ঞতা'টির বর্ণনা দাও।

উত্তর :👉 শরৎচন্দ্রের 'অভাগীর স্বর্গ' গল্প থেকে উদ্ধৃত এই অংশে 'সে' বলতে অভাগীর ছেলে কাঙালীকে বোঝানো হয়েছে।

👉আলোচ্য গল্পটির বিষয়বস্তু থেকে জানা যায় ঠাকুরদাস মুখুজ্যের বর্ষীয়সী স্ত্রী পরলোকগমন করলে মহা ধূমধামে চন্দন কাঠের চিতায় সৎকার করা হয়। অভাগী দূর থেকে সে দৃশ্য দেখে আর ভাবে অজস্র ধোঁয়ার মধ্যে সগ্যের রথ এসে ঠাকরুন মাকে স্বর্গে নিয়ে যায়। অভাগীরও ঠাকরুন মায়ের মত সগ্যে যেতে ইচ্ছা হয় এবং সে দায়িত্ব বালক কাঙালী হাতে অর্পণ করে অভাগী মারা যায়।

কাঙালী তার মায়ের ইচ্ছা পূরণ করার জন্য বাড়ির উঠোনের বেলগাছটা বাবাকে দিয়ে কাটাতে শুরু করলে জমিদারের পেয়াদা তার বাবাকে মেরে কুড়ুল কেড়ে নিয়ে অজস্র গালাগালি শুরু করে। সকলে মিলে অনুরোধ করলেও সে শোনে না। কাঙালী তার মায়ের হাতে লাগানো গাছের অধিকার পেতে গোমস্তা অধর রায়ের স্মরণাপন্ন হয় কিন্তু সেখানে সে যে অভিজ্ঞতা লাভ করে তা অত্যন্ত মর্মান্তিক। জাতিতে দুলে হওয়ায় দাওয়া থেকে তাকে নামিয়ে গোবর জল দেওয়া হয় এবং গোমস্তা তার কথা শুনে অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের সুরে বলেন- 'দুলের মড়ার কাঠ কি হবে শুনি?' এরপর গাছের দাম পাঁচ টাকা চেয়ে বসেন। কাঙালী তার মায়ের হাতের লাগানো গাছের অধিকার চাইলে গোমস্তা তাকে পাঁড়েকে দিয়ে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন। বালক কাঙালী বুঝতে পারে না তার অপরাধ।

এরপর সে উপস্থিত হয় মুখুয্যে বাড়িতে। সে ভাবে সেখানে অনেক কাঠ। কিছুটা পেলেই তার মায়ের ইচ্ছা পূর্ণ হবে। কিন্তু সেখানেও কাঙালীর আবদার শুনে মুখুয্যে বিস্মিত ও বিরক্ত হয়ে ওঠেন এবং 'যা যা এখানে কিছু হবে না' বলে অন্যত্র চলে যান।ভট্টাচার্য মশাই তাকে মায়ের মুখে একটু নুড়ো জ্বেলে নদীর চড়ায় মাটি দেওয়ার উপদেশ দেন। আর মুখুয্যে মশাইয়ের বড় ছেলে 'সব ব্যাটাই বামুন কায়েত হতে চায়' বলে উপহাস করেন। এরপর কাঙালী আর প্রার্থনা করে না। কেননা এই ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই সে হৃদয়হীন সমাজকে চিনে ফেলে। 'বুড়া' অর্থাৎ বৃদ্ধ। যাঁরা দীর্ঘ আয়ু নিয়ে সমাজকে দেখেন ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। সমাজ ও সংসারকে সব থেকে বেশি চেনেন বৃদ্ধ মানুষরা। এখানে কাঙালীকে সমাজ চিনতে দীর্ঘ আয়ু পেতে হয়নি। মাত্র দু'ঘন্টাতেই সে যেন বৃদ্ধ মানুষদের মতই অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলেছিল। বুঝেছিল গরীব হওয়া মহাপাপ এবং এই পৃথিবীটা গরীবদের বিরুদ্ধে।

 ২.'হায় রে অনভিজ্ঞ! বাঙলাদেশের জমিদার ও তাহার কর্মচারীকে সে চিনত না।' এখানে 'সে' বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে? বাঙলাদেশের কোন্ জমিদার ও কর্মচারীকে সে চিনতো না?

উত্তর :👉 শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত 'অভাগীর স্বর্গ' গল্প থেকে উদ্ধৃত এই মন্তব্যটিতে 'সে' বলতে অভাগীর ছেলে কাঙালীকে বোঝানো হয়েছে।

👉শরৎচন্দ্র বাংলাদেশের দুর্ভাগা দরিদ্রদের জীবনের ইতিহাস নিয়ে যে সকল গল্প রচনা করেছেন, সেগুলির অন্যতম 'অভাগীর স্বর্গ'। এই ছোট গল্পটির মধ্যে তিনি বিরাট পল্লী সমাজের রূপ দিয়েছেন। জমিদারী শাসনে পীড়িত অসহায় মানুষদের এ যেন এক জীবন্ত চিত্র।

আলোচ্য গল্পে অভাগী 'মা-ঠাকরুণ'-এর মতো রথে করে সগ্যে যাওয়ার আকাঙ্খা নিয়ে এবং তার বাস্তব রূপ দেওয়ার দায়িত্ব তার কাঙালীর হাতে দিয়ে মারা যায়। কাঙালীর বাবা কুড়ুল দিয়ে অভাগীর হাতে পোঁতা বেল গাছটা কাটতে গেলে এক হিন্দুস্থানী দারোয়ান রসিককে মেরে কুড়ুল কেড়ে নেয়। কাঙালী মনে করে এই অসংগত অত্যাচারের কথা কর্তার কানে গেলে নিশ্চয় তার প্রতিবিধান হবে কিন্তু সেখানে গোমস্তা অধর রায় তার সাথে যে ব্যবহার করে তাতে তার বিশ্বাস ভেঙে পড়ে। মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণের স্বপ্নও ফিকে হয়ে আসে। অধর রায় তাকে গাছের দাম পাঁচ টাকা চেয়ে বসলে তার একমাত্র সম্বল পিতলের কাঁসিটির এক টাকায় বাঁধা দিয়ে উত্তরীয় কেনার কথা মনে পরে। এরপর সে তার মায়ের হাতে পোঁতা গাছটির দাবী জানালে গোমস্তা তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন।

কাঙালী ধূলা ঝেড়ে মাটি থেকে উঠে ভেবেই পায় না তার অপরাধ কী। এভাবেই সদ্য মাতৃহীন বালক কাঙালীকে ফিরে আসতে হয়। আসলে শরৎচন্দ্র সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার হৃদয়হীনতার এক অপূর্ব চিত্র এখানে তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি তিনি জাতিভেদ প্রথায় দীর্ণ, ভঙ্গুর পল্লী সমাজের চিত্রও দুলে কাঙালীর প্রতি সমাজের উঁচু তলার মানুষদের আচরণের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। বাল্য কৈশোরের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে কাঙালী বাংলাদেশের সেইসব জমিদার ও তার কর্মচারীদের চিনতে পারেনি, যারা অর্থ ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। তাদের কাছে অর্থই সত্য আর সব মিথ্যা। তাদের হৃদয়ে ভালোবাসা, মূল্যবোধ, ন্যায়, নীতি, আদর্শ বলতে কিছু নেই। তাই কাঙালীর মায়ের ইচ্ছা পূরণের আকুলতা তাদের কাছে বাহুল্য এবং অবান্তর। তারা অনায়াসে বলতে পারে, 'দুলের মড়ার কাঠ কি হবে শুনি?' শুধু তাই নয় সদ্য মাতৃহীন বালককে ঘর থেকে বের করে গোবর জল ছিটাতে ব্যস্ত তারা। কাঙালীর শোক, উত্তেজনা, বেদনা বোঝার দায় তাদের নেই। লেখক তথাকথিত বাংলাদেশের এই সব হৃদয়হীন জমিদার ও তার কর্মচারীদের কথা বলেছেন যাদেরকে কাঙালীর সহজ মন চিনতে পারেনি।

৩.'এ যেন বড় বাড়ির গৃহিণী পঞ্চাশ বর্ষ পরে আর একবার নতুন করিয়া স্বামী গৃহে যাত্রা করিতেছেন।' এখানে বড় বাড়ির গৃহিণী বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে? মন্তব্যটির তাৎপর্য বিচার করো।

উত্তর :👉 শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'অভাগীর স্বর্গ' গল্প থেকে উদ্ধৃত এই মন্তব্যটিতে 'বড় বাড়ির গৃহিণী' বলতে ঠাকুরদাস মুখুয্যের বর্ষীয়সী স্ত্রীকে বোঝানো হয়েছে।

👉এই মানব জীবনে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। প্রত্যেককেই একদিন না একদিন ঘর সংসার, সন্তান সন্ততিদের ছেড়ে চলে যেতেই হয়। এই চলে যাওয়াটা কখনো হয়ে ওঠে বড়ই বেদনার আবার কখনো তা হয়ে ওঠে আনন্দের। যখন কেউ এই পৃথিবীর সুখ, আনন্দ উপভোগ করে, সংসারের প্রিয়জনদের প্রতিষ্ঠিত দেখে অতি বৃদ্ধ বয়সে চলে যান তখন তাঁর এই চলে যাওয়াটা তাঁর সংসারের কাছে হয়ে ওঠে আনন্দের ব্যাপার। আলোচ্য গল্পে ঠাকুরদাস মুখুয্যের বৃদ্ধা স্ত্রী দিন সাতেকের জ্বরে মারা গেলে বাড়িতে একটা উৎসব বেঁধে যায়। কেননা তিনি ছিলেন একজন আর্থিক সংগতিপন্ন মানুষের স্ত্রী। তাই খাওয়া দাওয়া, পোষাক পরিচ্ছেদ থেকে শুরু করে সমস্ত বিষয়েই তিনি সব কিছু হাতের কাছেই পেয়েছেন, তাঁর চার ছেলে, তিন মেয়ে, নাতি নাতনি, জামাই সকলকে নিয়েই ছিল তাঁর ভরা সংসার। সেখানে কারো কোনো দুঃখ কষ্ট বলে কিছু ছিল না। বরং সকলেই ছিলেন আনন্দিত। এইরকম এক সঙ্গতিপন্ন ব্রাহ্মণ বাড়ির স্ত্রীর মৃত্যুতে পাড়া প্রতিবেশীরাও ধূমধামের শবযাত্রা দেখতে ভিড় করেছিল। মেয়েরা কাঁদতে এখা কাঁদতে মায়ের দুই পায়ে আলতা ও মাথায় সিন্দুর লেপে দিয়ে, বধূরা চন্দন দিয়ে নিশি বহুমূল্য বস্ত্রে সেই আচ্ছাদন করে আঁচল দিয়ে শেষ পদধূলি মুছে নেয়। শবদেহকে পত্রে, পুষ্পে, মাল্যে, গন্ধে এমন সুন্দর করে সাজানো হয় যেন মনে হয় পঞ্চাশ বৎসর পরে পুনরায় তিনি আবার নতুন করে পতিগৃহে যাত্রা করছেন।

আসলে শরৎচন্দ্র এখানে বড় বাড়ির অর্থাৎ অর্থশালী মুখুয্যে মহাশয়ের বৃদ্ধা স্ত্রীর মৃত্যুর ও শ্মশান যাত্রার বর্ণনার মধ্য দিয়ে মুখুয্যে মহাশয়ের খ্যাতি, প্রভাব, প্রতিপত্তি সর্বোপরি আর্থিক সংহতির কথা তুলে ধরতে চেয়েছেন, যার মধ্যে মিশে আছে হৃদয়হীনতা আর আর্থিক স্বচ্ছলতার অহমিকা।

৪.‘এই ছলনায় বহুদিন কাঙালীর মা কাঙালীকে ফাঁকি দিয়া আসিয়াছে।' ছলনাটি কী? সংক্ষেপে আলোচনা করো।

উত্তর : 👉শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'অভাগীর স্বর্গ' গ্রামবাংলার বঞ্চিত মানুষদের পুঞ্জিত বেদনার এক অপূর্ব প্রকাশ। আলোচ্য গল্পের নাম চরিত্র অভাগী প্রকৃতই এক হতভাগিনী নারী। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে সে মাকে হারিয়েছে তাই তো তার নাম অভাগী। অ-ভাগ্যই যেন তার চলার পথের পাথেয় তাই বিবাহের সাথে সাথে স্বামী রসিক বাঘ তার অন্য বাঘিনীকে নিয়ে গ্রামান্তরে চলে যায়। একমাত্র শিশু পুত্রের মুখ চেয়ে একাকী সহায় সম্বলহীন অভাগী দুঃখ, কষ্ট, বেদনাকে মূলধন করে ভবিষ্যতের পথে পা বাড়ায়।

👉অতিকষ্টে সংসার চালাতো সে। কখনো কুটীর প্রাঙ্গণে সবজির গাছ লাগিয়ে কখনো পরের বাড়িতে কাজ করে আবার কখনো বা দিনমজুর খেটে সন্তানকে বড় করে তুলেছিল সে। তাই দারিদ্র্য যার নিত্য সঙ্গী তার যে মাঝে মাঝে মুখে কিছু উঠবে না এটাই তো স্বাভাবিক। অবশেষে তার কাঙালী পনেরয় পা দিয়েছে। সবেমাত্র বেতের কাজ শিখতে শুরু করেছে। অভাগীর আশা আর কিছু দিন সে কাজ শিখলে তার দুঃখ ঘুচবে। যাইহোক একদিন কাঙালী ভাত খেয়ে পুকুরে আঁচিয়ে এসে দেখে মা তার পাতের উচ্ছিষ্ট খাদ্যগুলো মাটির পাত্রে ঢেকে রাখছে। কাঙালী মাকে তার খাবার কথা জিজ্ঞাসা করলে অভাগী জানায়-তার খিদে নেই। কিন্তু কাঙালী তা বিশ্বাস করে না। হাঁড়ি পরীক্ষা করে দেখে। আসলে অভাগী খিদে না থাকার অজুহাত প্রায়ই ছেলেকে দেখায় যা ছলনা ছাড়া আর কিছুই নয়। অভাগী ছেলের পাতের উচ্ছিষ্টটুকু খেয়ে হাঁড়ির ভাতটুকু ছেলের জন্য রাখতে চেয়েছিল। অভাবের সংসারে দ্বিতীয়বার রান্নার সংগতি তার থাকতো না-তাই বার বার তার ছলনার আশ্রয় নেওয়া সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসার এ এক অপূর্ব প্রকাশ। 'মহেশ' গল্পেও আমরা দেখি গফুর ছলনার আশ্রয় নিয়ে তার বাড়া ভাতটুকু মহেশকে খাইয়েছে, কেননা মহেশ যে তার সন্তানের মত। এখানে অভাগী আর গফুরের বাৎসল্য রস, সন্তান প্রীতি, যেন এক সূত্রে গ্রথিত হয়েছে। ছলনার মধ্য দিয়ে উভয়েই হৃদয়ের ভালোবাসার গভীরতার দিকটি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।

✍️প্রশ্নমান-১০:

১.শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'অভাগীর স্বর্গ' গল্পে তৎকালীন সমাজ জীবনের যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা সংক্ষেপে আলোচনা করো।

উত্তর : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ছোটোগল্পের সাহায্যে বিরাট পল্লী সমাজের রূপ দিয়েছেন। তাঁর সাহিত্যের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে দুর্ভাগা দরিদ্রদের জীবনের ইতিহাস। শরৎচন্দ্র নিজেই বলেছেন সমাজের অখ্যাত, অভাজন, দরিদ্রদের জীবনের শরিক হয়েছেন তিনি এবং তাদের বেদনাই তাঁর মুখ খুলে দিয়েছে এবং এরাই তাঁকে মানুষের কাছে মানুষের নালিশ জানাতে প্রেরণা দিয়েছে।

'অভাগীর স্বর্গ' এক স্বামী পরিত্যক্তা নারী অভাগীর জীবন বেদনার এক অপূর্ব ভাষ্য। সেখানে অভাগীর জীবনটাই শুরু হয়েছে অভাগ্য নিয়ে। জন্মের পর মুহূর্তেই সে মা'কে হারিয়েছে। যৌবনে বিবাহের সাথে সাথে স্বামী পরিত্যক্তা হয়েছে সে। এরপর জীবন সংগ্রামে শুধু দুঃখ, দারিদ্র্য, আর বেদনাই হয়েছে তার নিত্য সঙ্গী। ছেলে কাঙালীকে নিয়ে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিল সে কিন্তু দারিদ্র্য তাকে এই পৃথিবী থেকেই বিদায় দিয়েছে। একটি মাত্র আশা (স্বর্গে যাওয়ার) নিয়ে পৃথিবী ছেড়েছে কিন্তু নির্দয় সমাজ তার সে আশা পূরণ হতে দেয়নি। নিচু জাতের বৌ বলে মুখে খড়ের মুড়োর আগুন নিয়ে সমাধিস্থ হতে হয়েছে তাকে। বালক কাঙালী মাত্র ঘন্টা দু'য়েকেই এ বিরাট সমাজকে চিনতে পেরেছে। বুঝেছে গরীব হওয়া মহাপাপ, এই পৃথিবীটাই গরীবের বিরুদ্ধে।

সাহিত্য সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবি। সেই অর্থে অভাগীর স্বর্গ গল্পেও যে সমাজ চিত্রিত হয়েছে তা তৎকালীন সমাজ জীবনেরই বাস্তব রূপ। 'অভাগীর স্বর্গ' গল্পে তৎকালীন অর্থনৈতিক বৈষম্যের ছবি ফুটে উঠেছে। এক শ্রেণীর মানুষের হাতে প্রচুর পয়সা আর এক শ্রেণী নিঃস্ব, রিক্ত অসহায়। তাই মুখুজ্যে মহাশয়ের বর্ষীয়সী স্ত্রীর অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া মহাসমারোহে চন্দন কাঠের চিতায় সম্পন্ন হয় আর অভাগীর অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন হয় খড়ের নুড়োর আগুনে মাটি চাপা দিয়ে। এমনকি অভাগী তার নিজের হাতে লাগানো গাছটির কাঠ দিয়েও তার চিতা সাজাতে পারেনি। দারিদ্র্যই ছিল তার নিত্য সঙ্গী। নিজে না খেয়ে কিংবা জ্বরের আছিলায় শুধুমাত্র ছেলের মুখের ভাত টুকু যোগাড় করেছে আর অনাহার, ক্ষুধা, তাকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। সমাজ তার কোনো হিসাব রাখেনি।

জমিদারী শাসন ব্যবস্থার নির্দয়তার চিত্র খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে এই গল্পে। অভাগীর মৃত্যুর পর তার স্বামী বাড়ির উঠোনের গাছটি কাটতে গেলে জমিদারের পেয়াদা বাধা দিয়েছে এমনকি রসিককে মারধোর করেছে আর কাঙালীকে গালাগালি করেছে। এর বিধান চাইতে কাঙালী গোমস্তার কাছে গেলে গোমস্তা অধর রায় গাছের দাম বাবদ পাঁচ টাকা চেয়েছে। কাঙালী গাছটি তার মায়ের লাগানো বলে জানালে গোমস্তা তাকে দারোয়ান 'পাঁড়ে' কে দিয়ে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে। এমনকি ঐ বালককে মারধোর করতেও তাদের হাত কাঁপেনি। এই তো তৎকালীন সামন্ততান্ত্রিক সমাজ, যেখানে প্রজাদের জীবনের কোনো মূল্য ছিল না।

জাতিভেদ প্রথা তৎকালীন সমাজে যে কী ভয়ঙ্কর রূপে প্রতিষ্ঠিত ছিল তারও পরিচয় আমরা এখানে পাই। অভাগী ছিল জাতিতে দুলে। তাই সমাজের একপাশে ছিল তার ঠাঁই। সে মারা গেলে তার ছেলে কাঙালী গোমস্তার বাড়ি গেলে, গোমস্তা গোবর জল ছিটিয়েছে। এমন কি কাঙালী মায়ের অন্ত্যেষ্টির জন্য কাঠ চাইলে অধর কহিলেন দুলে। দুলের মড়ার কাঠ কি হবে শুনি?' সেখান থেকে কাঙালী মুখুয্যে মহাশয়ের বাড়ি কপালে তাকে হয়েছে, 'তোদের জো' এই জাতীয় কথা। এ থেকেই গোলে সেখানেও তাকে শুনতে হয়েছে, 'তোদের জেতে কে কবে আবার পোড়ায় রে? বোঝা যায় তৎকালীন সমাজে নীচু জাতের মানুষের কোনো মূল্য ছিল না। 

'অভাগীর স্বর্গ' গল্পে শরৎচন্দ্র সমাজের নির্দয়তা ও হৃদয়হীনতার চিত্রও তুলে ধরেছেন। সেখানে জমিদার, গোমস্তা থেকে শুরু করে অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ সকলেই যেন গরীবদের বিরোধী। তাই কাঙালী মায়ের শেষ ইচ্ছাটুকু পূরণের জন্য দরজায় দরজায় ঘুরেও ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে। নিজের ঘরের গাছ কাটার অনুমতি সে পায়নি আবার মুখুজ্যে মহাশয়ের অনেক কাঠ থাকা সত্ত্বেও তা থেকে একটু দিয়ে কাঙালীকে সাহায্য করেনি। উপরন্তু মারধোর করে কটু কথা বলে, অবজ্ঞা করে তাকে বের করে দিয়েছে। মানুষ হয়ে মানুষকে মূল্য দেয়নি। কাঙালী তার মায়ের শেষ ইচ্ছাটুকু পূরণ করতে পারেনি একমাত্র সমাজের নির্দয়তার, হৃদয়হীনতার কারণে।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর 'অভাগীর স্বর্গ' গল্পে তৎকালীন জমিদারী শাসন ব্যবস্থার কঠোরতা শোষণ, পীড়ন, অবিচার, অর্থনৈতিক বৈষম্য, জাতিগত বিভেদ, অস্পৃশ্যতা, দরিদ্র অসহায়দের প্রতি সমাজের উপরতলার মানুষদের অবজ্ঞা প্রভৃতি বর্ণনার পাশাপাশি, অভাগীর চারিত্রিক শুচিতা ও পতিপ্রেম, নিম্নশ্রেণীর মানুষদের অর্থাৎ রসিক বাঘদের দ্বিতীয় বাঘিনীর উপস্থিতি সব মিলিয়ে তৎকালীন পল্লী সমাজের এক বৃহত্তর রূপ পরিস্ফুট করেছেন। সেখানে বিশালায়তন উপন্যাসের বিস্তৃতি ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের সঙ্গে ছোট গল্পের রসঘন নিবিড়তার সমন্বয় হয়েছে।

২.'অভাগীর স্বর্গ' গল্পের কাহিনীতে দুটি মৃত্যু দৃশ্য আছে-একটি সূচনায় অন্যটি শেষে। দুটির তুলনামূলক আলোচনা করো।

উত্তর: শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা কথা সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য সাহিত্যিক, যাঁর রচনার বেশির ভাগ অংশ জুড়ে রয়েছে অখ্যাত, অবজ্ঞাত, অবহেলিত, গ্রামবাংলার মানুষদের বঞ্চিত বুকের পুঞ্জিত বেদনার কথা। তাঁর 'অভাগীর স্বর্গ' ও সেই ধরনের একটি ছোট গল্প, যার মধ্যে তৎকালীন বাংলা দেশের পল্লী সমাজের এক বাস্তব রূপ অত্যন্ত বেদনার সাথে চিত্রিত হয়েছে। আর সেই পল্লীসমাজের যথার্থরূপ ফুটিয়ে তুলতে এখানে তিনি দুটি মৃত্যু দৃশ্যের অবতারণা করেছেন। সমাজের বৈপরীত্য ফুটিয়ে তুলতে মৃত্যু দৃশ্যদুটি যথার্থ ভূমিকা গ্রহণ করেছে।

গল্পের শুরুতেই আমরা দেখি ঠাকুরদাস মুখুজ্যের বর্ষীয়সী স্ত্রী সাত দিনের জ্বরে মারা যান। স্বামী সঙ্গতিপন্ন মানুষ। ছেলে, মেয়ে, জামাই, নাতি, নাতনি নিয়ে যেন সুখের হাট। তাই তাঁর মৃত্যুতে আত্মীয় স্বজন, চাকর বাকর, পাড়া প্রতিবেশী মিলে যেন একটা উৎসব বেঁধে যায়। শুরু হয় ধূম ধামের শব যাত্রা। পায়ে আলতা, কপালে সিঁদুর, ললাটে চন্দন ও বহু মূল্য বস্ত্রে আচ্ছাদিত হয়ে শবযাত্রা শুরু হয়। পুষ্পে, পত্রে, গন্ধে মাল্যে, কলরবে মনে হয় না এ কোনো শোকের ব্যাপার বরং মনে হয় বড় বাড়ির গৃহিনী পঞ্চাশ বছর পরে আর একবার পতিগৃহে যাত্রা করছেন। অবশেষে গ্রামের একান্তে গরুড় নদীর তীরে শবযাত্রা পৌঁছায় এবং চন্দনকাঠ, ঘৃত, মধু, ধূপ, ধুনা প্রভৃতি উপকরণে শুরু হয় অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া, চিতা থেকে নির্গত হতে শুরু করে অজস্র ধোঁয়া যা নীল রঙের ছায়া ফেলে ঘুরে ঘুরে আকাশে উঠতে থাকে আর দূর থেকে অভাগী সেই ধোঁয়ার মধ্যে প্রত্যক্ষ করে একটি স্বর্গীয় রথ, যার উপর বসে মা-ঠাকরুণ স্বর্গে যাত্রা করছেন। এই দৃশ্য দেখে অভাগীর দু'চোখ বেয়ে অশ্রু ধারা নেমে আসতে থাকে।

আর দ্বিতীয় মৃত্যু দৃশ্যে আমরা প্রত্যক্ষ করি এক স্বামী পরিত্যক্তা দুলে বৌকে। যার ইচ্ছা জেগেছিল সেও তার ছেলের হাতের আগুন ও স্বামীর পদধূলি পেয়ে বামুন মার মতো রথে চড়ে স্বর্গে যাবে। বামুন মার মত অভাগীও প্রায় সাত দিনের জ্বরে মারা গেল। অনেক অনুরোধে স্বামী পরিত্যক্তা অভাগী একেবারে শেষ সময়ে স্বামীর পদধূলি পেল। পতিব্রতা রমণীর পাতিব্রত্যে বিপথগামী স্বামীকে তার কাছে একবারের জন্য হলেও ফিরে আসতে হল। যে রসিক জীবনে স্ত্রীকে ভালোবাসেনি, জামা কাপড় দেয়নি, খেতে দেয়নি, কোনো খোঁজ খবর রাখেনি, মরণকালে তাকেই তার অনুরোধে একটু পায়ের ধূলো দিতে গিয়ে কেঁদে ফেললো। অভাগীর প্রথম আকাঙ্খাটি পূরণ হলেও অন্য আকাঙ্খাটি রয়েই গেল। ছেলের হাতে আগুন পেল তবে কাঠের নয় খড়ের। অভাগী দুলে বৌয়ের ভাগ্যে কাঠ জুটলো না। এমনকি নিজের হাতে পোঁতা বেলগাছটিও পেল না। দুলে হয়ে জন্মানোর জন্য কাঙালীকে মার ধোর, কটুক্তি শুনতে শুনতে বেবাক চুপ হয়ে যেতে হল। নদীর চড়ায় মাকে শুইয়ে খড়ের নুড়ো মুখে ধরে অন্ত্যেষ্টি শেষ করতে হল। একজনের শেষ কৃত্য সম্পন্ন হল চন্দনকাঠ, ঘৃত, মধু, ধূপ, ধূনা প্রভৃতি উপকরণে আর অন্যজনের 'সকলে মিলিয়া মাটি চাপা দিয়া কাঙালির মায়ের শেষ চিহ্ন বিলুপ্ত করিয়া দিল।'

শরৎচন্দ্র একজন সমাজ সচেতন শিল্পী। সমাজকে অনাবৃত ভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরা, তার অন্যায় অসাম্যের প্রতিবাদ করাই হল তাঁর শিল্পী সত্ত্বা। তাই গল্পের শুরু ⇒ শেষে দুটি মৃত্যু দৃশ্য তুলে ধরে তিনি সমাজের বৈপরীত্যকে তুলে ধরেছেন। সমাজে আমারা অন্ত্যজ, যারা নীচ জাতির মানুষ, যারা দু'বেলা দুমুঠো খেতে পর্যন্ত পায় না তাদের প্রতি সমাজের উপরতলার মানুষদের হৃদয়হীনতার এক অপূর্ব চিত্র এই মৃত্যু দৃশ্য টিতে ফুটে উঠেছে। উচ্চবর্ণের মানুষরা যে কতটা হৃদয়হীন, স্বার্থপর, মানবিকতাবোধহীন নিতে পারে বা ছিল তা যেন শরৎচন্দ্র এখানে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। আমার এই ঘটনা যে বালককে বৃদ্ধে পরিণত করে তারই এক মর্মন্তুদ কাহিনী 'অভাগীর

৩.‘অভাগীর স্বর্গ' গল্পটির নামকরণের সার্থকতা বিচার করো।

 উত্তর : গল্প, উপন্যাস, নাটক বা কবিতা, যে কোনো সৃষ্টিকর্মের নামকরণ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ  বিষয়। কেননা নামকরণের মধ্য দিয়েই পাঠক বিশেষ সৃষ্টি কর্মটি সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং লেখকও নামকরণের মধ্য দিয়ে পাঠক মনকে সূচনা থেকে উপসংহার পর্যন্ত ধরে রাখেন ও একটি ধারণা গড়ে তুলতে সাহায্য করেন।

আলোচ্য 'অভাগীর স্বর্গ' নামকরণের সার্থকতা বিচার করার আগে আমাদের নামকরণের সাধারণ রীতিগুলি সম্বন্ধে অবহিত হওয়া প্রয়োজন। নামকরণ কখনো লেখকের বিশেষ কোনো বক্তব্য বা বিষয়বস্তু কেন্দ্রিক হয়ে থাকে কখনো বা নামকরণ হয় ব্যঞ্জনাধর্মী। আবার কখনো বা চরিত্র কেন্দ্রিক।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'অভাগীর স্বর্গ' বাংলা সাহিত্যের একটি স্মরণীয় ছোটগল্প। গল্পটির নামকরণের সার্থকতা বিচারের আগে বিষয়বস্তুর দিকে একটু নজর দেওয়া প্রয়োজন। ঠাকুরদাস মুখুজ্যের বর্ষীয়সী স্ত্রী দিন সাতেকের জ্বরে হঠাৎ মারা গেলে মহাধুমধামে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পত্রে, পুষ্পে, মাল্যে, গন্ধে ও কলরবে সেই শোভাযাত্রা দেখে যেন মনে হয় বড়বাড়ির গৃহিণী যেন পঞ্চাশ বছর পরে আর একবার স্বামী গৃহে যাত্রা করছেন। তাঁর শোভাযাত্রায় সমস্ত গ্রাম সঙ্গী হলে আর একটি প্রাণীও এই দলের সঙ্গী হয় সে অভাগী, জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তার মা মারা গেলে বাবা রাগ করে তার নাম রাখে অভাগী।

মাতৃহীনা, স্বামী পরিত্যক্তা এই অভাগী দূর থেকে সেই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দেখতে দেখতে নিজেকে ভাগ্যবতী বলে মনে করে এবং প্রজ্জ্বলিত চিতার ধুঁয়ার মধ্যে একটি রথের চেহারা সে সুস্পষ্ট দেখতে পায় যাতে বসে কর্তা-মা স্বর্গে যাচ্ছেন। তারও সেভাবেই স্বর্গে যাওয়ার ইচ্ছা হয় এবং সেই ইচ্ছার কথা সে তার ছেলে কাঙালীকে জানায়। এরপর অভাগীও জ্বরে পড়ে এবং দিন দিন তার অবস্থা খারাপ হতে থাকে অবশেষে কাঙালী তার মাকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করে। কবিরাজের কাছ থেকে কয়েকটি বড়িও নিয়ে আসে কিন্তু সে তা ফেলে দেয়। কাঙালীকে সে তার স্বামীর পায়ের ধূলো নিয়ে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার ইচ্ছা জানালে কাঙালী মায়ের কথা মত বাবাকে ডেকে আনে। অবশেষে স্বামীর পায়ের ধূলো আর কাঙালীর হাতে আগুন নেওয়ার আকাঙ্খা নিয়ে অভাগী তার অভাগ্য নিয়ে এই পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেয়। এরপর শুরু হয় মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণে সন্তানের প্রাণপন চেষ্টা কিন্তু হৃদয়হীন সমাজ তার সেই চেষ্টার কোনো মূল্য দেয় না। কাঙালীর বাবা তাদের উঠোনের বেলগাছটা কাটতে গেলে জমিদারের দারোয়ান এসে বাধা দেয় ও রসিককে মারধর করে। কাঙালী বিচারের জন্য ছুটে যায় গোমস্তা অধর রায়ের কাছে কিন্তু সেখান থেকেও সে বিতাড়িত হয়। এরপর হাজির হয় মুখুয্যে বাড়িতে কিন্তু সেখানেও নিরাশ হয় সে। তাকে শুনতে হয় 'তোদের জেতে কে কবে আবার পোড়ায় রে' কিংবা 'সব ব্যাটারাই এখন বামুন কায়েত হতে চায়।' এই জাতীয় কথা। ঘন্টা দুয়েকের অভিজ্ঞতায় কাঙালী যেন বুড়া হয়ে ওঠে। অবশেষে মায়ের মুখে একটু খড়ের নুড়ো জ্বেলে সবাই যখন মাটি চাপা দিতে ব্যস্ত তখন কাঙালী ঐ খড়ের আঁটি থেকে বের হওয়া স্বল্প ধোঁয়াটুকুর মধ্যে মাকে স্বর্গে যেতে দেখার জন্য পলকহীন চোখে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে।

সুতরাং উপরিউক্ত ঘটনার আলোকে এই সত্য প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে যে অভাগী সত্যিই অভাগী। মার স্নেহ কাকে বলে তা যেমন সে বোঝেনি তেমনি স্বামীর সোহাগও সে পায়নি। দুঃখ, কষ্ট, দারিদ্র্য তার নিত্য সঙ্গী। সে ভেবেছিল কাঙালী বড় হলে তার দুঃখ দূর হবে, কিন্তু যখন সে ১৫য় পা দিয়েছে তখনই অভাগীকে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। নিষ্ঠুর সমাজ নীচু জাতির দুলে বৌকে একটুকু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। অভাগ্য আর দারিদ্র্যই তার হয়ে উঠেছে পাথেয়। এমন একজন অভাগী নারীর স্বর্গে যাওয়ার ইচ্ছা যেন আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই হৃদয়হীন সমাজে যে তার ইচ্ছা পূরণ হবে না-এটাই স্বাভাবিক। এদিক থেকে গল্পটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়েও যেন হয়ে উঠেছে ব্যঞ্জনাধর্মী। কেননা কৃপণ ধনীর স্ত্রী অর্থের প্রাচুর্য্যে আর অহংকারের আতিশয্যে চন্দনকাঠে প্রজ্জ্বলিত আগুনের ধোঁয়ায় যদি স্বর্গে যেতে পারেন তাহলে স্বামী অন্ত প্রাণ, সন্তান বৎসল এবং সৎ চরিত্রের অধিকারিণী দুলে বৌ অভাগীও খড়ের নূড়োর ধোঁয়ার মধ্যে দিয়েও স্বর্গে যেতে পারে- সেদিক থেকে গল্পটির নামকরণ সার্থক, সুন্দর ও যথার্থ হয়েছে।

                                .................

                           Presented by

      skacademyallinone.blogspot.com