📚বি.এ মাইনর বাংলা:1st Semester: রসময়ীর রসিকতা: প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় : প্রশ্নোত্তর📚

✍️প্রশ্নমান – ২:

প্রশ্ন : ‘রসময়ীর রসিকতা' গল্পটি কটি পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত?

উত্তর : আটটি পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত।

প্রশ্ন : ‘রসময়ীর রসিকতা' গল্পে ক্ষেত্রমোহন ও রসময়ীর বয়স কত ছিল?

উত্তর :গল্পারম্ভে ক্ষেত্রমোহনের বয়স ছিল চল্লিশ এবং রসময়ীর বয়স ত্রিশ।

প্রশ্ন :রসময়ীর পিত্রালয় কোথায়? তার মধ্যে কোন্ রস বর্তমান ?

উত্তর :রসময়ীর পিত্রালয় হালিশহর। রসময়ীর মধ্যে রৌদ্ররস বর্তমান।

প্রশ্ন :‘রসময়ীর রসিকতা' গল্পে রসময়ীর পিত্রালয়ে কারা থাকেন ?

উত্তর :রসময়ীর বাড়িতে তার পিতা ও মাতা মারা যাওয়ায় পিত্রালয়ে বিধবা দিদি বিনোদিনী এবং তার দুটি ভাই নবীন ও সুবোধ থাকে।

প্রশ্ন : 'জজ আদালতে কৰ্ম্ম করেন' কে কর্ম করেন? কথাটি কে বলেছিল?

উত্তর : জজ আদালতে কর্ম্ম করেন হরিশচন্দ্র চাটুয্যে। উদ্ধৃতির বক্তা রসময়ীর দিদি বিনোদিনী।

প্রশ্ন : ‘তার এখনও অনেক দেরী'—কিসের এখনও অনেক দেরী?

 উত্তর : রসময়ীর মৃত্যুর এখনও অনেক দেরী—এই কথাই রসময়ী ক্ষেত্রমোহনকে বলেছে।

প্রশ্ন : ‘দুজনেই নির্বাক'—কারা দুজন ? নির্বাক কেন ?

উত্তর ঃ এখানে দুজন বলতে ক্ষেত্রমোহন ও খুড়া মশাইকে বলা হয়েছে। তারা নির্বাক কারণ, খুড়া মশাই ও ক্ষেত্রমোহন রসময়ীর পত্র পেয়ে বাকরুদ্ধ। রসময়ী তখন ছিল মৃত।

 প্রশ্ন : ‘ওর মানে বোধ হয় এই যে’– মানেটা কী ?

উত্তর : ওর মানে বোধ হয় এই যে, বেশি বয়সে বিবাহ করলে যে সমস্ত সাংসারিক অশান্তি উপস্থিত হয়, তাই তোমার অদৃষ্টে ঘটবে — খুড়ামহাশয় এইকথা রে বলেছিল।

প্রশ্ন : ‘লোকটি থিয়জফিস্ট'- লোকটির নাম কী? লোকটির বর্ণনা দাও।

 উত্তর : লোকটির নাম—মনোহরবাবু।

মনোহরবাবুর বয়স চল্লিশ বছর। চোখে সোনার চশমা। মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল—মুখমণ্ডল প্রচুর দাড়ি গোঁফে আবৃত। হাতে বড় বড় নখ।

প্রশ্ন : ‘দেখতে চান ত এনে দিতে পারি'-বক্তা কে? কি দেখার কথা বলা হয়েছে?

উত্তর : বক্তা এখানে সুরেন্দ্রবাবু। সুরেন্দ্রবাবু এখানে এডমন্ড গ্যারেট প্রণীত ‘আইসিস ভেরি মচ্ আনভেল্ড—অর সি স্টোর অব্ সি গ্রেট মাহাত্মা হোক্স' বইয়ের কথা বলা হয়েছে। 

প্রশ্ন : ‘হামি টোমার শ্বশুরবাড়ি সার্চ করিবে – কে, কার শ্বশুরবাড়ি কেন সার্চ করবে?

উত্তর : পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট ক্ষেত্রমোহনবাবুর শ্বশুরবাড়ি সার্চ করবেন। কাছে খবর ছিল এই বাড়িতে বোমা তৈরী হয়। সেটা সত্যি কিনা দেখার জন্যই পুলিশ সার্চ করতে চেয়েছেন। 

প্রশ্ন : পুলিশ থানা তল্লাশি করে কী কী পেল?

উত্তর : পুলিশ থানা তল্লাশি করে কিছু পাজী, কাশীদাসী মহাভারত এবং একখানা বটতলার ছেঁড়া উপন্যাস, খানকতক পুরাতন দলিল আর বিনোদিনীর বাক্স থেকে বের হল এক বান্ডিল চিঠি এবং খান কতক ঠিকানা লেখা সাদা খাম।

 প্রশ্ন : 'তিনি আছেন বলে বিশ্বাস করেন'— তিনি কে? কথাটির বক্তা কে?

উত্তর : তিনি এখানে সম্রাট সপ্তম এডোয়ার্ড। কথাটির বক্তা মনোহরবাবু।

 প্রশ্ন : ‘আইসিস্ আভেল্ড' বইটি কার রচিত? গল্পে বইটির প্রসঙ্গ কে আনেন ?

উত্তর : ‘আইসিস আভেল্ড' বইটির রচয়িতা মাদাম ব্লাভাটস্কি। গল্পে বইটির প্রসঙ্গ আনেন থিয়োজফিস্ট মনোহরবাবু।

প্রশ্ন : 'তাহাকে হুগলির হাসপাতালে আনা হইয়াছে—কাকে, কেন হুগলির হাসপাতালে আনা হয়েছে?

উত্তর : দোল উপলক্ষ্যে বাজী পোড়াতে গিয়ে ক্ষেত্রমোহনবাবুর ছোট সম্বন্ধী সুবোধ বিশেষ আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে; তাই হুগলির হাসপাতালে আনা হয়েছে।

প্রশ্ন : ‘রসময়ীর রসিকতা' গল্পে রসময়ী ক্ষেত্রমোহনকে ক'টি পত্র দিয়েছিল? পত্রগুলির মূল বক্তব্য কী ?

উত্তর : রসময়ী ক্ষেত্রমোহনকে তিনটি পত্র দিয়েছিল। পত্রগুলির মূল বক্তব্য— রসময়ী মরে গিয়েও বেঁচে আছে তাই ক্ষেত্রমোহন যাতে বিবাহ না করে এবং বিবাহ করলে দুর্গতির শেষ নেই।

প্রশ্ন :ক্ষেত্রমোহন দ্বিতীয়বার কেন বিবাহ করতে চেয়েছিলেন ?

 উত্তর: ক্ষেত্রমোহন ও রসময়ীর আঠারো বছরের দাম্পত্য জীবন কেটেছে শুধুমাত্র ঝগড়া ও সন্ধি করে। তাছাড়াও এই আঠারো বছরের দাম্পত্য জীবনে রসময়ী নিঃসন্তান। তাই ক্ষেত্রমোহন সন্তান লাভের আশায় পুনরায় বিবাহ করতে চান।

প্রশ্ন ঃ ক্ষেত্রমোহন রসময়ীর মৃত্যুর পর কতদিন বাদে কাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করার মনঃস্থির করেন ?

উত্তর : রসময়ীর মৃত্যুর ছ'মাস পর ক্ষেত্রমোহন নিজে হুগলির ইংরাজী জানা রজনীকান্ত ঘোষালের মেয়েকে দেখে পছন্দ করেন।

প্রশ্ন : রসময়ী ও ক্ষেত্রমোহনের কত বছর দাম্পত্য জীবন কেটেছে?

উত্তর : অষ্টাদশ বা আঠারো বছর তাদের দাম্পত্য জীবন কেটেছে। 

✍️প্রশ্নমান—৫:

প্রশ্ন : ‘ঠাকুরঝি, এসব কি?’—কথাটি কে কাকে বলেছে? ঠাকুরঝির চরিত্রটি আলোচনা করো।

উত্তর : প্রশ্নোক্ত মন্তব্যটি ক্ষেত্রমোহন রসময়ীর দিদি বিনোদিনীকে করেছেন। 

ঠাকুরঝির চরিত্র ঃ

‘রসময়ীর রসিকতা’ গল্পে যে নারী প্রধানবৃত্তে না থেকে, প্রধানা চরিত্রের কার্যসিদ্ধিতে ইন্ধন যুগিয়েছে তিনিই রসময়ীর দিদি বিনোদিনী। আপাতদৃষ্টিতে, বিনোদিনী উপেক্ষিত থেকে গেছে। বিশ্লেষণের ছুরি কিন্তু সেকথা বলে না।

গল্পের প্রারম্ভে দেখি, বিনোদিনী হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুলের সেই ছেলেটিকে ডেকে এনে যাবতীয় খোঁজ খবর নিয়ে রসময়ীকে নিয়ে গেছে হরিশ চাটুয্যের বাড়ির অন্দরমহলে। আবার পুলিশের পদচারণায় সেই রসময়ীকে নিয়ে চলে যায়, একবারও বাধা প্রদান করেনি রসময়ীর দৌরাত্মপনায়।

রসময়ীর অকালমৃত্যুতে বিনোদিনী সাময়িক বিপর্যস্ত হলেও একেবারেই ভেঙে

পড়েননি; কারণ এরপরই শুরু হতে থাকে বুদ্ধিতে শান দেবার পর্ব। পরলোক থেকে পত্র পৌঁছাতে থাকে ক্ষেত্রমোহনের হাতে। গল্পের রস ঘনিয়ে ওঠে। এবং এই চিঠির প্রেরক বিনোদিনী। গল্পের সুতো ধরা আছে তার হাতে। ধীর, স্থিত, সংযমী প্রতিমা বিনোদিনী হলেও তার মননে লুকিয়ে থাকে বুদ্ধিদীপ্ততার রশ্মি।

‘রসময়ীর রসিকতা’ গল্পে রসময়ী মুখ্য হলেও মৃত বোনের ইচ্ছাবাক্সর ডালা খুলেছিল অগ্রজা বিনোদিনী। এত করেও তার শেষ রক্ষা হল না। বুদ্ধি ও বিবেক তার থমকে যায় পুলিশী তদন্তের কাছে। ক্ষেত্রমোহন যখন সমগ্র চিঠিপত্র উদ্ধার করে তখন দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে যায় কীর্তির সাকিন ঠিকানাগুলি। বিনোদিনী তখনও অবিচল, মালা জপ করছে। তাই ‘কাব্যের উপেক্ষিতা' হয়েও বিনোদিনীই হয়ে উঠেছে। অন্তরালে থাকা চালিকাশক্তি।

প্রশ্ন : ‘রসময়ীর রসিকতা' আলোচনা করো। গল্পে থিওজফিস্টদের কথা যেভাবে ফুটে উঠেছে তা আলোচনা করো।

উত্তর : ‘রসময়ীর রসিকতা' গল্পের শৈল্পিক নমুনায় উঠে এসেছে থিওজফিস্টদের কথা। রসময়ীর মৃত্যুর পর শুরু হয় ভৌতিক পত্রর আদান প্রদান। এই প্রসঙ্গেই এসেছে সরকারী উকিল মনোহরবাবু ও নব্যযুবক সুরেন্দ্রনাথের কথা। ভৌতিক বা থিয়জফিস্ট কথার প্রসঙ্গ এসেছে এই পথ ধরেই। তাই মনোহরবাবু বলতেন— 'বিংশ শতাব্দীতে ভূতের অস্তিত্ব কোনো মতেই বিশ্বাস করতে পারেন না কেন ?'

রসময়ীর পত্র প্রসঙ্গেই এসেছে কেটি কিং-এর কথা। প্রথম চার্লসের সময় কেটি কিং জীবিত ছিলেন— ষোল বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। ‘গত শতাব্দীর মধ্যভাগে আমেরিকা ও ইউরোপের নানা স্থানে অনেক সেয়াসে, কেটি কিং স্থূল শরীর ধারণ করে আবির্ভূত হয়েছিলেন।'

সুরেন্দ্রবাবু তীব্রতম প্রতিবাদের জ্বালা বর্ষণ করেন মনোহরবাবুর কথায়। কুটুম্বিলাল ও মাদাম ব্লাভাটস্কির চিঠিপত্রর প্রসঙ্গ তোলেন মনোহরবাবু। ভৌতিক অস্তিত্ব প্রমাণের প্রচেষ্টা চালান মনোহরবাবু— বোঝা যায়, তিনি থিওজফিস্ট দলের অন্যতম সদস্য। ‘আইসিস্ আনভেল্ড' বইটির কথা প্রসঙ্গে আরও স্পষ্ট হয়। সুরেন্দ্রবাবু কিন্তু এর প্রতিবাদ করে গেছেন প্রতি মুহূর্তে। গল্পকার লিখলেন 'There are more things in heaven and earth, Horatio, Than are dreamt of in your philosophy.'

রসময়ীর অস্তিত্ব প্রমাণে মনোহরবাবু বদ্ধপরিকর। তাই তিনি বলেন— 'মুক্তাত্মাগন সাধারণতঃ অশরীরী। কিন্তু কখনো কখনো তাঁরা নিজেকে মেটিরিয়েলাইজ অর্থাৎ জড়দেহসম্পন্ন করে থাকেন।' রসময়ী যে কোনো সময় যে ক্ষেত্রমোহনের বুকে ছুরি বসাতে পারে এই বিষয়ে সন্দেহের অপেক্ষাই থাকে না। তাই ‘থিয়জফিস্ট' মনোহরবাবু ছিলেন বলেই মৃতা রসময়ীর অস্তিত্বপূর্ণ উপস্থিতি আরও প্রাণবন্ত হয়েছিল।

✍️প্রশ্নমান-১০:

প্রশ্ন : ‘রসময়ীর রসিকতা' গল্পে হাস্যরস প্রধান হয়ে উঠেছে—আলোচনা করো। 

উত্তর : আটটি পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত ‘রসময়ীর রসিকতা' গল্পে রৌদ্ররস, ভয়ানক রস, ভৌতিক রস এসব বাহ্য হয়ে হাস্যরসের প্রাধান্য গুরুত্ব পেয়েছে। রাইনবার্ট জার্মান ভাষায় যে বাংলা গল্পের সংকলন গ্রন্থ ১৯২৬ খ্রিঃ প্রকাশ করেছিলেন সেখানেও গল্পটি স্থান লাভ করে।

 কৌতুকরসের প্রবাহ গল্পকে চমৎকারিত্ব দান করেছে।

মোক্তার ক্ষেত্রমোহন আদালতে বাক্যবাণে বধ করলেও বাড়িতে রসময়ীর ভয়ে ভীত। ক্ষেত্রমোহন স্ত্রীর ভয়ে প্রায় অসংলগ্ন আচার-আচরণের প্রকাশ করে থাকেন। আর সেই অসংলগ্নতাই হাস্যরসের জন্ম দেয়। রসময়ীর আবির্ভাব ঘটে হরিশ চাটুজ্যের বাড়িতে দিদি বিনোদিনীর সঙ্গে। বাড়ির গিন্নিমাকে ঝাঁটা দিয়ে পিটিয়ে আঁশবটি নিয়ে ছুটোছুটি করতে করতে সে বলেছে— “খুন চেপেছে, সবাইকে খুন করে ফাঁসি যাবো। স্বামীর বিয়ে ভাঙাতে সে দক্ষযজ্ঞ শুরু করেছে। ক্ষেত্রমোহনকে রসময়ী বলেছে—বুড়ো বয়সে বিয়ে করছো নাকি শুনলাম', উত্তরে ক্ষেত্রমোহন বলেছেন— 'করছিই তো। করবো না কেন? তোমার ভয়ে নাকি?'

এরপরেই রসময়ী বলে – আঁশবটি দিয়ে সে মেয়ের নাকটা কেটে দেব আর বুকে দশমুনে পাথর চাপিয়ে দেব।' পঞ্চম পরিচ্ছেদে রসময়ীর মৃত্যু হবার পর ক্ষেত্রমোহনবাবু পুনরায় বিবাহ করার কথা ভাবলেও তাড়া করে বেড়ায় অশান্তি। ক্ষেত্রমোহনবাবু যে পত্নীকে শ্মশানে দাহ করে এসেছেন, সেই অশরীরী স্ত্রী তাকে চিঠি লেখে এবং পোস্টের মাধ্যমে সেই স্ত্রীর চিঠি এসে পৌঁছায় ক্ষেত্রমোহনের কাছে।

প্রথম চিঠিতে রসময়ী ক্ষেত্রমোহনকে বিবাহ করতে মানা করেছে। কিন্তু সে মানা শোনেনি। এরপরই আশীর্বাদ পর্ব মেটাবার পর পুনরায় অশরীরী 'দশমুনে পাথর | চাপাবার ভয় দেখিয়েছে। পাঠকবর্গ এই ভৌতিক চিঠিগুলোকে নিয়ে যতটা চিন্তিত ও স্তম্ভিত হয়েছে—তারপরেই হাস্যরসের ধারায় গড়িয়ে পড়ে।

আটটি পরিচ্ছেদে রচিত এই গল্পে রসময়ীর বেঁচে থাকাকালীন অবস্থায় স্বামীর সঙ্গে অচার আচরণে যেমন হাস্যরসের ধারা রয়ে গেছে—মৃত্যুর পরও তা অম্লান থেকেছে। ক্ষেত্রমোহনবাবুর সঙ্গে রসময়ীর বয়সের তফাৎ ছিল দশ বছরের। ক্ষেত্রমোহনের চল্লিশ, রসময়ীর ত্রিশ। ক্ষেত্রমোহনবাবুর আঠারো বছরের দাম্পত্য জীবন ঝগড়া ও আপোষের সঙ্গে কেটেছে। মাঝে মাঝেই স্ত্রীর ভয়ে ক্ষেত্রমোহনবাবুকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। রসময়ীর কাছ থেকে ছাড়া পেতে এবং সন্তানের আশায় তিনি পুনরায় বিবাহ করতে চেয়েছিলেন। অসুখে ভুগে রসময়ীর মৃত্যুর পর ক্ষেত্রমোহনবাবু সে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেখানেও অস্বস্তিকর আতঙ্ক পিছু ছাড়েনি। পাঠকমনে তাই অট্টহাস্য না জাগালেও অন্তর্দৃষ্টিতে বিচার করলে দেখা যায় লেগে থাকে করুণার হাসিটুকু ৷

প্রশ্ন : ‘রসময়ীর রসিকতা' গল্পে রসময়ীর চরিত্র আলোচনা করো। 

উত্তর : নারী মনের রহস্য মোচন করা দুঃসাধ্য। তাদের দাম্পত্য জীবনের কাঁটা বেছানো পথে কখনোই সাথী করতে চায় না কাউকেই। ‘রসময়ীর রসিকতা' গল্পে রসময়ী সেরকমই এক নারী চরিত্র।

সন্তানহীনতা রসময়ী ও ক্ষেত্রমোহনের দাম্পত্যজীবনকে বিড়ম্বনাময় করে তুলেছিল। ক্ষেত্রমোহনকে কেন্দ্র করে রসময়ীর মনে উঠেছিল বিক্ষুব্ধতার তুফান। উত্তর বিবাহ জীবনে তাই ক্ষেত্রমোহনকেও সুখের মুখ দেখতে দেবে না এমনই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ রসময়ী। সেখান থেকেই তার কলহপ্রিয়া হয়ে ওঠা।

চিন্তিত রসময়ীর মনে বিঁধতে থাকে সন্তানহীনতার কারণ দেখিয়ে ক্ষেত্রমোহন যদি দ্বিতীয়বার বিবাহ করে! তাহলে তার শেষ আশ্রয়টুকুও যাবে অতলে। রসময়ীর জানা ছিল, ক্ষেত্রমোহনের আত্মীয়রা তার দ্বিতীয়বার বিবাহ দেবার জন্য উদ্যোগী হয়েছে। রসময়ী তখন হয়ে ওঠে রণচণ্ডী ও বেপরোয়া। তার জেদ, বুদ্ধিমত্তা ও নারীসুলভ স্বাভাবিকতায় দিদি বিনোদিনীকে নিয়ে আসরে উপস্থিত হয়েছে।

হরিশবাবুর গৃহে উপস্থিত হয়ে বিনোদিনী কথাবার্তা চালাচ্ছিলেন। কিন্তু হরিশবাবুর স্ত্রী দুটি বিশেষণ রসময়ী প্রসঙ্গে উল্লেখ করায় সে ক্রোধান্মত্ত হয়ে ওঠে। তবে ক্ষুব্ধ হলেও সে জ্ঞানশূন্য হয়নি। সে হরিশবাবুর বাড়িতে বলতে পারে, 'আমার সোয়ামী ছাড়া কী তোমার মেয়ের অন্য পাত্তর জুটলো না?' গৃহিণীকে ঝাঁটাপেটা করায় রসময়ীর ছদ্ম রাগের অভিনয়টাই প্রকটিত।

হরিশবাবুর কাছ থেকে ক্ষেত্রমোহন সম্পূর্ণ ঘটনা শুনলেও বিবাহের ব্যাপারে তিনি অটল ও অনড়। রসময়ী তখন জানিয়েছে এই বুড়ো বয়সে পুনর্বার বিবাহ করলে আঁশবটি দিয়ে নববধূর নাক কেটে দেবে। বুকে চাপাবে দশমুনে পাথর।

‘রসময়ীর রসিকতা' গল্পে রসময়ী মৃত। তবু তার ইচ্ছাপূরণের চাবিকাঠি হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে বিনোদিনী। বৈশাখের তপ্ত রোদের মতো রসময়ী, জীবনের পারাবারে অসুখী রসময়ী, তবু সতীন সমস্যায় সে চায় না জর্জরিত হতে। সংসারকে সে দু'হাতে জাপটে ধরতে চেয়েছে, কিন্তু তার দুর্ভাগ্য জাপ্টে ধরার কৌশল পদ্ধতি ছিল অধরা। জোর খাটিয়ে মানুষের মন জয় করা যায় না—রসময়ী এটাই জানতো না। তাই মৃত্যুর পর বিনোদিনীর মারফৎ সে বজায় রেখেছে তার উপস্থিতি। নারীমানসের এক গভীর ও গোপন রহস্যের তাই সন্ধান দিয়েছেন গল্পকার। রসময়ীর চরিত্রকে তাই Sarah Dessen এর 'Along for the Ride' গ্রন্থের থেকে উদাহরণ দিয়ে বলা যায়—

'You couldn't just pick and choose at will when someone depended on you, or loved you. It wasn't like a light switch easy to turn on or off. If you were in, you were in, out, you wer out.

প্রশ্ন : ‘রসময়ীর রসিকতা' গল্পে ক্ষেত্রমোহন চরিত্রটি আলোচনা করো।

উত্তর : নারীমুখ্য গল্প ‘রসময়ীর রসিকতা'য় প্রধান পুরুষ চরিত্র ক্ষেত্রমোহন। তিনি জেলা কোর্টের প্রখ্যাত মোক্তার। প্রতিপক্ষকে অনায়াসে পরাস্ত করেন। কিন্তু গৃহিণীর কাছে অসহায় পুরুষ। কলহপ্রিয়া নারীর কাছে ক্ষেত্রমোহন অসহায়। পত্নীর জ্বালায় পতি গৃহছাড়া।

সংসারের বৃত্ত সম্পন্ন হয় নারীকে কেন্দ্র করে। মধুর দাম্পত্যজীবন আবর্তিত হয় সন্তানসুখ দেখে। আবহমান সময় থেকে এটাই চলমান রীতি। ক্ষেত্রমোহন রসময়ীকে বিবাহ করেছিলেন, তখন আঠারো বছর বয়স। অথচ নিঃসন্তান তারা। রসময়ীর তাই একপ্রকার আস্থাহীনতার জন্ম হয়েছে স্বামীর প্রতি এটাই খুব স্বাভাবিক । ক্ষেত্রমোহনের সঙ্গে কলহ করে রসময়ীর গন্তব্য ছিল পিত্রালয়। রসময়ীর গৃহত্যাগের পর ক্ষেত্রমোহন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে রসময়ীর মুখদর্শন করবে না। তিনি রসময়ীকে ফিরিয়ে আনারও উদ্যোগী হয়নি। বরং তিনি উঠে পড়ে লেগেছিলেন দ্বিতীয়বার বিয়ের পিঁড়িতে বসার জন্য। কিন্তু সে সময় 'পাড়ার একজন বালক প্রত্যহ নৌকাযোগে গঙ্গাপার হইয়া হুগলী ব্রাঞ্চ ইস্কুলে পড়িতে যাইত। সে ছেলেটি গ্রামে প্রচার করিয়া দিল—ক্ষেত্রমোহনবাবুর বিবাহ দিনস্থির হইয়া গেছে।'

আদালতে হরিশবাবুর মুখ থেকে ক্ষেত্রমোহন রসময়ীর কার্যকলাপ শুনে ক্রোধান্বিত হয়ে যান—বিবাহ ভেঙে দিতে রসময়ী বদ্ধপরিকর। তাই নববধূর বাড়িতে গিয়ে রণচণ্ডী মূর্তি সে দেখিয়ে এসেছে। রসময়ীর বাক্যবাণে বিপর্যস্ত ক্ষেত্রমোহন। তিনি বাধ্য হয়েই জানিয়েছেন—

“তুমি না মরলে আর বিয়ে করছিনে। মরবে কবে ?”

স্বামী হিসাবে ক্ষেত্রমোহন সাংসারিক বুদ্ধিহীন। তিনি বুঝতেই চাননি রসময়ীর এই উন্মত্ত আচরণ কেন? দাম্পত্যজীবনের আস্থাহীনতা ও সন্তান না হওয়া তাদের এনে দাঁড় করিয়েছে দুই বিপরীত মেরুতে। দুই হৃদয়ের আগা হওয়া বন্ধনকে আর কোনোভাবেই আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধার উপায় ছিল না। নিজস্ব বৃত্তে একাকী হয়ে গেছে পরস্পরের মধ্যে থেকেও।

রসময়ীর মৃত্যু আবার ক্ষেত্রমোহনের চরিত্র পারদে যোগ করেছে নবদিক। রোগশয্যায় নারীকে ছেড়ে যোজন দূরে থাকতে পারেননি তিনি। নিজে হালিশহরে হাজির হয়ে সাধ্যমতো রসময়ীর চিকিৎসার বন্দোবস্ত করেছেন। শেষ রক্ষা হয়নি। মৃত্যুর পর মুখাগ্নিও তিনি করেছেন। গল্পকার লিখলেন—

“আশ্চর্য্য সংসারের মায়া যে এত কষ্ট দিয়াছে, তাহার জন্যও ক্ষেত্রমোহন ঝর ঝর্ করিয়া অশ্রুপাত করিতে লাগিলেন।

                            ......................

                            Presented by

        skacademyallinone.blogspot.com